আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, বাইবেলের একজন প্রসিদ্ধ ভাববাদী, ত্রাণকর্তা ও বীর শাসনকর্তা ছিলেন শিমশোন বা হযরত শামাউন (Samson)। জন্মের পূর্বেই ঈশ্বরের দূতরা তাঁর পিতামাতাকে এ ত্রাণকর্তার জন্মের সুসংবাদ দেন। জন্ম থেকেই তাঁর পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর জন্য মদ এবং আংগুর রসের তৈরি সকল পানীয় পান নিষিদ্ধ করা হয়। (কাজীগণ ১৩ অধ্যায়)। তবে আমরা দেখেছি যে, বেশ্যাগমন ও ব্যভিচার তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল না (কাজীগণ ১৬/১-৪)।
ঈশ্বরের আত্মায়, মাবুদের রূহে বা পাক রূহে পরিপূর্ণ হয়ে তাঁর মানুষ খুনের কথা আমরা বলেছি। এখানে তাঁর হত্যাকাণ্ড-র সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখুন:
প্রথমত: যুদ্ধ বা হত্যাকাণ্ড-র প্রেক্ষাপট
‘‘পরে শামাউন তিমণায় গেলেন, সেখানে একটা ফিলিস্তিনি যুবতী তাঁর নজরে পড়ল। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি তাঁর মা-বাবাকে বললেন, ‘তিমণাতে একটা ফিলিস্তিনি মেয়ে দেখে এসেছি; তোমরা তার সংগে আমার বিয়ে দাও।’ জবাবে তাঁর মা-বাবা বললেন, ‘তোমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কিংবা আমাদের সমস্ত জাতির মধ্যে কি কোন মেয়ে নেই যে, বিয়ের জন্য তোমাকে খৎনা-না-করানো ফিলিস্তিনিদের কাছে যেতে হবে?’ কিন্তু শামাউন তাঁর বাবাকে বললেন, ‘না, আমার জন্য তাকেই তোমরা নিয়ে এস। তাকেই আমার পছন্দ।’ তাঁর মা-বাবা বুঝতে পারেন নি যে, এটা মাবুদ থেকেই হয়েছে, কারণ তিনি ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার একটা কারণ খুঁজছিলেন। সেই সময় ফিলিস্তিনীরা বনি-ইসরাইলদের শাসন করছিল।’’ (কাজীগণ ১৪/১-৪)
এখানে বাইবেল আমাদেরকে নতুন একটা বিষয় জানাচ্ছে, তা হল, যুদ্ধের জন্য ঈশ্বরের বা বাইবেল অনুসারীদের কোনো ‘কারণ’ বা অজুহাত লাগে! আমরা তো বহুবার দেখেছি যে, কোনো প্রকারের সামান্য কারণ, উস্কানি, ঘোষণা বা প্রেক্ষাপট ছাড়াই ঈশ্বরের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে ঈশ্বরের মনোনীত প্রজারা লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র, নিরপরাধ নারী, পুরুষ, শিশু ও প্রাণি হত্যা করছেন! ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রজারা একটা দেশ দখল করার বা কিছু মানুষ হত্যা করার ইচ্ছা করেছেন এটাই কি কারণ হিসেবে যথেষ্ট নয়? বাইবেলের অন্যান্য বক্তব্য থেকে তো আমরা তা-ই জানলাম।
সর্বাবস্থায়, ঐশ্বরিক হত্যা প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি যে, শামাউন উক্ত ফিলিস্তিনি মেয়েটাকে বিবাহ করেন। তিনি সহযাত্রী ত্রিশজন ফিলিস্তিনি যুবককে এ উপলক্ষ একটা ধাঁধা বলেন। তাঁর স্ত্রীর সহযোগিতায় কনে পক্ষের যুবকেরা তাঁর ধাঁধার জবাব বলে দেয়। তখন পাক রূহের প্রেরণায় তিনি বিনা উস্কানিতে ত্রিশ জন নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেন, তাদের সব কিছু লুট করেন এবং তাদের কাপড় চোপড়গুলো নিয়ে ধাঁধার উত্তরদানকারীদের প্রদান করেন। তারপর তিনি রাগে জ্বলতে জ্বলতে তাঁর বাবার বাড়িতে চলে গেলেন। (কাজীগণ ১৪/৮-১৯)
