৮. ১. অযৌক্তিক বিধিবিধান / ৮. ১. ১. কোরবানির নামে পশু পোড়ানো ও রক্ত মাখানো

পূর্ববর্তী দু’ অধ্যায়ে আমরা বাইবেলীয় অশোভনীয়তার মধ্য থেকে ঈশ্বর ও নবীদের প্রসঙ্গ এবং যীশু ও প্রেরিতদের প্রসঙ্গ আলোচনা করেছি। এ অধ্যায়ে আমরা বাইবেলীয় অযৌক্তিকতা ও অশালীনতার (Bible Absurdities, Vulgarities & Obscenities) অন্যান্য কয়েকটা দিক আলোচনা করব। উল্লেখ্য যে, এ অধ্যায়ের অধিকাংশ উদ্ধৃতি কিতাবুল মোকাদ্দস ২০০৬ থেকে গৃহীত।

৮. ১. অযৌক্তিক বিধিবিধান

বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান অনেক বিধান অযৌক্তিক বা অমানবিক বলে উল্লেখ করেছেন বাইবেল সমালোচকরা। আমরা নিম্নে কয়েকটা নমুনা উল্লেখ করছি:

৮. ১. ১. কোরবানির নামে পশু পোড়ানো ও রক্ত মাখানো

বাইবেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিধান পশু, পাখি ও শস্য কোরবানি বা উৎসর্গ করা। তবে লক্ষণীয় হল কোরবানিকৃত পশু বা শস্য পুড়িয়ে ফেলার বিধান। মানুষদেরকে খাওয়ানোর জন্য পশু-প্রাণি জবাই করা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মানুষের কল্যাণের কারণে তা পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত। তবে বাইবেলের কোরবানি মানুষের কল্যাণে নয়। জবাইকৃত প্রাণির রক্ত ছিটিয়ে এবং প্রাণিটাকে পুড়িয়ে গোনাহের কাফফারার জন্য। কয়েক প্রকার কোরবানি পুরোটাই পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আর কয়েক  প্রকার কোরবানির কিছু অংশ পুরোহিত বা যাজক (ইমাম) পাবেন এবং অবশিষ্ট পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আর যে কুরবানির মাংস খাওয়া যায় তাও কুরবানির দিনেই খেয়ে ফেলতে হবে: ‘‘কোরবানীর দিনেই তার মাংস খেয়ে ফেলতে হবে; পরের দিন সকাল পর্যন্ত তার কিছু রেখে দেওয়া চলবে না।’’ (লেবীয়: ২২/৩০) পাঠক যাত্রাপুস্তক ২৯/১০-২৮ এবং লেবীয় পুস্তকের ১ থেকে ৭ অধ্যায় পাঠ করলে বিভিন্ন প্রকারের কুরবানির বিস্তারিত নিয়ম জানতে পারবেন।

বাইবেলীয় কোরবানির মূল উদ্দেশ্য কোরবানির পশুর পোড়া মাংস ও চর্বির ঘ্রাণের দ্বারা ঈশ্বরকে খুশি করা। পবিত্র বাইবেলের অন্যতম নির্দেশনা: পুড়ানো পশুর সৌরভণ্ডখোশবুতে ঈশ্বর খুশি হন এবং এ কারণে মানুষের প্রায়শ্চিত্ত, কাফ্ফারা বা গোনাহ মাফ করেন। মহাপস্নাবনের পরে নোহ তাঁর জাহাজের মধ্যে বিদ্যমান সামান্য কিছু প্রাণির মধ্যে থেকে কয়েকটা পশু ও পাখি নিয়ে কোরবানি করে পুড়িয়ে ফেলেন: ‘‘মাবুদ সেই কোরবানীর খোশবুতে খুশি হলেন এবং মনে মনে বললেন, মানুষের দরুন আর কখনও আমি মাটিকে বদদোয়া দেব না... (আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ৮/২০-২১)।

এভাবে কয়েকটা পশু ও পাখির পোড়া চর্বি বা মাংসের খোশবুতে ঈশ্বর এত খুশি হলেন যে, আর কখনো মহাপস্নাবন দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।

