ইঞ্জিলের মধ্যে যীশুর নামে অনেক বক্তব্য রয়েছে যেগুলো খ্রিষ্টানরা বাস্তব জীবনে কখনোই পালন বা গ্রহণ করেন না। এজন্য সমালোচকরা আপত্তি করে বলেছেন যে, যারা বাইবেলকে ঈশ্বরের অভ্রান্ত বাণী বলে বিশ্বাস করেন তাদেরকে একটা বিষয় নিশ্চিত করতে হবে: হয় এগুলোকে সত্য বলে নিজেদের জীবনে পালন করতে হবে, অথবা এগুলো মিথ্যা বা খারাপ কথা হিসেবে মেনে নিতে হবে। এ জাতীয় অনেক উদ্ধৃতি সংকলন করে কিছু মন্তব্য করেছেন গ্যারি ডেভানি (Gary DeVaney) ‘যীশু কি মিথ্যা বলতেন?’ (Did Jesus Christ Lie?) প্রবন্ধে। এখানে কয়েকটা নমুনা পেশ করছি[1]:
(১) যীশু বলেন: ‘‘যার (তলোয়ার) নেই সে তার কোর্তা বিক্রি করে তলোয়ার ক্রয় করুক (and he that hath no sword, let him sell his garment, and buy one)’’। (লূক ২২/৩৬) গ্যারি লেখেছেন: “Did Jesus lie or are you an obedient Christian who personally owns a sword?” ‘‘যীশু কি মিথ্যা বলেছেন? নাকি আপনি ব্যক্তিগতভাবে একটা তরবারীর অধিকারী একজন অনুগত খ্রিষ্টান? ’’
(২) যীশু বলেন: ‘‘এই দুনিয়াতে কাউকেই পিতা বলে ডেকো না, কারণ তোমাদের একজনই পিতা আর তিনি বেহেশতে আছেন (call no man your father upon the earth: for one is your Father, which is in heaven) (মথি ২৩/৯, কি. মো.-০৬)।
গ্যারি বলেন: “Did Jesus lie when He commanded for you - a converted, believing Christian - to call no one on Earth your father? If you do call your male parent, your father, aren't you insisting that Jesus lied? If you call your male parent "father" are you truly a Christian? Why are Catholic Priests called "Father"?” ‘‘যীশু যখন আপনাকে- একজন ধর্মান্তরিত বিশ্বাসী খ্রিষ্টানকে, এ নির্দেশ দিলেন যে, পৃথিবীতে কাউকে ফাদার, পিতা বা বাবা বলে ডেকো না তখন কি তিনি মিথ্যা বললেন? যদি আপনি আপনার জন্মদাতাকে পিতা বলে সম্মোধন করেন তবে কি আপনি দাবি করলেন না যে, যীশুর এ কথাটা মিথ্যা? যদি আপনি আপনার জন্মদাতাকে পিতা বলে ডাকেন তবে কি আপনি সত্যই একজন খ্রিষ্টান? ক্যাথলিক যাজক বা ইমামদেরকে কেন ফাদার: পিতা বা বাবা ডাকা হয়?’’
(৩) যীশু বলেন, যোহন বাপ্তাইজক বা বাপ্তিস্মদাতা ইয়াহিয়াই এলিয় বা নবী ইলিয়াস (Elijah/ Elias) (মথি ১১/১২-১৪)। কিন্তু যোহন বাপ্তাইজক বা বাপ্তিস্মদাত ইয়াহিয়া নিজেই বলেন, তিনি ইলিয়াস নন (যোহন/ইউহোন্না ১/২১)।
গ্যারি বলেন: “Who lied - John the Baptist or Jesus Christ? Do you acknowledge and confirm that according to these 2 Bible C&Vs, either Jesus Christ or John the Baptist lied?” ‘‘কে মিথ্যা বললেন: যোহন বাপ্তাইজক/ইয়াহিয়া অথবা যীশু খ্রিষ্ট? আপনি কি স্বীকার ও নিশ্চিত করছেন যে, বাইবেলের অধ্যায় ও শ্লোক নম্বর নির্ধারিত এ দু’টা বক্তব্য অনুসারে হয় যীশু খ্রিষ্ট অথবা যোহন বাপ্তাইজক মিথ্যা বলেছেন?
