নতুন নিয়মে কোথাও কোথাও যীশুর দয়ার্দ্রতা ও সুন্দর আচরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোথাও তাঁর এমন আচরণের কথা বলা হয়েছে যা অসৌজন্যমূলক। যেমন মথি ও মার্ক লেখেছেন যে, যীশু যখন শিষ্যদেরকে বলেন যে, তাঁকে দুঃখভোগ করে মরতে হবে, তখন তাঁর প্রিয়তম শিষ্য পিতর অনুযোগ করে বলেন, গুরু এরূপ না হউক। তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে পিতরকে বলেন: ‘‘আমার সম্মুখ হইতে দূর হও, শয়তান, তুমি আমার পথের বাঁধা; কেননা যা আল্লাহর, তা নয়, কিন্তু যা মানুষের, তা-ই তুমি ভাবছো।’’ (মথি ১৬/২৩, মো.-১৩; মার্ক ৮/৩৩)
এ বক্তব্য অনিয়ন্ত্রিত আচরণ ও অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের প্রকাশ, যা যীশুর মহান ব্যক্তিত্ব থেকে একেবারেই অনাকাঙিক্ষত, বিশেষত কোনো ধার্মিক মানুষকে বা সাধারণ মানুষকে ‘শয়তান’ বলে গালি দেওয়া।
অন্যত্র যীশু ইহুদি ধর্মগুরু ও পণ্ডিতদেরকেও এভাবে গালি দিয়েছেন। কেউ যদি মথির ২৩ অধ্যায় পাঠ করেন তবে যীশুর গালির বহর দেখবেন। যীশু ইহুদি ধর্মগুরুদেরকে অনেক কঠোর ভাষায় গালি দিয়েছেন ও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হা অধ্যাপক ও ফরীশীগণ, কপটরা, ধিক্ তোমাদিগকে!’ মো.-০৬: ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা (মথি: ২৩/১৩, ১৪, ১৫, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯), হা অন্ধ পথ-প্রদর্শকেরা, ধিক্ তোমাদিগকে!’ (মথি: ২৩/১৬), ‘অন্ধ ফরীশী’ (অন্ধ ফরীশীরা মথি: ২৩/২৬), ‘সর্পেরা, কালসর্পের বংশেরা’, মো.-০৬: সাপের দল আর সাপের বংশধরেরা (মথি: ২৩/৩৩)।
তিনি বারবারই বিরুদ্ধবাদীদেরকে ‘সাপের বংশধর’ (generation of vipers) বলে গালি দিয়েছেন (মথি ১২/৩৪; লূক ৩/৭; মথি ২৩/৩৩)। এছাড়া মূঢ়, মূর্খ, অন্ধ ইত্যাদি তাঁর বহুল ব্যবহৃত গালি: হে মূঢ়েরা, হে মূর্খরা, মূঢ়েরা ও অন্ধেরা: মূর্খ ও অন্ধের দল Ye fools/ Ye fools and blind (মথি: ২৩/১৬, ২৩/১৭, ২৩/১৯, লূক ১১/৪০)। এমনকি নিজের শিষ্যদেরকেও তিনি এভাবে মূঢ়েরা বা মূর্খরা (O fools) বলে সম্বোধন করেছেন (লূক ২৪/২৫)
অন্যায়ের প্রতিবাদ ধার্মিকদের দায়িত্ব। তবে বিরুদ্ধবাদীদের এভাবে গালি দেওয়া খুবই অসৌজন্যমূলক। এছাড়া কথাগুলো সাম্প্রদায়িক হানাহানির উৎস। কারণ ধর্মপ্রবর্তকের প্রতিটা কর্ম ও কথাই অনুসারীরা অনুকরণ করতে ভালবাসেন। যীশুর এ সকল কথাতে বিধর্মীদেরকে এভাবে গালি দেওয়া, অবজ্ঞা করা ও হেয় করে কথা বলা যীশুর অনুসারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক।
