বাইবেলের বর্ণনায় যাকোবও অকাতরে মিথ্যা বলতেন। তিনি তাঁর মিথ্যা দ্বারা তাঁর পিতা ইসহাককে প্রতারিত করেন। শুধু তাই নয়, বাইবেলের বর্ণনায় জানা যায় যে, স্বয়ং ঈশ্বরও তাঁর মিথ্যায় প্রতারিত হন!
ইসহাকের বড় ছেলে এষৌ (Esau) বা ইস এবং ছোট ছেলে যাকোব (Jacob) বা ইয়াকুব। বাইবেলের বিধান অনুসারে বড় ছেলে (firstborn) পিতার স্থলাভিষিক্ত হন, বংশের অধিকার লাভ করেন এবং আশীর্বাদ লাভ করেন। ইসহাকও বড় ছেলে এষৌকে আশীর্বাদের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যাকোব মিথ্যা বলে আশীর্বাদ হরণ করেন।
আদিপুস্তকের ২৭ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, বৃদ্ধবয়সে ইসহাক দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যান। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসকে ডেকে বলেন, তুমি প্রান্তর থেকে আমার জন্য হরিণ শিকার করে এনে আমার জন্য সুস্বাদু করে খাদ্য প্রস্তুত কর, আমি ভোজন করব, ‘যেন মৃত্যুর আগে আমার প্রাণ তোমাকে দোয়া করে’। ইস হরিণ শিকারের জন্য প্রান্তরে গমন করলে ইসহাকের স্ত্রী রিবিকা কনিষ্ঠ পুত্র যাকোবের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে বাড়ির পাল থেকে দুটো ছাগলের বাচ্চা জবাই করে সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করেন। যাকোব ইস-এর কাপড়গুলো পরিধান করেন। ইস লোমশ ছিলেন এবং যাকোব লোমশ ছিলেন না, এজন্য রিবিকা যাকোবের হাতে ও গলায় উক্ত জবাইকৃত ছাগলদুটোর চামড়া জড়িয়ে দেন। এরপর যাকোব পিতার নিকট যেয়ে তাঁকে ডাকেন। তিনি বলেন,
‘‘বৎস, তুমি কে? ইয়াকুব তাঁর পিতাকে বললেন, আমি আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র ইস; ... তখন ইস্হাক তাঁর পুত্রকে বললেন, বৎস কেমন করে এত শীঘ্র সেটি পেলে? তিনি বললেন, আপনার আল্লাহ মাবুদ আমার সম্মুখে তা উপস্থিত করলেন (Because the LORD thy God brought it to me. কেরি/ কি. মো.-১৩: আপনার ঈশ্বর সদাপ্রভু/ আল্লাহ মাবুদ আমার সম্মুখে শুভফল উপস্থিত করলেন)। ইস্হাক ইয়াকুবকে বললেন, বৎস, কাছে এসো; আমি তোমাকে স্পর্শ করে বুঝি, তুমি সত্যিই আমার পুত্র ইস্ কি না। তখন ইয়াকুব তাঁর পিতা ইস্হাকের কাছে গেলে তিনি তাঁকে স্পর্শ করে বললেন, স্বর তো ইয়াকুবের, কিন্তু হাত ইসের হাত। বাস্তবিক তিনি তাঁকে চিনতে পারলেন না, কারণ ভাই ইসের হাতে মত তাঁর হাত লোমযুক্ত ছিল; অতএব তিনি তাঁকে দোয়া করলেন। তিনি বললেন, তুমি কি বাস্তবিকই আমার পুত্র ইস? তিনি বললেন, হ্যাঁ।’’ (আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ২৭/১৮-২৪, মো.-১৩)
ইসহাক ইয়াকুবকে ইস বলে নিশ্চিত হওয়ার পরে তাঁর দেওয়া খাদ্য ভক্ষণ করেন। কাছে ডেকে যাকোবের পোশাকের গন্ধ নিয়ে নিশ্চিত হন যে, এটা তার বড় ছেলে ইস্ই। ‘‘আর ইসহাক তাঁর কাপড়ের গন্ধ নিয়ে তাঁকে দোয়া করে বললেন, দেখ, আমার পুত্রের সুগন্ধ মাবুদের দোয়াযুক্ত ক্ষেত্রে সুগন্ধের মত। আল্লাহ আসমারে শিশির থেকে ও ভূমির সরসতা থেকে তোমাকে দিন...।’’ (আদিপুস্তক/পয়দায়েশ ২৭/২৭-২৮)
তারপর তিনি তাকে দোয়া করেন। পরে ইস শিকার নিয়ে ফিরে এসে সকল ঘটনা জেনে পিতার কাছে পুনরায় দোয়া প্রার্থনা করলে তিনি তাকে দোয়া করতে অস্বীকার করেন এবং অভিশাপ বা বদদোয়া করেন। (আদিপুস্তক ২৭/২৭-৪০)
এ কাহিনীতে এ ভাববাদী পরিবারকে অশোভনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে:
(ক) স্ত্রী তার স্বামীর অন্ধত্বের সুযোগে তাঁকে প্রতারণার ষড়যন্ত্র করছেন!