(৪) যীশু বলেন, তোমাদের সকল সম্পদ বিক্রয় করে ভিক্ষা হিসেবে দান করে দাও (লূক ১২/৩৩)। খ্রিষ্টানরা কি এ কথাটা সত্য বলে বিশ্বাস করেন? তারা কি তাদের সকল সম্পদ বিক্রয় করে দান করে দিয়েছেন?
(৫) যীশু বলেন, সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশে যেমন অসম্ভব, তার চেয়েও অসম্ভব ধনী ব্যক্তির জন্য বেহেশতে যাওয়া: ‘‘আল্লাহর রাজ্যে ধনবানের প্রবেশ করার চেয়ে বরং সূচের ছিদ্র দিয়ে উটের যাওয়া সহজ।’’ (মার্ক ১০/২৫, মো.-০৬)।
খ্রিষ্টানরা কি একথা সত্য বলে বিশ্বাস করেন? ধনী খ্রিষ্টান ও প্রচারকরা কি এ কথা সত্য বলে বিশ্বাস করেন? না তারা মনে করেন যে, যীশু মিথ্যা বলেছেন?
(৬) যীশু বলেছেন যে, মানুষের পক্ষে নাজাত বা মুক্তি অর্জন অসম্ভব; শুধু ঈশ্বরই তা পারেন: ‘‘এতে সাহাবীরা আরও আশ্চর্য হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, তাহলে কে নাজাত পেতে পারে? ঈসা তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘মানুষের পক্ষে এটা অসম্ভব বটে, কিন্তু আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব নয়; তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব (with God all things are possible)’’ (মার্ক ১০/২৬-২৭, মো.-০৬)।
তাহলে নাজাত বা পরিত্রাণ একটা অসম্ভব বিষয়। বিশ্বাস বা কর্ম কোনো কিছু দ্বারাই কারো পক্ষে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো জন্যই তা সম্ভব নয়। কিন্তু খ্রিষ্টান প্রচারকরা ‘নাজাত খুবই সহজ’ এবং ‘যীশুকে বিশ্বাস করলেই পরিত্রাণ’, ‘যীশুই নাজাত দানকারী’ ইত্যাদি বলে পৃথিবীর মানুষদেরকে ধর্মান্তর করার চেষ্টা করছেন। গ্যারি বলেন: “Obviously, all Christians, who try to convert you, believe Jesus to be a liar concerning salvation.” ‘‘বাহ্যত সকল খ্রিষ্টান- যারা আপনাদেরকে ধর্মান্তর করতে চেষ্টা করছেন- তারা বিশ্বাস করেন যে, পরিত্রাণ বিষয়ে যীশু মিথ্যা বলেছেন।’’
(৭) যীশু বলেন: ‘‘পিতা কারো বিচার করেন না; কিন্তু বিচারের সমস্ত ভার পুত্রকে দিয়েছেন।’’ (যোহন/ ইউহোন্না ৫/২১-২২, মো.-১৩) এ থেকে প্রমাণিত হল যে, ঈশ্বর কারো বিচার করেন না; বরং সকল বিচারিক দায়িত্ব যীশুই পালন করেন। যীশুর এ কথাটা কি সত্য না মিথ্যা? যীশু বলেন: ‘‘আমি কারো বিচার করি না’’ (যোহন ৮/১৫)। তিনি বলেন: ‘‘আর যদি কেউ আমার কথা শুনে পালন না করে, আমি তার বিচার করি না, কারণ আমি দুনিয়ার বিচার করতে নয়, কিন্তু দুনিয়ার নাজাত করতে এসেছি।’’ (যোহন/ইউহোন্না ১২/৪৭, মো.-১৩) গ্যারি বলেন: “Which do you prefer to be a lie? No. Really! Which one?” ‘‘কোন বক্তব্যকে আপনি মিথ্যা বলে গণ্য করা অধিকতর শ্রেয় বলে মনে করছেন? কোনোটাই না? সত্যই? কোনটা?’’