গ্যারি ডেভানি লেখেছেন যে, যীশু নিজেই বলেছেন: ‘‘যে কেউ আপন ভাইয়ের প্রতি ক্রোধ (angry) করে, সে বিচারের দায়ে পড়বে; আর যে কেউ আপন ভাইকে বলে, ‘রে নির্বোধ’, সে মহাসভার বিচারের দায়ে পড়বে; আর যে কেউ বলে, ‘রে মূঢ় (fool)’, সে দোজখের আগুনের দায়ে পড়বে।’’ (মথি ৫/২২) কিন্তু এর বিপরীতে যীশু নিজেই ‘ক্রোধ’ করেন: ‘‘তখন তিনি তাদের অন্তরের কঠিনতার করুন দুঃখিত হয়ে সক্রোধে (with anger) তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে সেই লোকটিকে বললেন...।’’ (মার্ক ৩/৫) এবং যীশু নিজেই অন্যদেরকে বারবার মূঢ় বা মূর্খ (fool) বলে উল্লেখ করছেন। এগুলো কি ‘‘আমার কথা শোন, আমার কাজ দেখ না’’ নীতির প্রকাশ? যীশুর বক্তব্য ও যীশুর বিষয়ে ইঞ্জিলের বর্ণনা উভয়ই যদি সঠিক হয় তবে আমাদের সকলের সাথে যীশুকেও মহাসভার দায়ে পড়তে হবে এবং অগ্নিময় নরকেই থাকতে হবে![1]
এরূপ ক্রোধের প্রকাশ আমরা দেখি ধর্মধাম বা শলোমনের মন্দির (মসজিদে আকসা) পরিষ্কার করার ঘটনায়। ‘‘ইহুদিদের উদ্ধার-ঈদের সময় কাছে আসলে পর ঈসা জেরুজালেমে গেলেন। তিনি সেখানে দেখলেন, লোকেরা বায়তুল মোকাদ্দসের মধ্যে গরু, ভেড়া আর কবুতর বিক্রি করছে এবং টাকা বদল করে দেবার জন্য লোকেরাও বসে আছে। এই সব দেখে তিনি দড়ি দিয়ে একটা চাবুক তৈরী করলেন, আর তা দিয়ে সমস্ত গরু, ভেড়া এবং লোকদেরও সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। টাকা বদল করে দেবার লোকদের টাকা-পয়সা ছড়িয়ে দিয়ে তিনি তাদের টেবিলগুলো উল্টে ফেললেন।’’ (যোহন/ ইউহান্না: ২/১৩-১৫, মো.-০৬)
কী কঠিন ক্রোধে যীশু এ কাজ করেছিলেন তা অনুধাবন করতে পাঠক একটু কল্পনা করুন। সকল খ্রিষ্টান চার্চের মধ্যে ও পাশে এবং আমাদের দেশেও ঈদ এবং ওয়ায মাহফিলের মাঠের মধ্যে বা পাশে অনুষ্ঠান বা পর্বের সময়ে বিস্কুট, চকলেট ও সাধারণ পণ্যের দোকান বসে। আপনি যদি দোকানগুলো ভেঙে দেন, টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে ছড়িয়ে দেন তবে প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? এবং কাজটা আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? মানুষের এভাবে হঠাৎ কষ্ট না দিয়েও কি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যেত না?
