দাউদের পুত্র অবশালোম অম্মোনকে হত্যা করার পর এক পর্যায়ে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। পিতাকে তাড়িয়ে যিরুশালেম ও রাজপ্রাসাদ দখল করার পরে তিনি পিতার স্ত্রীদেরকে পাইকারিভাবে ধর্ষণ করেন। আমরা আগেই দেখেছি, দাউদের ব্যভিচার ও ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ঈশ্বর বিধান দেন যে, প্রকাশ্য জনসম্মুখে দাউদের স্ত্রীদেরকে ধর্ষণ করা হবে। আর এ ঐশ্বরিক রায় কার্যকর করার দায়িত্ব নিলেন অবশালোম। রাজ প্রাসাদের ছাদে তাঁবু খাটিয়ে সকলের সামনে তিনি এ ধর্ষণোৎসব চালান: ‘‘পরে লোকেরা অবশালোমের জন্য প্রাসাদের ছাদে একটা তাঁবু স্থাপন করলো, তাতে অবশালোম সমস্ত ইসরাইলের সাক্ষাতে তার পিতার উপপত্নীদের কাছে গমন করল।’’ (২ শমূয়েল ১৬/২২, মো.-১৩)
ঈশ্বরের পুত্র ও প্রথম পুত্র ইসরাইল বা ইয়াকুব এবং ঈশ্বরের পুত্র ও জাত-পুত্র দাউদ। উভয়ের পুত্রই পিতার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করেন। তবে তিন দিক থেকে দাউদের পুত্র অবশালোম ইয়াকুবের পুত্র রুবেনকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন: (১) অবশালোম তার পিতা দাউদের সকল উপপত্নীর সাথে ব্যভিচার করেছেন; কিন্তু রুবেন তাঁর পিতা যাকোবের একটা মাত্র উপপত্নীর সাথে ব্যভিচার করেন। (২) অবশালোম ইসরাইল বংশের সকলের দৃষ্টির সামনে পিতার পত্নীদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হন, অথচ রুবেন গোপনে ব্যভিচারে লিপ্ত হন। (৩) অবশালোম তার পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং বনি-ইসরইলের বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করতে সক্ষম হন। (২ শমূয়েল ১৮/১-৭)
লক্ষণীয় যে, দাউদ এজন্য কষ্ট পেয়েছেন বলে বাইবেল উল্লেখ করে নি। অবাধ্য ও পাপী পুত্রের এতসব অপরাধের পরেও দাউদ তাকে হত্যা না করার জন্য তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। এরপরও যুদ্ধে অবশালোম নিহত হন। হত্যার সংবাদ শুনে দাউদ অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে কাঁদাকাটি করতে থাকেন। (২ শমূয়েল ১৮/৮-৩৩)
পাঠক, লক্ষ্য করুন, দাউদ নিজের কলঙ্ক গোপনের জন্য নির্বিকার চিত্তে ঊরিয়কে হত্যা করালেন, কিন্তু নিজের স্ত্রীদেরকে ধর্ষণকারী ও ২০ হাজার ইসরাইলীয়ের হত্যাকারী পুত্র অবশালোমকে হত্যা করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। পবিত্র হৃদয় নিষ্পাপ ঊরিয়ের হত্যার সংবাদে নির্বিকার অথবা আনন্দিত চিত্ত ঈশ্বরের পুত্র ও খ্রিষ্ট দাউদ মহা-অপরাধী পুত্রের হত্যার সংবাদে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন।
আমরা দেখেছি যে, বাইবেল নিজের পিতার স্ত্রীকে এবং সহোদরা, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় বোনকে বিবাহ করা ও শয়ন করা নিষিদ্ধ করেছে এবং এরূপ কুরুচিপূর্ণ কর্মের জন্য মৃত্যুদণ্ড-র বিধান দিয়েছে। কিন্তু তৌরাত প্রতিষ্ঠাকারী ভাববাদীরা তাঁদের নিজেদের ও সন্তানদের ক্ষেত্রে কোনো বিধানই প্রয়োগ করছেন না। কিন্তু অসহায় সাধারণ মানুষদেরকে সামান্য অপরাধে পাথর মেরে হত্যা করছেন।
দাউদ তাঁর ধর্ষক পুত্র অবশালোমের নিরাপত্তার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও সে নিহত হয়। দাউদ তার জন্য মহাশোক করেন। তবে ধর্ষিতা স্ত্রীদের জন্য কোনো মমতা তো দেখালেন না; উপরন্তু তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। ‘‘দাউদ জেরুজালেমে তাঁর নিজের বাড়ীতে ফিরে আসলে পর যে দশজন উপস্ত্রীকে তিনি রাজবাড়ী দেখাশোনা করবার জন্য রেখে গিয়েছিলেন তাদের তিনি একটা বাড়ীতে রাখলেন এবং বাড়ীটা পাহারা দেবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি তাদের খাওয়া-পরা দিলেন, কিন্তু আর তাদের সংগে থাকলেন না। সেখানে তারা বিধবা হিসেবে মৃত্যু পর্যন্ত আটক থাকল।’’ (২ শামুয়েল/শমূয়েল ২০/৩, মো.-০৬)
কী অপূর্ব বাইবেলীয় ধার্মিকতা ও ন্যায় বিচার! ধর্ষকের শাস্তির বদলে প্রতিরক্ষা! আর অসহায় ধর্ষিতাদের শাস্তি ও আমরণ কারাবাস!
