বনি-ইসরাইলদের মুর্তিপূজা, অনাচার ইত্যাদির কারণে ঈশ্বরের প্রতিক্রিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করে বাইবেল বলছে: ‘‘যারা আল্লাহ্ নয় এমন দেবতার দ্বারা ওরা আমার অন্তর্জ্বালা জন্মালো, নিজ নিজ অসার বস্ত্ত দ্বারা আমাকে অসন্তষ্ট করলো; আমিও ন-জাতি (those which are not a people) দ্বারা ওদের অন্তর্জ্বালা জন্মাবো, মূঢ় জাতি (a foolish nation) দ্বারা ওদেরকে অসন্তষ্ট করবো। (মো.-১৩)
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘আল্লাহ নয় এমন দেবতার পূজা করে তারা আমার পাওনা এবাদতের আগ্রহে আগুন লাগিয়েছে; অসার মূর্তির পূজা করে তারা আমার রাগ জাগিয়ে তুলেছে। জাতিই নয় এমন জাতির হাতে ফেলে আমিও তাদের অন্তরে আগুন জ্বালাব; একটা অবুঝ জাতির হাতে ফেলে তাদের রাগ জাগাব।’’
এ ভবিষ্যদ্বাণীর মর্ম আরো সুস্পষ্ট হয় যিশাইয় ৬৫/১-৬ শ্লোক দ্বারা: ‘‘যারা জিজ্ঞাসা করেনি, আমি তাদেরকে আমার সন্ধান করতে দিয়েছি; যারা আমার খোঁজ করেনি, আমি তাদেরকে আমার উদ্দেশ পেতে দিয়েছি; যে জাতি আমার নামে আখ্যাত হয়নি, তাকে আমি বললাম, ‘দেখ, এই আমি, দেখ এই আমি’। আমি সমস্ত দিন বিদ্রোহী লোকবৃন্দের (কেরি: প্রজাবৃন্দের) প্রতি আমার দু’হাত বাড়িয়েই রয়েছি; তারা নিজ নিজ কল্পনার অনুসরণ করে কুপথে গমন করে। সেই লোকেরা আমার সাক্ষাতে অনবরত আমাকে অসন্তষ্ট করে, বাগানের মধ্যে কোরবানী করে, ইটের উপরে সুগন্ধিদ্রব্য জ্বালায়। তারা কবরস্থানে বসে, গুপ্ত স্থানে রাত যাপন করে; তারা শুকরের গোশ্ত ভোজন করে ও তাদের পাত্রে ঘৃণিত মাংসের ঝোল থাকে; তারা বলে, স্বস্থানে থাক, আমার কাছে এসো না, কেননা তোমার চেয়ে আমি পবিত্র। এরা আমার নাসিকার ধোঁয়া, সমস্ত দিন জ্বলতে থাকা আগুন। দেখ, আমার সম্মুখে এই কথা লেখা আছে; আমি নীরব থাকব না, প্রতিফল দেব; এদের কোলেই প্রতিফল দেব।’’ ইশাইয়া ৬৫/১-৬ (মো.-১৩)
মুসলিম পণ্ডিতরা এ বক্তব্যটাকে মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে গণ্য করেন। এখানে মূঢ় (আরবী বাইবেলে: জাহিল) জাতি বলতে আরবদেরকে বোঝানো হয়েছে, যাদেরকে উম্মী বা নিরক্ষর ও জাহিল বা মূঢ় বলা হতো। দাসী হাজেরার পুত্র ইসমাইলের বংশধর হওয়ার কারণে এবং ধর্মবিষয়ক অজ্ঞতার কারণে ইহূদিরা তাদেরকে ঘৃণা করতেন। ইহূদীরা ইবরাহীমের স্বাধীন স্ত্রীর সন্তান, আল্লাহর আশীর্বাদ-প্রাপ্ত, নবীদের বংশধর, আসমানী কিতাব ও শরীয়তের অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে উন্নত জাতি বলে মনে করতেন। কিন্তু তারা প্রতিমা পূজা ও বহুবিধ শিরক ও পাপাচারে লিপ্ত হন। শাস্তি হিসেবে মহান আল্লাহ তাদের নিয়ামত ও মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের কাছে ঘৃণিত ও জাতি হিসেবে ‘অগণ্য’ আরব জাতি বা বনি-ইসমাইলকে প্রদান করে বনি-ইসরাইলের জন্য চিরস্থায়ী মনোকষ্টের ব্যবস্থা করেন।