(৮) যীশু বলেন, ‘‘তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা উপ্ড়ে দূরে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর দোজখে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। যদি তোমার ডান হাত তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা কেটে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর দোজখে যাওয়ার চেয়ে বরং একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল।’’ (মথি ৫/২৯-৩০, মো.-২০০৬)
কোনো খ্রিষ্টান প্রচারক কি এ নির্দেশটা পালন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন? না তিনি এটাকে মিথ্যা অথবা ভুল নির্দেশ বলে গণ্য করেন? যীশু ছাড়া অন্য কোনো ধর্মীয় নেতা যদি এরূপ ধর্ম প্রচার করতেন তবে খ্রিষ্টানরা নির্দেশটা কিভাবে মূল্যায়ন করতেন? গ্যারি বলেন: “Did Jesus lie? Well, you don't believe it enough to do it - do you? (Do not do it!)” ‘‘যীশু কি মিথ্যা বললেন? ঠিক আছে। অন্তত আপনি এটাকে পালনযোগ্য বলে তো বিশ্বাস করেন না? নাকি আপনি এ নির্দেশকে পালনযোগ্য বলে বিশ্বাস করেন? (কখনোই তা করবেন না!)’’
(৯) যীশু বলেন, ‘‘এই দুনিয়ার লোকদের বিচারের সময় এবার এসেছে, আর দুনিয়ার কর্তার হাত থেকে এখন প্রভুত্ব কেড়ে নেওয়া হবে (কেরি: এ জগতের অধিপতি বাহিরে নিক্ষিপ্ত হইবে)। আমাকে যখন মাটি থেকে উঁচুতে তোলা হবে তখন আমি সবাইকে আমার কাছে টেনে নেব।’’ (যোহন/ ইউহোন্না ১২/৩১-৩২, মো.-০৬)
গ্যারি বলেন: “How could this be accurate? Hasn’t Jesus already been “lifted up” and everyone is not ‘up’ there. Normally, doesn’t when mean ‘at the time’?” এ কথাটা কিভাবে সত্য হতে পারে? যীশুকে কি অনেক আগেই উুঁচতে তোলা হয়নি? কিন্তু এখনো সবাইকে তাঁর কাছে টানা হয়নি। সাধারণভাবে ‘যখন’ বলতে কি ‘সে সময়েই’ বুঝানো হয় না?’’
(১০) একজন পাপাচারিণী মহিলার বিষয়ে যীশু বলেন: ‘‘জেনা থেকে মন ফিরানোর জন্য আমি তাকে সময় দিয়েছিলাম কিন্তু সে মন ফিরাতে রাজী হয় নি। এজন্য আমি তাকে বিছানায় ফেলে রাখব, আর যারা তার সংগে জেনা করে তারা যদি জেনা থেকে মন না ফিরায় তবে তাদের ভীষণ কষ্টের মধ্যে ফেলব। তার ছেলেমেয়েদেরও আমি মেরে ফেলব। তাতে সব জামাতগুলো জানতে পারবে যে, আমিই মানুষের দিল ও মন খুঁজে দেখি। আমি কাজ অনুসারে তোমাদের প্রত্যেককে ফল দেব।’’ (প্রকাশিত বাক্য/ কালাম ২/২১-২৩, মো.-০৬)
খুবই কঠিন বিষয়! পাপীকে পাপের কারণে শাস্তি দেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যীশু তো বলেছেন যে, তিনি কারো বিচার করবেন না। তাঁর কোন কথাটা সত্য। সর্বোপরি পাপীর পাপের কারণে তার সন্তানদেরকে হত্যা করা!
