৬. ২. ১১. ৪. দাউদের ব্যভিচার, ধর্ষণ ও হত্যা

‘ইবনুল্লাহ’ এবং ‘মাসীহুল্লাহ’ দাউদকে বাইবেল ধর্ষক ও খুনি বলে চিত্রিত করেছে। বাইবেল বলছে যে, দাউদের অনেকগুলো স্ত্রী ও উপ-স্ত্রী ছিল। রাজত্ব লাভের আগেই দাউদের স্ত্রীদের সংখ্যা ছিল ৬ জন (২ শামুয়েল ৩/২-৫)। এরপর দাউদ আরো অনেক বিয়ে করেন: ‘‘দাউদ হেবরন ছেড়ে জেরুজালেমে গিয়ে আরও স্ত্রী ও উপস্ত্রী গ্রহণ করলেন’’ (২ শামুয়েল ৫/১৩)। এত স্ত্রী থাকার পরেও বৎশেবা (Bathsheba) নামক তাঁর এক প্রতিবেশিনীকে এক নজর দেখেই তাকে ধর্ষণ করার জন্য পাগল হয়ে গেলেন! এরপর নিজের পাপ গোপন করতে হত্যায় লিপ্ত হলেন!

‘‘পরে বসন্তকাল ফিরে আসলে বাদশাহ্রা যখন যুদ্ধে গমন করেন তখন দাউদ যোয়াবকে, তাঁর সঙ্গে তাঁর গোলামদের ও সমস্ত ইসরাইলকে পাঠালেন; তারা গিয়ে অম্মোনীয়দের সংহার করে রববা নগর অবরোধ করলো; কিন্তু দাউদ যেরুশালেমে থাকলেন। একদিন বিকালে দাউদ বিছানা থেকে উঠে রাজপ্রাসাদের ছাদে বেড়াচ্ছিলেন, আর ছাদ থেকে দেখতে পেলেন যে, একটি স্ত্রীলোক গোসল করছে; স্ত্রীলোকটি দেখতে বড়ই সুন্দরী ছিল। দাউদ তার বিষয় জিজ্ঞাসা করতে লোক পাঠালেন। এক জন বললো, এ কি ইলিয়ামের কন্যা, হিট্টিয় ঊরিয়ের স্ত্রী বৎশেবা নয়? তখন দাউদ দূত পাঠিয়ে তাকে আনালেন এবং সে তার কাছে আসলে দাউদ তার সঙ্গে শয়ন করলেন; সেই স্ত্রীলোকটি মাসিকের নাপাকীতা থেকে পাকসাফ হয়েছিল। পরে সে তার ঘরে ফিরে গেল। এর পর সে গর্ভবতী হল; আর লোক পাঠিয়ে দাউদকে এই সংবাদ দিল, আমি গর্ভবতী হয়েছি।

তখন দাউদ যোয়াবের কাছে লোক পাঠিয়ে এই হুকুম করলেন, হিট্টিয় ঊরিয়কে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। তাতে যোয়াব দাউদের কাছে ঊরিয়কে পাঠিয়ে দিলেন। ঊরিয় তাঁর কাছে উপস্থিত হলে দাউদ তাকে যোয়াবের, লোকদের ও যুদ্ধের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। পরে দাউদ ঊরিয়কে বললেন, তুমি তোমার বাড়িতে গিয়ে পা ধোও। তখন ঊরিয় রাজপ্রাসাদ থেকে বের হল, আর বাদশাহর কাছ থেকে তার পেছন পেছন ভেট গেল। কিন্তু ঊরিয় তার প্রভুর গোলামদের সঙ্গে রাজপ্রাসাদের দ্বারে শয়ন করলো, নিজের বাড়িতে গেল না। পরে এই কথা দাউদকে বলা হল যে, ঊরিয় ঘরে যায় নি। দাউদ ঊরিয়কে বললেন, তুমি কি পথভ্রমণ করে আসো নি? তবে কেন নিজের বাড়িতে গেল না? ঊরিয় দাউদকে বললো, শরীয়ত-সিন্দুক, ইসরাইল ও এহুদা কুটিরে বাস করছে এবং আমার মালিক যোয়াব ও আমার মালিকের গোলামেরা খোলা মাঠে ছাউনি করে আছেন; সে অবস্থায় আমি কি ভোজন-পান করতে ও স্ত্রীর সঙ্গে শয়ন করতে নিজের বাড়িতে যেতে পারি? আপনার জীবন ও আপনার জীবন্ত প্রাণের কসম, আমি এমন কাজ করবো না।