বাইবেলে প্রায় অর্ধশত স্থানে বলা হয়েছে যে, পোড়ানো পশুর সুমিষ্ট স্বাদ-খোশবুতে (sweet savour/ pleasing to the Lord) ঈশ্বর খুশি হন। (আদিপুস্তক ৮/২১; যাত্রাপুস্তক ২৯/১৮; ২৯/২৫; ২৯/৪১; লেবীয় ১/৯; ১/১৩; ১/১৭; ২/২; ২/৯; ২/১২; ৩/৫; ৩/১৬; ৪/৩১; ৬/১৫; ৬/২১; ৮/২১; ৮/২৮; ১৭/৬; ২৩/১৩; ২৩/১৮; গণনাপুস্তক ১৫/৩; ১৫/৭; ১৫/১০; ১৫/১৩; ১৫/১৪; ১৫/২৪; ১৮/১৭; ২৮/২; ২৮/৬; ২৮/৮; ২৮/১৩; ২৮/২৪; ২৮/২৭; ২৯/২; ২৯/৬; ২৯/৮; ২৯/১৩; ২৯/৩৬; যিহিস্কেল ৬/১৯; ২০/৪১...।)

জবাইকৃত প্রাণির রক্ত ছিটানোর উদ্দেশ্য, রক্ত দেখে যেন ঈশ্বর আপন-পর চিনতে পারেন। ঈশ্বর বনি-ইসরাইলদের বলেন: ‘‘সেই সব ঘরের দরজার চৌকাঠের দু’পাশে এবং উপরে কিছু রক্ত নিয়ে লাগিয়ে দেবে ... তোমাদের ঘরে যে রক্ত লাগানো থাকবে সেটাই হবে তোমাদের চিহ্ন। আর আমি সেই রক্ত দেখে তোমাদের বাদ দিয়ে এড়িয়ে যাব..।’’ (যাত্রাপুস্তক/ হিজরত ১২/৭, ১৩, কি.মো.-২০০৬)

তাহলে ‘কোরবানি’-র উদ্দেশ্য পোড়া মাংসের খোশবু দিয়ে ঈশ্বরকে খুশি করা এবং রক্ত দেখিয়ে নিরাপত্তা পাওয়া। বাইবেলীয় কোরবানিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

(১) ‘burnt sacrifice/ burnt offering’: কেরি: ‘হোমবলি’, জুবিলী: ‘আহুতি’, বাইবেল-২০০০: পোড়ানো-উৎসর্গ এবং কিতাবুল মোকাদ্দস: ‘পোড়ানো কোরবানী’।

(২) ‘meat offering’: কেরি: ‘ভক্ষ্য নৈবেদ্য’, জুবিলী: ‘শস্য নৈবেদ্য’ এবং কি. মো.-২০০৬: শস্য কোরবানী, এবং বা.-২০০০ ও কি. মো.-২০১৩: ‘শস্য উৎসর্গ’।

(৩) ‘peace offering’: কেরি: ‘মঙ্গলার্থক বলি’, জুবিলী: ‘মিলন-যজ্ঞ’, বাইবেল-২০০০: যোগাযোগ উৎসর্গ, কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: যোগাযোগ কোরবানী এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: মঙ্গল কোরবানী।

(৪) ‘sin offering’: কেরি: পাপার্থক বলি, জুবিলী: পাপার্থে বলি, বাইবেল-২০০০: পাপ-উৎসর্গ, কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: গুনাহের জন্য কোরবানী ও কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: গুনাহ-কোরবানী।

(৫) ‘the trespass offering, কেরি: দোষার্থক বলি, জুবিলী: সংস্কার-বলি, বাইবেল-২০০০: দোষ-উৎসর্গ, কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: দোষের কোরবানী এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: দোষ-কোরবানী।

সকল কোরবানির ক্ষেত্রেই মূল উদ্দেশ্য উৎসর্গকৃত পশুকে পুড়িয়ে ঈশ্বরকে খুশি করা। এ বিষয়ক বাইবেলীয় একটা নির্দেশনা:

‘‘যদি সে গরু দিয়ে পোড়ানো কোরবানী (burnt sacrifice) দিতে চায় তবে সেটা হতে হবে একটা নিখুঁত ষাঁড়। মাবুদ যাতে তার উপর সন্তুষ্ট হন সেজন্য তাকে সেই ষাঁড়টা মিলন-তাম্বুর (জমায়েত-তাঁবুর: the tabernacle of the congregation) দরজার কাছে উপস্থিত হতে হবে। পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আনা সেই ষাঁড়টার মাথার উপরে সে তার হাত রাখবে; আর সেটা তার জায়গায় তার গুনাহ্ ঢাকবার জন্য কবুল করা হবে (atonement: কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্তরূপে। কি. মো.-২০১৩: ‘‘আর তা কাফফারা হিসেবে তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে)। তারপর মাবুদের সামনে সে ষাঁড়টা জবাই করবে আর হারুনের যে ছেলেরা ইমাম তারা তার রক্ত দিয়ে মিলন-তাম্বুর দরজার সামনে রাখা কোরবানগাহ্টার চারপাশের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। কোরবানীদাতা ঐ পোড়ানো-কোরবানীর ষাঁড়টার চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তার মাংস টুকরা টুকরা করে কাটবে। ইমাম হারুনের ছেলেরা সেই কোরবানগাহে্র উপরে আগুন জ্বালিয়ে তার উপর কাঠ সাজাবে। তারপর তারা কোরবানগাহে্র উপরকার জ্বলন্ত কাঠের উপরে সেই ষাঁড়ের মাথা, চর্বি ও মাংসের টুকরাগুলো সাজাবে। কোরবানীদাতা সেটার পা এবং পেটের ভিতরের সমস্ত অংশ পানিতে ধুয়ে দেবে এবং ইমাম সেগুলো সুদ্ধ গোটা ষাঁড়টাই কোরবানগাহে্র উপর পুড়িয়ে ফেলবে। এটা পোড়ানো-কোরবানী, আগুনে দেওয়া কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন  ....

মাবুদের উদ্দেশ্যে এই পোড়ানো কোরবানী যদি কোন পাখী দিয়ে দেওয়া হয় তবে কোরবানীদাতাকে একটা ঘুঘু বা কবুতর আনতে হবে। ইমাম সেটা কোরবানগাহের কাছে নিয়ে যাবে এবং তার মাথাটা মুচড়ে গলা থেকে আলাদা করে নিয়ে কোরবানগাহের উপরে পুড়িয়ে দেবে আর রক্তটা চেপে বের করে কোরবানগাহের একপাশের গায়ের উপর ফেলবে। কোরবানীদাতা পাখীটার গলার থলি ও তার মধ্যকার সব কিছু কোরবানগাহের পূর্বদিকে ছাইয়ের গাদায় ফেলে দেবে। সে ডানা ধরে পাখীটা এমনভাবে ছিঁড়বে যেন সেটা দুই টুকরা হয়ে যায়। তারপর ইমাম সেটা নিয়ে কোরবানগাহের উপরকার জ্বলন্ত কাঠের উপর পুড়িয়ে দেবে। এটা পোড়ানো কোরবানী, আগুনে দেওয়া কোরবানীর মধ্যে একটা, যার খোশবুতে মাবুদ খুশী হন।’’ (লেবীয় ১/৩-১৭)

বাইবেলে দু’শতাধিক স্থানে এভাবে ‘পোড়ানো কোরবানি’ করার নির্দেশনা রয়েছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণিকে এভাবে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে। যেমন শলোমন একদিনে ১০০০ পশু এভাবে ‘পোড়ানো কুরবানি’ দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। আর এতে ঈশ্বর এত খুশি হলেন যে, তাঁকে তাঁর প্রার্থিত সব কিছু প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। ‘‘সোলায়মান মাবুদকে মহববত করতেন, সেজন্য তাঁর বাবা দাউদের হুকুম অনুসারে চলাফেরা করতেন; কিন্তু তিনি এবাদতের উঁচু স্থানগুলোতে (বেদিগুলোতে) পশু কোরবানী দিতেন এবং ধূপ জ্বালাতেন। বাদশাহ একদিন পশু-কোরবানীর জন্য গিবিয়োনে গিয়েছিলেন, কারণ কোরবানীর জন্য সেখানকার এবাদতের উঁচু স্থানটা ছিল প্রধান। সোলায়মান সেখানে এক হাজার পশু দিয়ে পোড়ানো কোরবানী (burnt-offerings) দিলেন। গিবিয়োনে মাবুদ স্বপ্নের মধ্যে সোলায়মানের কাছে উপস্থিত হলেন। আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘তুমি আমার কাছে যা চাইবে আমি তা-ই তোমাকে দেব।’’ (১ বাদশাহনামা ৩/৩-৫)

