বাইবেলের পঞ্চম পুস্তক দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৭-২০ বলছে:
‘‘তখন মাবুদ আমাকে বললেন, ‘ওরা ভালই বলেছে। আমি ওদের জন্য ওদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার মত এক জন নবী (a Prophet from among their brethren, like unto thee) উৎপন্ন করব। ও তার মুখে আমার কালাম দেব; আর আমি তাঁকে যা যা হুকুম করব তা তিনি ওদেরকে বলবেন। আর আমার নামে তিনি আমার যে সব কালাম বলবেন, আমার সেই কথা যদি কেউ না শোনে তবে আমি সেই লোককে দায়ী করব। কিন্তু আমি যে কালাম বলতে হুকুম করিনি, আমার নামে যে কোন নবী দুঃসাহসপূর্বক তা বলে কিংবা অন্য দেবতাদের নামে যে কেউ কথা বলে সেই নবীকে মরতে হবে। (মো.-১৩)
মুসলিম পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, এখানে বনি-ইসরাইলের ভাতৃগণ বনি-ইসমাইল বা ইসমাইল বংশে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে মূসা (আ)-এর মত একজন নবী হিসেবে প্রেরণের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা এ দাবি অস্বীকার করেন। কোনো কোনো ইহুদি পণ্ডিত দাবি করেন যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীতে মূসা (আ)-এর পরবর্তী নবী ইউসাকে বোঝানো হয়েছে। আর খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, এখানে যীশু খ্রিষ্টকে বোঝানো হয়েছে। খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসে তিনি নিজেই ঈশ্বর ছিলেন, ঈশ্বরের পুত্রও ছিলেন, ঈশ্বরের নবীও ছিলেন এবং ঈশ্বরের মসীহও ছিলেন।
মুসলিম পণ্ডিতরা বাইবেলের বিভিন্ন বক্তব্য দ্বারা ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের দাবি খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। যোহন বা ইউহোন্না তাঁর ইঞ্জিলের প্রথম অধ্যায়ে লেখেছেন: ‘‘আর ইয়াহিয়ার সাক্ষ্য এই- যখন ইহুদীরা কয়েক জন ইমাম ও লেবীয়কে দিয়ে জেরুসালেম থেকে তাঁর কাছে এই কথা জিজ্ঞাসা করে পাঠালো, ‘ধাপনি কে?’ তখন তিনি স্বীকার করলেন, অস্বীকার করলেন না, তিনি স্বীকার করে বললেন, ‘আমি সেই মসীহ নই।’ তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো, তবে আপনি কে? আপনি কি ইলিয়াস? তিনি বললেন, আমি নই। আপনি কি সেই নবী? জবাবে তিনি বললেন, না। ... তারা তাঁকে জিজ্ঞসা করলো, আপনি যদি সেই মসীহ্ নন, ইলিয়াসও নন, সেই নবীও নন, তবে বাপ্তিস্ম দিচ্ছেন কেন?’’ (ইউহোন্না ১/১৯-২৫, মো.-১৩)
এ বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ইহুদিরা বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিশ্রুত নবীর আগমন তখনো হয়নি এবং ‘সেই নবী’ ও ‘মসীহ’ দু’ ব্যক্তি হবেন, এক ব্যক্তি নন। ইউহোন্না অন্যত্র লেখেছেন: ‘‘সে সব কথা শুনে লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বললো, ইনি সত্যিই সেই নবী। আর কেউ কেউ বলল, ইনি সেই মসীহ।’’ (ইউহোন্না ৭/৪০-৪১)। এ থেকেও জানা যায় যে, ‘মসীহ’ ও ‘সেই নবী’ পৃথক ব্যক্তি হবেন।
মুসলিম পণ্ডিতরা আরো দাবি করেন যে, উপরের ভবিষ্যদ্বাণীর বক্তবও প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদই (ﷺ) প্রতিশ্রুত নবী। কারণ তিনি মূসার মত বা সদৃশ (like unto thee) ছিলেন। যেমন তাঁরা উভয়ে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, পিতা-মাতার সন্তান, বিবাহিত ও সন্তান-সন্ততির পিতা, উভয়েই নতুন শরীয়ত দিয়েছেন, উভয়ের শরীয়তেই রাষ্ট্র, সমাজ, জিহাদ, যুদ্ধ, বিচার, শাস্তি ইত্যাদি বিধান বিদ্যমান, উভয়েই ত্রিত্ববাদ মুক্ত বিশুদ্ধ তাওহীদ বা একত্ববাদের শিক্ষা ও নির্দেশ দিয়েছেন, উভয়েই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁরা কেউ অনুসারীদের জন্য শাপগ্রস্ত হননি ইত্যাদি। তাঁদের উভয়ের জীবন ও ধর্ম-ব্যবস্থা (শরীয়ত) তুলনা করলে এরূপ আরো অনেক সাদৃশ্য ও মিল আমরা দেখতে পাই। এ সকল কোনো বিষয়েই ঈসা মাসীহের সাথে মূসার (আ) কোনো মিল নেই। তিনি কোনোভাবেই মূসার সদৃশ ছিলেন না। এছাড়া বাইবেল বলছে: ‘‘মূসার মত কোন নবী ইসরাইলের মধ্যে আর উৎপন্ন হয়নি।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪/১০, মো.-১৩)