গ্যারি ডেভানি বলেন: “Did Jesus lie when He said that He would also kill the Harlot's children? Would you, a saved Christian, assist Jesus Christ in killing someone's children?” ‘‘যীশু যখন বেশ্যার ছেলেমেয়েদেরকে হত্যার কথা বললেন তখন কি তিনি মিথ্যা বললেন? একজন ত্রাণপ্রাপ্ত খ্রিষ্টান হিসেবে কারো সন্তানকে হত্যা করার বিষয়ে আপনি কি যীশুকে সহযোগিতা করবেন?’’
(১১) যীশু বলেন: “What is of human-esteem is an abomination in the sight of God: মানুষের নিকট যা সম্মানিত ঈশ্বরের চোখে তা ঘৃণিত’’ (লূক ১৬/১৫)। মো.-০৬: ‘‘মানুষ যা সম্মানিত মনে করে আল্লাহর চোখে তা ঘৃণার যোগ্য’’। জুবিলী: ‘‘কেননা মানুষের দৃষ্টিতে যা মর্যাদার বিষয়, তা ঈশ্বরের চোখে ঘৃণার বস্ত্ত।
প্রিয় পাঠক, আপনি কি এ কথাটার সাথে একমত হতে পারবেন? মানুষ যা কিছু সম্মানিত মনে করে সবই ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ঘৃণিত? ধার্মিকতা, দানশীলতা, উদারতা, সততা, সামাজিক মর্যাদা সবই ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ঘৃণিত? ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সম্মানিত হওয়ার জন্য একজন বিশ্বাসীকে তাহলে মানব-ঘৃণিত হতে হবে? খ্রিষ্টান প্রচারকরা হয়ত নানাবিধ ব্যাখ্যা প্রদান করবেন, কিন্তু যীশুর কথাটা কেন তাদের ব্যাখ্যার মত হল না? যীশু কি কথাটা সুন্দর করে বলতে পারতেন না? গ্যারি ডেভানি বলেন: “What would mental-health experts say about this C&V?” ‘‘মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বাইবেলের এ শ্লোক বিষয়ে কি বলবেন?’’
(১২) যীশু বলেন: ‘‘আমি তোমাদের সহিত আর অধিক কথা বলিব না; কারণ এ জগতের অধিপতি (The ruler of this world) আসিতেছে, আর আমাতে তাহার কিছুই নাই।’’ কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘দুনিয়ার কর্তা আসছে। আমার উপর তার কোন অধিকার নেই।’’ (যোহন ১৪/২৯)
এ জগতের অধিপতি বা দুনিয়ার কর্তা (এ বিশ্বের শাসক: The ruler of this world) বলতে যীশু কাকে বুঝাচ্ছেন? শয়তানকে না ঈশ্বরকে? যদি শয়তানকে বুঝিয়ে থাকেন তবে সে কোথা থেকে কোথায় আসছে? এতদিন সে কোথায় ছিল? যীশুর সাথে শয়তানের তো কথাবার্তাও হয়েছিল। কাজেই নিশ্চিতভাবেই সে এ পৃথিবীতেই ছিল। ইয়োব বা আইউব পুস্তক থেকে জানা যায় যে, শয়তান মাঝে মাঝে ঈশ্বরের পুত্র বা ইবনুল্লাহগণের সাথে ঈশ্বরের সামনে হাজির হয়। (ইয়োব/ আইউব ১/৬ ও ২/১) ইবনুল্লাহদের সাথে ঈশ্বরের দরবারে হাজিরা দেওয়ার এ সময়টুকু বাদে বাকি সময় তো শয়তান দুনিয়াতেই থাকত। আর যদি যীশু চলেই গেলেন আর তারপর শয়তান আসল তবে যীশুর উপর তার কর্তৃত্ব না থাকার অর্থই বা কী?