তখন দাউদ ঊরিয়কে বললেন, আজকের দিনও তুমি এই স্থানে থাক, আগামীকাল তোমাকে বিদায় করবো। তাতে ঊরিয় সে দিন ও পরের দিন জেরুশালেমে রইলো। আর দাউদ তাকে দাওয়াত করলে সে তাঁর সাক্ষাতে ভোজন- পান করলো; আর তিন তাকে মাতাল করলেন; কিন্তু সে সন্ধ্যাবেলা তার প্রভুর গোলামদের সঙ্গে তার বিছানায় শয়ন করার জন্য বাইরে গেল, বাড়িতে গেল না।

খুব ভোরে দাউদ যোয়াবের কাছে একটি পত্র লিখে ঊরিয়ের হাতে দিয়ে পাঠালেন। পত্রখানিতে তিনি লিখেছিলেন, তোমরা এই ঊরিয়কে তুমুল যুদ্ধের সম্মুখে নিযুক্ত কর, পরে এর পিছন থেকে সরে যাবে, যাতে সে আহত হয়ে মারা পড়ে। পরে নগর অবরোধ করার সময় কোন্ স্থানে বিক্রমশালী লোক আছে তা জেনে যোয়াব সেই স্থানে ঊরিয়কে নিযুক্ত করলেন। পরে নগরস্থ লোকেরা বের হয়ে যোয়াবের সঙ্গে যু্দ্ধ করলে কয়েক জন লোক, দাউদের গোলামদের মধ্যে কয়েক জন মারা পড়লো, বিশেষত হিট্টিয় ঊরিয়ও মারা পড়লো। পরে যোয়াব লোক পাঠিয়ে যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত দাউদকে জানালেন। ... আর ঊরিয়ের স্ত্রী তাঁর স্বামী ঊরিয়ের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে স্বামীর জন্য শোক করতে লাগল। পরে শোক করার সময় অতীত হলে দাউদ লোক পাঠিয়ে তাঁকে তাঁর বাড়িতে আনালেন, তাতে সে তাঁর স্ত্রী হল ও তাঁর জন্য পুত্র প্রসব করলো। কিন্তু দাউদের কৃত এই কাজ মাবুদের দৃষ্টিতে মন্দ বলে গণ্য হল।’’ (২ শমূয়েল ১১/১-২৭, মো.-১৩)

পাঠক ভাল করে উপরের বক্তব্য পাঠ করে দুজনের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, বিশ্বাস ও সততা বিচার করুন। প্রথম ব্যক্তি অতি সাধারণ একজন বিশ্বাসী ঊরিয়। তিনি একজন বিবাহিত মানুষ, দীর্ঘকাল যুদ্ধের ময়দান থেকে একটা সুযোগে ফিরে এসেছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর নিকট যাচ্ছেন না। স্বাভাবিক ও বৈধ জৈবিক চাহিদাকে তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, দাউদের প্রতি ভক্তি ও সেনাপতির প্রতি ভালবাসার কারণে নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেনাপতি ও রাজার দাসদেরকে যুদ্ধের ময়দানে রেখে নিজে স্ত্রীর সাথে ফুর্তি করবেন না বলে শপথ করছেন। দাউদ তাকে যথাসাধ্য বেশি পরিমাণ মদ পান করিয়ে মত্ত করেছেন। মত্ত অবস্থাতেও তিনি তাঁর বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও শপথ ভুলে যান নি।

দ্বিতীয় ব্যক্তি রাজা দাউদ। তিনি বাইবেলীয় ‘ইবনুল্লাহ’ ও ‘মাসীহুল্লাহ’: ঈশ্বরের পুত্র ও খ্রিষ্ট। তাঁর অনেকগুলো স্ত্রী ও উপ-স্ত্রী বিদ্যমান। তিনি ইচ্ছামত তাদের সাহচর্য উপভোগ করছেন। তিনি বাড়ির ছাদে উঠে প্রতিবেশী এক নারীকে সণান করতে দেখেই এমন অস্থির হলেন যে, তৎক্ষণাৎ তাকে ডেকে এনে ধর্ষণ করলেন। মহিলা গর্ভবতী হয়েছে জেনে নিজের কলঙ্ক গোপন করতে তার স্বামীকে ডেকে আনালেন। সর্বশেষ স্বামীকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করলেন। ধর্ষণ ও হত্যা একত্রে!

একজন সাধারণ পাপাচারি মধ্যবয়স্ক মানুষ, যার অর্ধশতাধিক স্ত্রী বিদ্যমান, তিনি একজন মহিলাকে একনজর দেখেই তাকে ধর্ষণ করতে ব্যস্ত হবেন এবং তাঁর স্বামীকে হত্যা করবেন?