বাইবেলীয় ঈশ্বরের বিধানও লক্ষণীয়। পিতামাতার ব্যভিচারের অপরাধে জারজ সন্তানের দশম পুরুষ পর্যন্ত সদাপ্রভুর সমাজে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিধান দিচ্ছেন। অথচ ব্যভিচারী ও ধর্ষকদেরকে সদাপ্রভুর সমাজের প্রধান পুরোহিত বানাচ্ছেন।
বাইবেলীয় ভাববাদীদের ব্যভিচার-প্রিয়তা বা ব্যভিচার-সহনশীলতার আরেকটা ঘটনা। তালুতের বিরুদ্ধে দাউদের যুদ্ধের সময় তালুতের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন অব্নের (Abner)। তিনি তালুতের এক স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করতেন। তালুতের পুত্র ঈশ্বোশৎ (Ishbosheth) এ বিষয়ে আপত্তি করে তাকে বলেন: ‘‘তুমি আমার পিতার উপপত্নীর কাছে কেন গমন করেছ?’’ (২ শমূয়েল ৩/৭)। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে অব্নের-এর পক্ষ ত্যাগ করে দাউদের পক্ষে গমন করেন। দাউদ এ ব্যভিচারীকে তৌরাত নির্ধারিত শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা নির্বিচারেই দলে গ্রহণ করেন।
সম্মানিত পাঠক, মুসলিমদের বিশ্বাসে এবং মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থের বর্ণনায় দাউদ (আ.) আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবী, ধার্মিক ও রাজা ছিলেন। ইহুদি ও খ্রিষ্টানরাও দাউদকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধার্মিক নবী ও রাজা বলে গণ্য করেন। এনকার্টা লেখেছে:
“David was a valiant warrior and an outstanding leader. He displayed unfailing religious devotion and epitomized the courage and aspirations of his people, the prophets of whom came inevitably to regard him as the type of the promised Messiah. In both the Old Testament and New Testament, the Messiah is referred to as the Son of David.”
‘‘দাউদ ছিলেন একজন বিক্রমশালী যোদ্ধা ও বিশিষ্ট নেতা। তিনি অন্তহীন ধর্মীয় ঈশ্বরভক্তি প্রদর্শন করেন এবং তাঁর জাতির আকাঙ্খা ও সাহসের প্রতীক ছিলেন। এজন্য তাঁর জাতির নবীরা এসে অবশ্যম্ভাবীভাবে তাঁকে প্রতিশ্রুত খ্রিষ্টের একটা প্রকরণ হিসেবেই গণ্য করেছেন। পুরাতন ও নতুন নিয়মে, উভয় অংশেই খ্রিষ্টকে দাউদের সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।’’[1]
বাইবেলে দাউদকে ইহুদি জাতির রাজনৈতিক ত্রাণকর্তা ও ইহুদি রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘বিক্রমশালী যোদ্ধা’ হিসেবে আমরা ঠিকই দেখতে পাই। ‘অন্তহীন ধর্মীয় ঈশ্বরভক্তি’-র নমুনা হিসেবে আমরা দেখি যে, তিনি তৌরাত ও মূসা (আ.)-এর শরীয়ত পূর্ণাঙ্গ পালনের জন্য তাকিদ দিচ্ছেন। কিন্তু সেগুলোর পাশাপাশি উপরের বর্ণনাগুলোও বাইবেলেই বিদ্যমান। এ সকল বর্ণনা ‘অন্তহীন ধর্মীয় ঈশ্বরভক্তি’ প্রমাণ করে কি না তা পাঠকই বিবেচনা করবেন। এ ছাড়া শত্রুদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে তিনি কোনোভাবেই সততা বা মানবতার পরিচয় দেননি। নির্বিচার শত্রুহত্যা, শত্রুপক্ষের নিরীহ জনগণ হত্যা ও নির্যাতন করে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা ছিল তাঁর সাধারণ কর্ম। পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্ভবত এগুলো ‘অন্তহীন ধার্মিকতা ও ঈশ্বরভক্তি’-র সাথে সাংঘর্ষিক নয়।