৯. ৭. ৮. ১. যুদ্ধের ঘোষণা ছাড়াই গুপ্তহত্যা
ঈশ্বরের প্রিয় প্রজা বনি-ইসরাইলরা প্রতিমাপূজায় লিপ্ত হন। এজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে ঈশ্বর তাদেরকে ফিলিস্তিনের মূল অধিবাসী বিভিন্ন রাজার অধীন করে দেন। বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে ফিলিস্তিনিরা বনি-ইসরাইলদের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য ও মানবিক ছিল। তারা বনি-ইসরাইলদের অধীন করলেও তাদেরকে গণহারে হত্যা করেনি, তাদের দেশগুলোতে অগ্নিসংযোগ করেনি, তাদের কুমারী মেয়েগুলো ছাড়া বাকিদের হত্যা করেনি বা নির্বিচারে নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা করেনি। বরং তাদেরকে অধীন করে খাজনা নিয়েছে বা মাঝে মাঝে লুটতরাজ করেছে। বাইবেলীয় গণহত্যার তুলনায় এগুলো ছিল অনেক বেশি মানবিক। তারপরও বনি-ইসরাইল ঈশ্বরের কাছে স্বাধীনতা চেয়েছে এবং ঈশ্বর তাদেরকে ত্রাণকর্তা দান করেছেন।
ত্রাণকর্তা বুঝাতে ইংরেজি বাইবেলগুলোতে ডেলিভারার, সেভিয়র বা মাশিয়া/ মাসীহ লেখা হয়েছে। KJV (কিং জেমস ভার্শন) ও কিছু ভার্শনে: a deliverer; ASV, CJV, DARBY, DRA, JUB, MSG, NOG, NABRE, WEB, WYC, YLT ও অন্যান্য ভার্শনে: a saviour এবং OJB (Orthodox Jewish Bible: অর্থোডক্স জুইশ বাইবেল)-এ: a Moshi’a লেখা হয়েছে।[1]
এরূপ একজন ত্রাণকর্তা (saviour) বা মসীহ ছিলেন এহূদ (Ehud)। এ সময়ে বনি-ইসরাইল মোয়াবের বাদশাহর অধীন ছিল এবং তাকে খাজনা দিত। এহূদ খাজনা দেওয়ার ছলে যেয়ে মোয়াবের বাদশাহকে গুপ্ত হত্যা করেন:
‘‘পরে মাবুদের চোখে যা খারাপ বনি-ইসরাইলরা আবার তাই করতে শুরু করল। কাজেই মাবুদ মোয়াবের বাদশাহ ইগেস্নানকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে তুললেন। অম্মোনীয় ও আমালেকীয়দের সংগে নিয়ে ইগেস্নান বনি-ইসরাইলদের হামলা করলেন এবং জেরিকো অধিকার করে নিলেন। বনি-ইসরাইলরা আঠারো বছর মোয়াবের বাদশাহ ইগেস্নানের অধীনে রইল। এরপর বনি-ইসরাইলরা আবার মাবুদের কাছে ফরিয়াদ জানাতে লাগল, আর তিনি তাদের জন্য এহূদ নামে একজন উদ্ধারকর্তা (a deliverer/ a saviour/ a Moshi’a ) দাঁড় করালেন। তিনি ছিলেন বিনইয়ামীন গোষ্ঠীর গেরার ছেলে। তিনি বাঁ হাতে কাজ করতেন।
মোয়াবের বাদশাহ ইগেস্নানকে খাজনা দেবার জন্য বনি-ইসরাইলরা তাকে পাঠিয়ে দিল। তিনি একহাত লম্বা দু’দিকে ধার দেওয়া ছোরা বানিয়ে তার কাপড়ের নিচে ডান উরুর সংগে বেঁধে নিলেন। তিনি গিয়ে মোয়াবের বাদশাহ ইগেস্নানকে সেই খাজনা দিলেন। বাদশাহ ইগেস্নান ছিলেন খুব মোটা। খাজনা দেবার পর যারা খাজনা বয়ে এনেছিল এহূদ তাদের বিদায় করে দিলেন, কিন্তু তিনি নিজে গিলগলের কাছে খোদাই করা পাথরগুলো পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসে বললেন, ‘মহারাজ, আপনাকে আমার একটা গোপন খবর দেবার আছে।’ বাদশাহ তাঁর লোকদের বললেন, ‘তোমরা চুপ কর’; এতে তাঁর লোকেরা তাঁর কাছে থেকে চলে গেল। তখন বাদশাহ তাঁর ছাদের ঠাণ্ডা ঘরে একা বসে ছিলেন, আর এহূদ তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনাকে আমার একটা খবর দেবার আছে; খবরটা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে।’