অন্যত্র শলোমন একবারেই ২২ হাজার ষাঁড় ও এক লক্ষ ২০ হাজার ভেড়া  কোরবানি দেন। (১ বাদশাহনামা/রাজাবলি ৮/৬৩)

উপরে পাঠক ‘পোড়ানো কোরবানি’-র পদ্ধতি দেখলেন। পবিত্র বাইবেলে বিভিন্ন প্রকারের কোরবানির পদ্ধতি প্রায় একই: জবাইকৃত প্রাণি পুড়িয়ে ফেলা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরো প্রাণিটিকেই পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু অংশ ইমাম বা যাজকরা ভক্ষণ করবেন।

বাইবেলীয় কোরবানির ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, তা হল ৭ দিনের শাবককে কোরবানি করা। ‘‘তোমাদের গরু ও ভেড়ার বেলায়ও তা-ই করবে। সাত দিন পর্যন্ত তাদের বাচ্চাগুলো মায়ের কাছে থাকবে, তারপর আট দিনের দিন সেগুলো আমাকে দিয়ে দিতে হবে।’’ (হিজরত/যাত্রাপুস্তক ২২/২৯-৩০)

‘‘জন্মের পরে গরু, ভেড়া বা ছাগলের বাচ্চাকে তার মায়ের সংগে সাত দিন পর্যন্ত থাকতে দিতেই হবে। আট দিনের দিন থেকে সেগুলো মাবুদের উদ্দেশে আগুনে দেওয়া কোরবানী হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে।’’ (লেবীয় ২২/২৭)

অবলা পশু পোড়ানোয় ঈশ্বর এত খুশি হন যে, বড় বড় বিপদও এতে কেটে যায়। পশুটা যত ছোট ও দুগ্ধপোষ্য হবে তাকে পুড়ালে ঈশ্বর তত বেশি খুশি হবেন। বাইবেলে এ জাতীয় অনেক ঘটনা বিদ্যমান। একটা ঘটনা দেখুন:

‘‘বনি-ইসরাইলরা মিস্পাতে জমায়েত হয়েছে শুনে ফিলিস্তিনীদের শাসনকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য গেলেন। সেই কথা শুনে বনি-ইসরাইলরা ফিলিস্তিনীদের দারুন ভয় পেল। তারা শামুয়েলকে বলল, ‘আমাদের মাবুদ যেন ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করেন সেজন্য মাবুদের কাছে আপনি ফরিয়াদ জানাতে থাকুন। তখন শামুয়েল এমন একটা ভেড়ার বাচ্চা  নিলেন যেটা দুধ ছাড়েনি (একটা দুধ-খাওয়া বাচ্চা a sucking lamb), আর গোটা বাচ্চাটা দিয়ে তিনি মাবুদের উদ্দেশে একটা পোড়ানো-কোরবানী দিলেন। তিনি বনি-ইসরাইলদের হয়ে মাবুদকে ডাকলেন এবং মাবুদও তাঁকে জবাব দিলেন। শামুয়েল যখন পোড়ানো-কোরবানী দিচ্ছিলেন সেই সময় বনি-ইসরাইলদের সংগে যুদ্ধ করবার জন্য ফিলিস্তিনীরা এগিয়ে আসল। কিন্তু সেই দিন মাবুদ ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে বাজ পড়বার মত ভীষণ শব্দে গর্জন করে উঠলেন। তাতে ভয়ে তাদের দল ভেংগে গেল এবং তারা বনি-ইসরাইলদের কাছে হেরে গেল।’’ (১ শামুয়েল ৭/৭-১০)

সুপ্রিয় পাঠক, একটা দুগ্ধপোষ্য, কচি ছাগলের বাচ্চাকে কি আপনি এভাবে মেরে পুড়িয়ে ফেলতে পারবেন? নিজের, আত্মীয়দের বা দরিদ্রদের খাদ্যের জন্য নয়, শুধু ঈশ্বরকে খুশি করতে এরূপ দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাকে পুড়াতে হবে?