পবিত্র বাইবেলে বিভিন্ন কারণে অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী, বংশ বা জাতিকে অভিশাপ বা ‘বদদোয়া’ দেওয়া হয়েছে। অভিশাপ, অভিশপ্ত (curse, cursed, accursed) ও এ জাতীয় শব্দগুলো বাইবেলে প্রায় ২০০ বার ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন পাপের কারণে অভিশাপ দেওয়া ছাড়াও অনেক সময় কোনো অপরাধ ছাড়াও অনেক ব্যক্তি বা বংশকে শাপগ্রস্ত বা ‘বদদোয়াগ্রস্ত’ করা হয়েছে।
বাইবেলের বর্ণনায় নোহ বা নূহ (আ.) মদ পান করে মাতাল ও উলঙ্গ হন। তাঁর ছোট ছেলে হাম অনিচ্ছাকৃতভাবে হঠাৎ পিতাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলেন। মাতলামি কাটার পর বিষয়টা জেনে নোহ ক্রুদ্ধ হয়ে হামের ছেলে কনানকে ভয়ঙ্কর অভিশাপ দেন এবং ঈশ্বর সে অভিশাপ বাস্তবায়ন করেন!!! (আদিপুস্তক ৯/১৮-২৫)
মাতাল বা উলঙ্গ হওয়ায় নোহের অপরাধ হল না, কিন্তু অসতর্কভাবে তা দেখে ফেলায় হামের অপরাধ হল! আর সে অপরাধ করল হাম কিন্তু অভিশাপ পেল হামের এক ছেলে কনান!! অপরাধী হামের চার পুত্র: কূশ, মিসর, পূট ও কনান। (আদিপুস্তক ১০/৬) তাদের মধ্য থেকে শাস্তির জন্য শুধু কনানকে বেছে নেওয়ার কারণটিই বা কী? আর এরূপ সম্পূর্ণ অন্যায় অভিশাপ কার্যকর করতে ঈশ্বর বাধ্য হলেন কেন?
কিছু শিশু ইলীশায় বা আল-ইয়াসা (Elisha) নবীকে টাক বলে ঠাট্টা করে। ইলীশায় শিশুদেরকে ঈশ্বরের নামে অভিশাপ দেন এবং বন থেকে দুটো ভল্লুকী এসে ৪২ জন শিশুকে মেরে ফেলে। (২ রাজাবলি ২/২৩-২৪) অন্যত্র ইলীশায়ের এক শিষ্য গেহসি (Gehazi) কিছু উপহার গোপন করার কারণে ইলীশায় অভিশাপ দেন যে, গেহসি ও তার বংশধরদের মধ্যে চিরকাল কুষ্ঠরোগ থাকবে (২ রাজাবলি ৫/২৭)। কেউ যদি অন্যায় অভিশাপ দেন তবে ঈশ্বর তা বাস্তবায়ন করবেন কেন?