এই কথা শুনে বাদশাহ উঠে দাঁড়ালেন, আর এহূদ বাঁ হাত দিয়ে তাঁর ডান দিকের উরু থেকে ছোরাটা টেনে বের করে নিয়ে বাদশাহর পেটে সেটা ঢুকিয়ে দিলেন। বাঁট সুদ্ধ ছোরাটা পেটে ঢুকে গিয়ে চর্বিতে ঢাকা পড়ে গেল, কারণ এহূদ ছোরাটা টেরে বের করে নেননি। ছোরাটা পিছনের দিকে খানিকটা বের হয়ে ছিল। তারপর এহূদ বারান্দায় বের হয়ে এসে ঘরের দরজা টেনে দিয়ে তালা বন্ধ করে দিলেন। (কেরি: কবাট বন্ধ করিয়া কুলুপ লাগাইয়া দিলেন)। এহূদ চলে যাবার পর চাকরেরা এসে দেখল উপরের ঘরের দরজা তালা দেওয়া (কবাট বন্ধ)। তারা বলল, ‘নিশ্চয় তিনি ভিতরের ঘরে পায়খানায় গেছেন।’ তারা অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করল, কিন্তু তবুও তিনি দরজা খুলছেন না দেখে তারা লজ্জা ভেংগে চাবি এনে দরজা খুলে ফেলল। তারা দেখল তাদের মালিক মৃত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন।
চাকরেরা অপেক্ষা করবার সময় এহূদ পালিয়ে গিয়ে খোদাইকরা পাথরগুলো পিছনে ফেলে সিয়ীরাতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে আফরাহীমের পাহাড়ী এলাকায় তিনি সিংগা বাজালে বনি-ইসরাইলরা তাঁর সংগে পাহাড় থেকে নিচে নেমে এসে তাঁর পিছনে পিছনে চলল, কারণ তিনি তাদের হুকুম দিয়েছিলেন, ‘আমার পিছনে পিছনে এস; মাবুদ তোমাদের শত্রু মোয়াবীয়দের তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।’ কাজেই তারা তাঁর পিছনে পিছনে নেমে গিয়ে মোয়াবের কাছে জর্ডান নদীর যে জায়গাগুলো হেঁটে পার হওয়া যায় সেগুলো দখল করে নিল। তারা কাউকে সেই সব জায়গা দিয়ে পার হতে দিল না। সেই সময় তারা দশ হাজার মোয়াবীয়কে হত্যা করল। এই মোয়াবীয়রা সবাই স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তাদের একজন লোকও পালিয়ে যেতে পারেনি।’’ (কাজীগণ ৩/১২-২৯)
সুপ্রিয় পাঠক, এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) যীশু খ্রিষ্টই একমাত্র ত্রাণকর্তা নন! বাইবেলে আমরা এরূপ আরো অনেক ত্রাণকর্তা বা মাসীহের সন্ধান পাই।
(খ) বাইবেলীয় মসীহ বা ত্রাণকর্তারা কারো পরকালীন ত্রাণ করেন না। তাঁরা মূলত ঈশ্বরের প্রিয় প্রজাদেরকে জাগতিক পরাধীনতা বা কষ্ট থেকে ত্রাণ করেন।
(গ) ঈশ্বরের নির্বাচিত মসীহ বা ত্রাণকর্তা অকাতরে মিথ্যা বলছেন: ‘‘মহারাজ, আপনাকে আমার একটা গোপন খবর দেবার আছে।’’
(ঘ) তিনি অকাতরে আল্লাহর নামে মিথ্যা বলছেন: ‘‘আপনাকে আমার একটা খবর দেবার আছে; খবরটা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে।’’
(ঙ) যুদ্ধাবস্থা ছাড়াই তিনি একজন মানুষকে এভাবে গুপ্তহত্যা করছেন।
(চ) বাদশাহ ইগেস্নান কিভাবে ভিন্ন ধর্মের এক দেবতা বা মাবুদের কথা শোনার জন্য এত পাগল হলেন যে, শত্রু জাতির একজনের কাছ থেকে তা শোনার জন্য তাঁর দেহরক্ষীদের পর্যন্ত তাড়িয়ে দিলেন?
(ছ) এহুদ কিভাবে বাইরে অপেক্ষারত দেহরক্ষীদের অতিক্রম করলেন? এছাড়া বাহ্যত এহূদ ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করেছিলেন। এজন্যই রাজার দেহরক্ষীরা ভাবল যে, রাজা ভিতরের ঘরে পায়খানায় গেছেন! বাইরে থেকে তালা দেখলে তো তারা তড়িৎ প্রতিক্রিয়া দেখাত। ভিতর থেকে ঘর তালা বন্ধ করার পর এহূদ বেরোলেন কিভাবে? তিনি কি উড়ে গেলেন?
(জ) এহুদ আঠারো ইঞ্চি লম্বা একটা ছুরি তার উরুর সাথে কাপড়ের মধ্যে করে রাজার কাছাকাছি যেতে পারলেন কিভাবে? রাজার রক্ষীরা তাকে তল্লাশী করার সময় এই আকারের একটা ছুরি খুজে পেল না?