(খ) মা তার এক পুত্রের পক্ষে অন্য পুত্রের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করছেন!
(গ) যাকোব তাঁর সহোদর ভাইয়ের বিরুদ্ধে অবৈধ ষড়যন্ত্র করছেন!
(ঘ) ভাববাদী যাকোব বারবার মিথ্যা বলে ভাববাদী পিতাকে প্রতারণা করছেন!
(ঙ) তিনি ঈশ্বরের নামে মিথ্যা বলছেন যা ভয়ঙ্করতম কুফরী (blasphemy)। তিনি সহজ ও সাবলীলভাবে ঈশ্বরের নামে মিথ্যা বললেন যে, ঈশ্বর সদাপ্রভু তাঁকে দ্রুত শিকার ধরিয়ে দিয়েছেন! ঈশ্বরের নামে মিথ্যা বলতেও তাঁর হৃদয় কাপল না!
(চ) ঈশ্বর উপরের সবগুলো মহাপাপকে মহাপ্রেমে অনুমোদন করছেন!
(ছ) আমরা জানি যে, মানুষের হাতের চামড়া যতই লোমশ হোক তা কখনো ছাগলের দেহের লোমশ চামড়ার মত হয় না। এছাড়া মানুষের চামড়া এবং মানুষের দেহের উপর জড়িয়ে দেওয়া একটা অতিরিক্ত চামড়া কখনোই একরকম হয় না। অতিরিক্ত চামড়াটা থলথল করে এবং হাত দিলেই বুঝা যায়। অবাক কা- যে, ঈশ্বরের একজন প্রাজ্ঞ ভাববাদী তাঁর হাত দিয়ে ধরে ও নাড়াচাড়া করে মানুষের হাতের লোমশ চামড়া এবং মানুষের হাতের উপরে বেঁধে দেওয়া সদ্য জবাই করা একটা প্রাণির চামড়ার মধ্যে পার্থক্য করতে পারলেন না!
(৪) একটা মানুষের পোশাকে তার দেহের কতটুকু ঘ্রাণ থাকে? পাঠক একটু চেষ্টা করে দেখেন। আপনার দুজন সন্তানকে একই রকম দুটো পোশাক কিনে দেন। কাপড়গুলো একসাথে রেখে এরপর ঘ্রাণ দ্বারা বাছাইয়ের চেষ্টা করুন। আপনি নিশ্চিত হবেন যে, এরূপ বাছাই কষ্টকর ও অনিশ্চিত। বাইবেলের বর্ণনায় ইসহাকের ঘ্রাণ শক্তি খুবই প্রখর ও সংবেদনশীল ছিল। এজন্য তিনি পোশাকের গন্ধ দিয়ে পুত্র নিশ্চিত করলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, সদ্য জবাই করা প্রাণির আর্দ্র চামড়ার গন্ধ তার নাকে গেল না কেন? স্বভাবতই রিবিকা ও যাকোব ছাগল দুটো জবাই করে রান্না করার সামান্য সময়ের মধ্যে ছাগল দুটোর চামড়া পরিচ্ছন্ন করে শুকিয়ে দুর্গন্ধ ও আর্দ্রতা মুক্ত করে আনতে পারেননি। এজন্য হাত দিয়ে স্পর্শ করা ছাড়াই ঘ্রাণেও কিছু অনুভব করা স্বাভাবিক ছিল। ইসহাক পোশাকের গন্ধ বুঝলেও চামড়ার গন্ধ পেলেন না!
(ঝ) সবচেয়ে অবাক বিষয় স্বয়ং ঈশ্বর এ মিথ্যা দ্বারা প্রতারিত হলেন!! ঈশ্বর কি এতই অসহায় যে, যাচাই না করে কারো দোয়া গ্রহণ ও বাস্তাবায়ন করবেন? বিশেষ করে এ ঘটনায় ইসহাক ইসকেই দোয়া করেছেন। তাঁর অন্তর কখনোই ইয়াকুবকে দোয়া করে নি। ইসের পোশাকের সুগন্ধ নিয়ে সে পোশাকের মালিক ইসের জন্যই তিনি দোয়া করেন। তবে তিনি অন্ধ হওয়ার কারণে পোশাকের মধ্যে বিদ্যমান ব্যক্তিটা যে ইস নয় তা বুঝতে পারেননি। ঈশ্বরও কি অন্ধ ছিলেন? ইসহাক অন্তর থেকে ইসের জন্য দোয় করলেন আর ঈশ্বর তা প্রকৃত ইসকে না দিয়ে প্রতারণাপূর্বক ইসের নাম নিয়ে ইসহাকের দাঁড়ান ইয়াকুবকে দিয়ে দিলেন! ঈশ্বর ইয়াকুব ও তাঁর মাতাকে তাঁদের প্রতারণা ও মিথ্যাচারের জন্য শাস্তি না দিয়ে অন্ধের আশীর্বাদ অন্ধের মতই কার্যকর করে দিলেন?