শামাউনের শ্বশুর ভাবলেন, শামাউন তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ করে চলে গেলেন। এজন্য তাঁর এক বন্ধুর সাথে তাকে বিয়ে দিলেন। পরে শামাউন শ্বশুর বাড়িতে যেয়ে স্ত্রী চাইলে শ্বশুর তার ওজর পেশ করেন এবং তার অন্য মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ‘‘পরে গম কাটবার সময় শামাউন একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে তাঁর স্ত্রীর সংগে দেখা করতে গেলেন। তিনি বললেন, ‘আমি ভিতরে আমার স্ত্রীর ঘরে যাচ্ছি।’ কিন্তু মেয়েটার পিতা তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দিল না। তার পিতা বলল, ‘আমি সত্যিই ভেবেছিলাম যে, তার প্রতি তোমার খুব ঘৃণা জন্মেছে, সেজন্য আমি তাকে তোমার বন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছি। তার ছোট বোন তার চেয়েও সুন্দরী; তার বদলে তুমি তার ছোট বোনকে নাও।’ তখন শামাউন তাদের বললেন, ‘এবার আমি ফিলিস্তিনীদের ক্ষতি করতে পারব, আর তাতে আমার কোন দোষ হবে না।’ (কাজীগণ ১৫/১-৩)
দ্বিতীয়ত: তিনশো শেয়াল এবং ক্ষেত-ফসল পুড়িয়ে ধ্বংস করা
‘‘এই বলে তিনি বেরিয়ে গিয়ে তিনশো শেয়াল ধরলেন এবং তাদের প্রতি জোড়ার লেজে লেজে জুড়ে তার মাঝখানে একটা করে মশাল বেঁধে দিলেন। তারপর মশালে আগুন ধরিয়ে ফিলিস্তিনীদের ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ফসলের মধ্যে তাদের ছেড়ে দিলেন। এভাবে তিনি তাদের বাঁধা আটি ও দাঁড়িয়ে থাকা ফসল এবং তাদের জলপাইয়ের বাগান পুড়িয়ে দিলেন।’’ (কাজীগণ ১৫/৪-৫)
এখানেও বাইবেলের যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা লক্ষণীয়। ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি করার জন্য ‘কারণ’ খুঁজে পেলেন শামাউন। পাঠক নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) শামাউনের ভয়ঙ্কর ক্রোধ ও রাগে জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি চলে যাওয়া থেকে তাঁর শ্বশুর বুঝলেন যে, শামাউন তার মেয়েকে ঘৃণা করে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে। এজন্য তিনি তাঁর এক বন্ধুর সাথে তাকে বিয়ে দিলেন। এ ভুল স্বীকার করে অন্য মেয়েকে তাঁর সাথে বিবাহের প্রস্তাবও দিলেন। এরপরও যদি এক্ষেত্রে অপরাধ হয়ে থাকে তবে অপরাধী শামাউনের শ্বশুর, তাঁর স্ত্রী ও বন্ধু। কিন্তু বাইবেলের ঈশ্বর, ভাববাদী শামাউন এবং বাইবেলের লেখক পবিত্র আত্মা সকলেই এ ভুল বা অপরাধকে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি করার বৈধ কারণ হিসেবে গণ্য করলেন।
(খ) ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি করার জন্য ঈশ্বর, ঈশ্বরের ভাববাদী বা পবিত্র আত্মা তিনশত শেয়াল পুড়িয়ে মারলেন! ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি করার জন্য এ নিরীহ প্রাণিগুলোকে পুড়িয়ে হত্যা না করলে কি হত না?
(গ) ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি করার বাইবেলীয় পদ্ধতি তাদের ক্ষেত-খামার ও ফল-ফসল পুড়িয়ে দেওয়া। বর্তমানে যুদ্ধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন, জেনেভা কনভেনশন ও সভ্য দেশগুলো এরূপ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করা কি অনুমোদন করে? মহাশক্তিধর শামাউন সিংহ মারতেন, গাধার চোয়াল দিয়ে এক হাজার মানুষ মারতেন! তিনি কি শেয়ালগুলো এবং ক্ষেতখামার না পুড়িয়ে অপরাধী ও যোদ্ধাদের হত্যা করে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি করতে পারতেন না?