এ জাতীয় অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক একটা অভিশাপ ‘টাঙানো ব্যক্তির অভিশাপ’। বাইবেলে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় তবে সে অভিশপ্ত। বাইবেল বলছে: ‘‘যদি কোন মানুষ প্রাণদণ্ডর যোগ্য গুনাহ করে, আর তার প্রাণদ- হয় এবং তুমি তাকে গাছে টাঙ্গিয়ে দাও, তবে তুমি তার লাশ রাত বেলায় গাছের উপরে থাকতে দেবে না, কিন্তু নিশ্চয় সেদিনই তাকে দাফন করবে; কেননা যে ব্যক্তিকে টাঙ্গান হয়, সে আল্লাহর বদদোয়াগ্রস্ত (KSV: for he that is hanged is accursed of God. RSV: for a hanged man is accursed by God); তোমার আল্লাহ মাবুদ অধিকার হিসাবে যে ভূমি তোমাকে দিচ্ছেন, তুমি তোমার সেই ভূমি নাপাক করবে না।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ২১/২২-২৩, মো.-১৩)
অর্থাৎ, টাঙানো ব্যক্তি অভিশপ্ত। তার দেহ সারাদিন টাঙানো থাকলেও অসুবিধা নেই, তবে রাত্রিতে টাঙানো থাকলে পুরো দেশই অপবিত্র হয়ে যাবে। কাজেই রাতের আগেই তাকে নামিয়ে কবর দিতে হবে। এজন্য ইহুদিদের বা বনি-ইসরাইলের দেশে এরূপ করা বৈধ নয়। তবে অ-ইহুদিদের দেশকে অপবিত্র করলে অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন হল, অভিশাপ কি পাপ বা অপরাধের সাথে জড়িত না টাঙানোর সাথে জড়িত? যদি বলা হয় যে, মহাপাপে লিপ্ত হওয়ার কারণে বাইবেল নির্ধারিত উচিত শাস্তি হিসেবে যাকে টাঙানো হয় সে অভিশপ্ত তবে এ অর্থটা কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্য। কারণ অভিশাপ মূলত অপরাধের সাথে জড়িত, শাস্তির প্রকাশ হিসেবে ‘টাঙানো’র কথা বলা হয়েছে। যদিও অপরাধীর অপরাধের জন্য শাস্তি ও অভিশাপ দু’টাকে একত্রিত করা ঈশ্বরীয় ন্যায়পরায়ণতার সাথে সাংঘর্ষিক। যে ব্যক্তি তার অপরাধের শাস্তি পেল সে কেন শাস্তি পাওয়ার পরেও আবার অভিশপ্ত হবে।
এর চেয়েও অযৌক্তিক কথা টাঙানো বা ঝুলানোর সাথে অভিশাপকে সম্পৃক্ত করা। অর্থাৎ অপরাধের সাথে অভিশাপের কোনো সম্পর্ক নেই, অভিশাপের সম্পর্ক ঝুলানোর সাথে। অপরাধী বা নিরপরাধ যেই ফাঁসিতে ঝুলবে সেই অভিশপ্ত হয়ে যাবে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকেও যদি কোনোভাবে আইনের নামে বা বে-আইনী ভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া যায় তবে সে অভিশপ্ত হয়ে যাবে।
বাইবেল নিশ্চিত করেছে যে, দ্বিতীয় অর্থটিই ঈশ্বরের উদ্দেশ্য। পল লেখেছেন যে, যীশু ক্রুশে বিদ্ধ হওয়ার কারণে অভিশপ্ত হয়েছেন। তৌরাতের শরীয়ত অনুসারে যারা কর্ম করে তারা সকলেই অভিশাপের অধীন থাকে। মানুষদেরকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে যীশু নিজেই ক্রুশে ঝুলে অভিশপ্ত হলেন। নিজে অভিশপ্ত হয়ে তিনি সকলকে শরীয়ত পালনের দায়ভার থেকে মুক্ত করলেন: গালাতীয় ৩/১০ ও ১৩ কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ নিম্নরূপ: ‘‘যারা শরীয়তের কাজ অবলম্বন করে তারা সকলে বদদোয়ার অধীন... মসীহই মূল্য দিয়ে আমাদের শরীয়তের বদদোয়া থেকে মুক্ত করেছেন, কারণ তিনি আমাদের জন্য শাপস্বরূপ হলেন; কেননা লেখা আছে, ‘যাকে গাছে টাঙ্গানো হয়, সে বদদোয়াগ্রস্ত।’’