এ প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া ‘Muhammad in the Bible’ প্রবন্ধে লেখেছে:
“Samau'al al-Maghribi, a Jewish mathematician who converted to Islam, pointed to Deuteronomy 18:18 in his book Convincing the Jews as a prophecy fulfilled by Muhammad. Samau'al argued in his book that since the children of Esau are described in Deuteronomy 2:4-6 [and in Numbers 20:14 as well] as the brethren of the children of Israel, the children of Ishmael can also be described the same way.... Some Muslim writers... interpreted Qur'an 46:10 as a reference to Deuteronomy 18:18. The witness from among the Children of Israel is thought to be Moses, and the one like him is believed to be Muhammad. Qur'an 73:15 was also interpreted by some Muslim writers... as a reference to Deuteronomy 18:18. Similarly, Qur'an 53:3-4, where it has been stated that "Nor does he (Muhammad) speak of his own desire. It is but an Inspiration that is inspired [unto him]", was further interpreted by Muslim writers, as a reference to Deuteronomy 18:18. John 1:20-21 was also cited by Muslims as a proof from the canonical gospels that Deuteronomy 18:18 is not a prophecy of the Christ.”
‘‘ইহুদি গণিতবিদ সামাওয়াল মাগরিবী যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তার ‘ইহুদিদেরকে বোঝানো’ নামক পুস্তকে দ্বিতীয় বিবরণকে ১৮/১৮ মুহাম্মাদের (ﷺ) আগমনের মাধ্যমে পূর্ণতার ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে ইঙ্গিত করেছেন। সামাওয়াল যুক্তি দিয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিবরণ ২/৪-৬ (এবং গণনা ২০/১৪) শ্লোকে ইস-এর বংশধরদেরকে বনি-ইসরাইলের ‘ভ্রাতৃগণ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এজন্য ইসমাইলের বংশধরগণও একইভাবে বনি-ইসরাইলের ‘ভ্রাতৃগণ’ বলে আখ্যায়িত হতে পারেন। ... কোনো কোনো মুসলিম লেখক কুরআনের ৪৬ সূরার (আহকাফ) ১০ আয়াতকে দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৮ উদ্ধৃতি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ আয়াতে বনি-ইসরাইলের সাক্ষী বলতে মূসা (আ) এবং ‘তাঁর মত একজনের’ বলতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বোঝানো হয়েছে। কুরআনের ৭৩ সূরার (মুযাম্মিল) ১৫ আয়াতকেও কোনো কোনো মুসলিম লেখক দ্বিতীয় বিবরণের এ বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত বলে গণ্য করেছেন। অনুরূপভাবে কুরআনের ৫৩ সূরা (নাজম) ৩-৪ আয়াত বলছে: ‘‘তিনি (মুহাম্মাদ) নিজের ইচ্ছা থেকে কথা বলেন না, তাঁর কথা ওহী ভিন্ন কিছুই নয়, যা তাকে প্রত্যাদেশ করা হয়।’’ এ বক্তব্যকেও কোনো কোনো মুসলিম লেখক দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৮-এর উল্লেখ বলে গণ্য করেছেন। মুসলিমগণ স্বীকৃত ইঞ্জিল যোহন ১/২০-১২ উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেন যে, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৮ খ্রিষ্টের আগমন বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী নয়।’’