লক্ষণীয় যে, এত বড় মহাপাপ দাউদ নির্বিকার চিত্তেই করছেন। সামান্যতম বিকার বা বিবেকের দংশন নেই। বাইবেলের বর্ণনায় নাথন ভাববাদী এসে উদাহরণের মাধ্যমে দাউদকে তাঁর পাপের বিষয় বুঝিয়ে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দাউদ বিষয়টিকে কোনোভাবেই পাপ বা অন্যায় বলে কল্পনাও করেননি! এই কি ভাববাদী, নবী, ঈশ্বরের পুত্র ও ঈশ্বরের খ্রিষ্টের প্রকৃতি? (২ শমূয়েল ১২/১-১৪)

এবার আমরা এ মহাপাপের জন্য বাইবেলীয় ঈশ্বরের ব্যবস্থা পর্যালোচনা করি। ‘‘তুমি কেন মাবুদের কালাম তুচ্ছ করে তাঁর দৃষ্টিতে যা মন্দ তা-ই করেছ? তুমি হিট্টিয় ঊরিয়কে তলোয়ার দ্বারা আঘাত করিয়েছ ও তার স্ত্রীকে নিয়ে নিজের স্ত্রী করেছ, অম্মোনীয়দের তলোয়ার দ্বারা ঊরিয়কে মেরে ফেলেছ। অতএব তলোয়ার কখনও তোমার কুলকে ছেড়ে যাবে না ... তোমার সাক্ষাতে তোমার স্ত্রীদেরকে নিয়ে তোমার আত্মীয়কে দেব; তাতে সে এই সূর্যের সাক্ষাতে তোমার স্ত্রীদের সঙ্গে শয়ন করবে। বস্ত্তত তুমি গোপনে এই কাজ করেছ, কিন্তু আমি সমস্ত ইসরাইলের সাক্ষাতে ও দিনের আলোতে এই কাজ করবো। ... কিন্তু এই কাজ দ্বারা আপনি মাবুদের দুশমনদের নিন্দা করার বড় সুযোগ দিয়েছেন, এজন্য আপনার নবজাত পুত্রটি অবশ্য মারা যাবে। (২ শমূয়েল ১২/৯-১৪, মো.-১৩)

দাউদ বাইবেলের ‘দশ-আজ্ঞা’-র তিনটা ‘আজ্ঞা’ একত্রে লঙ্ঘন করেছেন: (১) খুন কোরো না, (২) জেনা কোরো না, (৩) অন্যের ঘর-দুয়ার, স্ত্রী, গোলাম ... কিছুর উপর লোভ কোরো না।’’ (হিজরত/ যাত্রাপুস্তক ২০/১৩-১৭, মো.-১৩)। আর তিনি যে মহাপাপ করলেন তার জন্য ঈশ্বর নির্ধারিত একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড (লেবীয় ২০/১০; দ্বিতীয় বিবরণ ২২/২২)। তবে ঈশ্বর তাঁর পুত্র ও খ্রিষ্ট দাউদের জন্য ভিন্ন রকমের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন: (১) দাউদের পাপের জন্য তার কুল বা বংশধরদের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করলেন, (২) দাউদের পাপের জন্য তাঁর নবজাতক নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যুদণ্ড দিলেন এবং (৩) দাউদের স্ত্রীদের প্রকাশ্যে গণধর্ষণের ব্যবস্থা করলেন।

অপরাধীর কারণে নিরপরাধের শাস্তি! অপরাধীর কারণে নিষ্পাপ সন্তানকে হত্যা! একটা পাপের শাস্তি হিসেবে আরেকটা মহাপাপের ব্যবস্থা!! প্রকাশ্যে জনসম্মুখে নিরপরাধ নারীদের শস্নীলতাহানি ও সম্ভ্রম নষ্টের মাধ্যমে ব্যভিচারীর শাস্তির রায়!! দুটো রায়ই ঈশ্বর কার্যকর করেন। দাউদের ব্যভিচার-জাত সন্তানটা মারা যায়। আর দাউদের পুত্র অবশালোম (Absalom) তাঁর পিতার স্ত্রীদেরকে গণমানুষের সম্মুখে ধর্ষণ করেন। (২ শমূয়েল ১২/১৫-২৩; ১৬/২২)

ঈশ্বরই বলেছেন: ‘‘যে গুনাহ করে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না।’’ (ইহিস্কেল ১৮/২০, মো.-০৬)। আবার ঈশ্বরই এখানে বললেন: দাউদের গুনাহের জন্য তাঁর নবজাতক পুত্র মরল এবং তাঁর নিরপরাধ স্ত্রীরা ধর্ষিতা হল। দাউদ তাঁর দুষ্টতার ফল পেলেন না। সম্পূর্ণ নিরপরাধ বংশধর, সন্তান ও স্ত্রীরা শাস্তি পেলেন। এটা কি বৈপরীত্য? না মিথ্যা? বাহ্যত বাইবেলের প্রথম কথাটা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হল!