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘শরীয়ত অমান্য করবার দরুন যে বদদোয়া আমাদের উপর ছিল, মসীহ সেই বদদোয়া নিজের উপর নিয়ে আমাদের মুক্ত করেছেন। পাক-কিতাবে এই কথা লেখা আছে, ‘যাকে গাছে টাংগানো হয় সে বদদোয়াপ্রাপ্ত।’’
এখানে পল কয়েকটা বিষয় নিশ্চিত করেছেন:
(ক) বাইবেলীয় অভিশাপ পাপের সাথে নয়, বরং ঝুলানোর সাথে সম্পৃক্ত। বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী, যাজক-ইমাম বা চোর-ডাকাত, ইহুদি বা রোমান যে কোনো ব্যক্তি, দল বা শাসক বিচার, বিচার নামীয় প্রহসন বা বিচার ছাড়াই কোনো নিরপরাধ মানুষকেও যদি অন্যায়ভাবে ‘ঝুলিয়ে’ দেয় তবে উক্ত টাঙানো ব্যক্তি অভিশপ্ত হয়ে যাবেন।
(খ) বাইবেলে ‘গাছে ঝুলানোর’ কথা বলা হলেও পল নিশ্চিত করেছেন যে, ‘গাছ’ বা ‘ঝুলানো’ কোনোটাই এ অভিশাপ লাভের জন্য জরুরি নয়। বরং ক্রুশে বিদ্ধ হলেও এ অভিশাপ কার্যকর হবে। ইহুদিরা কখনো ক্রুশে বিদ্ধ করে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতেন না। ক্রুশে হত্যা একটা রোমান পদ্ধতি। ইহুদিরা গাছে ঝুলিয়ে, পাথর মেরে বা আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতেন। ‘টাঙানো’ বা ফাঁসির ক্ষেত্রে ‘টাঙ্গানোর’ কারণেই মৃত্যু হয়। পক্ষান্তরে মানুষকে ক্রুশের সাথে টাঙ্গানোর কারণে মৃত্যু হয় না। বরং হাত, পা ও দেহে পেরেক ঢুকানো হয় এবং রক্তক্ষরণের কারণে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তবে পল নিশ্চিত করেছেন যে, ঈশ্বরের এ অভিশাপটা ব্যাপক। যে কোনোভাবে ‘টাঙানোর’ মত হলেই এ অভিশাপ কার্যকর হবে।
(গ) এ মূলনীতির ভিত্তিতে স্বয়ং যীশুও অভিশপ্ত। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তাঁকে ক্রুশে দেওয়া হলেও অভিশাপের হাত থেকে তিনি বাঁচতে পারেননি।
(ঘ) যীশু অন্যায়ভাবে প্রাপ্ত এ অভিশাপ দ্বারা ন্যায়ভাবে অভিশপ্তদেরকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। যারা ঈশ্বর নিষিদ্ধ মহাপাপ করে বা তৌরাত অমান্য করে অভিশপ্ত হয়েছেন যীশু তাদেরকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। এখন যদি কেউ নরহত্যা, অন্যায় বিচার, পিতামাতার কষ্টপ্রদান ইত্যাদি মহাপাপে লিপ্ত হন তবে তিনি তৌরাত নির্দেশিত অভিশাপের অধীন হবেন না।
(ঙ) পলের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান যে, তৌরাত লঙ্ঘনের অভিশাপ যীশু কাটাতে সক্ষম হলেও, তৌরাত পালনের অভিশাপ তিনি কাটাতে পারেননি। যদি কেউ তৌরাত মানার চেষ্টাসহ কিছু পাপ করে তবে সে অভিশপ্ত। আর যদি কেউ তৌরাত অমান্য করে খুন, ব্যভিচার ইত্যাদি মহাপাপ করে তবে সে অভিশাপ থেকে মুক্ত।
(চ) এ থেকে আরো জানা যায় যে, টাঙানোর মাধ্যমে অভিশপ্ত হওয়ার বিধানও অপরিবর্তিত রয়েছে। কারণ, যীশু তৌরাত লঙ্ঘনের অভিশাপ শুধু অকার্যকর করেছেন। এজন্য, যীশুর মত কোনো নিরপাধকেও যদি টাঙানো যায় তবে তিনি অভিশপ্ত হয়ে যাবেন। তবে যারা বিচার নামীয় প্রহসন বা বিচার ছাড়াই এরূপ নিরপরাধকে টাঙ্গাবেন তাদের অভিশপ্ত হওয়ার কোনো ভয় নেই।
(ছ) বাহ্যত এভাবে ক্রুশে অভিশপ্ত হওয়া ছাড়া মানুষদেরকে শরীয়ত লঙ্ঘনের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার অন্য কোনো উপায় বা ক্ষমতা ঈশ্বরের বা যীশুর ছিল না।