বাইবেলের পুরাতন নিয়ম অধ্যয়ন করলে পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, ঈশ্বরের একত্ববাদ বা একমাত্র ঈশ্বরের ইবাদত করা ও অন্য কোনো মানুষ, দেবতা, প্রতিমা বা বস্ত্তর ইবাদত না করাই বাইবেলের মূল নির্দেশ। ইহূদীরা একত্ববাদ বিনষ্ট করে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে। এর বিপরীতে একটা মুঢ় জাতিকে প্রকৃত একত্ববাদ প্রদান করে তাদের মাধ্যমে আল্লাহ ইহূদীদেরকে অসন্তুষ্ট করেন। আর এজন্যই মুসলিমদের প্রতি ইহূদীদের অন্তর্জ্বালা ও অসন্তুষ্টি চিরন্তন। তাত্ত্বিকভাবে তারা স্বীকার করতে বাধ্য যে, খ্রীষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম ইত্যাদি অত্যন্ত বিকৃত, ঘৃণ্য ও ঈশ্বরের অবমাননাকর বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে ইসলামী একত্ববাদ, মুর্তিপূজার বিরোধিতা, ইবাদত-বন্দেগি, শুচিতা-অশুচিতা ইত্যাদি সবই বিশুদ্ধ একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ও ইহূদী ধর্ম-ব্যবস্থার কাছাকাছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের প্রতি তাদের অসন্তুষ্টি এতই বেশি ও চিরস্থায়ী যে, এদের বিরুদ্ধে তারা যে কোনো মুর্তিপূজক, ত্রিত্ববাদী বা বহু-ঈশ্বরবাদী জাতির সাথে জোটবদ্ধ হতে প্রস্তুত।
যে সকল জাতি দ্বারা আল্লাহ ইস্রায়েলীয়গণকে অসন্তুষ্ট করেছেন তাদের অন্যতম ব্যাবিলনীয় জাতি, গ্রীক-রোমান জাতি ও আরব জাতি। এদের মধ্যে আরবরাই ছিল মূঢ় বা জাহিল হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ। অন্যান্যরা শিক্ষা, সভ্যতা ও জ্ঞান-দর্শনে ইস্রায়েলীদের সমপর্যায়ের বা তার চেয়েও অধিক উন্নত ছিল। কোনো প্রাজ্ঞ গবেষকই দাবি বা স্বীকার করবেন না যে, ব্যাবিলনীয়রা বা গ্রীকরা মুর্খ জাতি বা তারা আরব বা ইহূদীদের তুলনায় মুর্খ ছিল। খৃস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আরবরা ছাড়া অন্য কোনো জাতি এরূপ মূঢ় বা জাহিলী জাতি বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীটা আক্ষরিকভাবে আরব জাতির মধ্যে এক মহান নবীর আবির্ভাবের কথা বলেছে, যার আবির্ভাব পৌত্তলিকতা, প্রতিমাপূজা, শূকরের মাংস ভক্ষণ ও অন্যান্য পাপাচারে লিপ্ত ইহূদী জাতির স্থায়ী মনোকষ্ট ও অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করবে।
এছাড়া আমরা দেখেছি যে, অসন্তুষ্টির মূল বিষয় অসার দেবদেবীর উপাসনা বনাম প্রকৃত একত্ববাদ লাভ। এ দিক থেকে মুসলিমগণ ছাড়া অন্য কোনো জাতি তাদেরকে অসন্তুষ্ট করে নি। সর্বোপরি এরূপ চিরন্তুন অসন্তুষ্টি আর কোনো জাতির প্রতি তাদের নেই। খৃস্টানগণ তো বনি-ইসরাইলেরই অন্তুর্ভুক্ত এবং তাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। কাজেই তাদেরকে ভিন্ন জাতি বা মূঢ় জাতি বলে গণ্য করার কোনো উপায় নেই।
এছাড়া ইহূদীদের অন্তর্জ্বালার সবচেয়ে বড় বিষয় ফিলিস্তিন অধিকার। এখানেও আল্লাহ আরবজাতিকে তাদের স্থায়ী অন্তর্জ্বালার উৎস বানিয়েছেন। ইতিহাসের যে কোনো পাঠক জানেন যে, বিগত দেড় হাজার বছর ধরে ইহূদীরা ইউরোপসহ সারা পৃথিবীতে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং একমাত্র আরব ও মুসলিম দেশগুলোতেই পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও শান্তিতে অবস্থান করেছেন। কিন্তু ইহূদীদেরকে প্রশ্ন করলে দেখবেন, তাদের অন্তর্জ্বালা অত্যাচারীদের প্রতি তত নয়, যতটা আরব ও মুসলিমদের প্রতি।