এরূপ আচরণের খারাপ প্রভাব বিশ্বাসী বা ভক্তের উপর পড়তে পারে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিটলার। তিনি একজন বিশ্বাসী খ্রিষ্টান হিসেবে যীশুকে তার অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এ ঘটনা-ই তার কর্মকাণ্ডর ভিত্তি বলে জানান। ১২ এপ্রিল ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার বক্তৃতায় বলেন:
“My feelings as a Christian points me to my Lord and Savior as a fighter. It points me to the man who once in loneliness, surrounded only by a few followers, recognized these Jews for what they were and summoned men to fight against them and who, God's truth! was greatest not as a sufferer but as a fighter. In boundless love as a Christian and as a man I read through the passage which tells us how the Lord at last rose in His might and seized the scourge to drive out of the Temple the brood of vipers and adders. How terrific was His fight for the world against the Jewish poison. To-day, after two thousand years, with deepest emotion I recognize more profoundly than ever before in the fact that it was for this that He had to shed His blood upon the Cross. As a Christian I have no duty to allow myself to be cheated, but I have the duty to be a fighter for truth and justice.... And if there is anything which could demonstrate that we are acting rightly it is the distress that daily grows. For as a Christian I have also a duty to my own people.... When I go out in the morning and see these men standing in their queues and look into their pinched faces, then I believe I would be no Christian, but a very devil if I felt no pity for them, if I did not, as did our Lord two thousand years ago, turn against those by whom to-day this poor people is plundered and exploited. "
‘‘একজন খ্রিষ্টান হিসেবে আমার অনুভূতি আমাকে শিক্ষা দেয় যে, আমার প্রভু ও ত্রাণকর্তা একজন যোদ্ধা ছিলেন। তা আমাকে শেখায়, সামান্য কয়েকজন শিষ্য পরিবেষ্টিত একজন একাকী মানুষ এ সকল ইহুদি কী তা চিনতে পেরেছিলেন। তিনি মানুষদেরকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আহবান করেছিলেন। এবং ঈশ্বরের সত্য হল তিনি যোদ্ধা হিসেবে সবচেয়ে বড় ছিলেন, যাতনা ভোগকারী হিসেবে নন। একজন মানুষ হিসেবে এবং একজন খ্রিষ্টান হিসেবে আমি সীমাহীন ভালবাসা নিয়ে সে কথাগুলো পাঠ করি, যেগুলো বলে যে, শেষ পর্যন্ত প্রভু কিভাবে তাঁর ক্ষমতায় উত্থিত হলেন এবং চাবুক তুলে নিলেন মন্দির থেকে কালসর্পের বাচ্চা ও সর্পের বংশধরদেরকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ইহুদি বিষ থেকে বিশ্বকে মুক্ত করতে তাঁর যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। দু হাজার বছর পরে, আজ, গভীরতম আবেগ দিয়ে আমি অনুভব করছি- পূর্বের যে কোনো সময় থেকে অধিক প্রগাঢ়ভাবে- এ জন্যই তিনি ক্রুশের উপরে নিজের রক্ত ঢেলেছিলেন। একজন খ্রিষ্টান হিসেবে নিজেকে প্রতারিত হতে দেওয়ার কোনো দায়িত্ব আমার নেই। বরং আমার দায়িত্ব হল সত্য ও ন্যায়ের জন্য আমাকে যোদ্ধা হতে হবে। দৈনন্দিন ক্রমবর্ধমান বেদনাই প্রমাণ করছে যে, আমরা সঠিকভাবে কর্ম করছি। কারণ একজন খ্রিষ্টান হিসেবে আমার নিজের জনগণের প্রতিও আমার দায়িত্ব আছে। ... যখন আমি সকালে বের হই, লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে দেখি এবং তাদের ক্লিষ্ট মুখগুলো দেখি তখন আমি বিশ্বাসে বলীয়ান হই যে, আমি যদি এদের জন্য বেদনা অনুভব না করি, দু হাজার বছর আগে আমাদের প্রভু যেভাবে যাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, যাদের দ্বারা আজ এ সকল দরিদ্র মানুষ লুণ্ঠিত ও শোষিত সেই ইহুদিদের বিরুদ্ধে যদি সেভাবে না দাঁড়াই তবে আমি খ্রিষ্টান নই; বরং একান্তই শয়তান।’’[2]
বিশ্বাসী খ্রিষ্টান হিসেবে শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও হিটলার যীশুর অনুসরণ করেছেন। তিনিও ইহুদিদেরকে ‘সাপ’ (vipers/ adders) বলেই আখ্যায়িত করেছেন।
[2] http://www.nobeliefs.com/DarkBible/ darkbible6.htm; www.adolfhitler.ws/