সংযোজনের আরেকটা নমুনা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অতি প্রসিদ্ধ একটা ইঞ্জিলীয় গল্প, যে গল্পে যীশু একজন ব্যভিচারী মহিলাকে রক্ষা করেন। ইংরেজি (KJV), (RSV) ও আরবি সংস্করণে যোহনের সুসমাচারের ৭ অধ্যায়ের ৫৩ শ্লোক এবং ৮ম অধ্যায়ের ১-১১ শ্লোক পর্যন্ত ১২টা শ্লোকে এ গল্পটা বর্ণিত। বাংলা জুবিলী বাইবেলেও এরূপই রাখা হয়েছে। তবে অন্যান্য বাংলা বাইবেলে ৭ অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটাকে ৮ অধ্যায়ে ঢুকিয়ে ৮ অধ্যায়ের ১-১১ শ্লোকে গল্পটা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, একজন মহিলা ব্যভিচারের অপরাধে ধৃত হন। তখন তাকে তৌরাত নির্দেশিত শাস্তি হিসেবে পাথর মেরে হত্যা করার জন্য আনা হয়। যীশু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন: ‘‘আপনাদের মধ্যে যিনি কোনো পাপ করেননি তিনিই প্রথম তাকে পাথর মারুন (He that is without sin among you, let him first cast a stone at her)’’। এ কথা শুনে আসেত্ম আসেত্ম ইহুদি ধর্মগুরু ও ছোটবড় সকলেই চলে যায় পরে যীশু মহিলাকে উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দেন।
বাইবেল বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, গল্পটা বানোয়াট ও সংযোজিত। কারণ:
(ক) শরীয়তের বাহ্যিক বিষয়গুলো পালনে যীশুর সমকালীন ইহুদিদের অনমনীয়তা, শনিবার বিষয়ে সামান্য ব্যতিক্রমে যীশুর প্রতি কঠোরতা ইত্যাদি বিষয় সামনে রাখলে আমরা নিশ্চিত হই যে, যীশুর এ কথায় ধর্মগুরুরা বিচার না করে চলে যাবেন বলে কল্পনা করা যায় না। বরং প্রত্যাশিত ছিল যে, ধর্মগুরুরা তাঁকে প্রশ্ন করবেন, ব্যভিচারীকে পাথর মারতে নিষ্পাপ হতে হবে, তা তৌরাতের কোথায় আছে?
(খ) ৪র্থ-৫ম শতকের প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু Saint John Chrysostom: সেন্ট ক্রীযোস্টম (মৃত্যু ৪০৭ খ্রি.) ও প্রাচীন অনেক ধর্মগুরু যোহনের ইঞ্জিলের ব্যাখ্যা রচনা করেছেন। কিন্তু তারা এ গল্পটা উল্লেখ করেননি বা ব্যাখ্যা করেননি। প্রাচীন কোনো খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ব্যভিচার, নৈতিকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে গল্পটা উল্লেখ করেননি।
(গ) যোহনের ৭/৫২ শ্লোকের সাথে ৮/১২ শ্লোক মিলিয়ে পড়লে পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, মাঝের এ কথাগুলো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক সংযোজন।
(ঘ) যোহনের ইঞ্জিলের প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপিতেই এ গল্পটা নেই।
এরপরও বাইবেলের বিভিন্ন আধুনিক সংস্করণে গল্পটা রেখে দেওয়া হয়েছে। রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শনে এ গল্পটার শেষে নিম্নের টীকা লেখা হয়েছে:
“The most ancient authorities omit 7.53-8.11; other authorities add the passage here or after 7.36 or after 21.25 or after Luke 21.38, with variations of text” : ‘‘সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলোতে এ গল্পটি নেই। অন্যান্য কোনো কোনো পাণ্ডুলিপিতে এ গল্পটি এখানে, অথবা ৭ অধ্যায়ের ৩৬ শ্লোকের পরে, অথবা ২১ অধ্যায়ের ২৫ শ্লোকের পরে অথবা লূকের ২১ অধ্যায়ের ৩৮ শ্লোকের পরে সংযোজন করা হয়েছে।’’
গল্পটা বাংলা কেরি বাইবেলে বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু কোনো টীকা লেখা হয়নি। পবিত্র বাইবেল ২০০০, কিতাবুল মোকাদ্দস ও জুবিলী বাইবেলে কোনো বন্ধনী বা টীকা ছাড়াই এ জাল গল্পটাকে পবিত্র পুস্তকের অঙ্গীভূত করা হয়েছে।
এ গল্পটা প্রসঙ্গে বাইবেলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (A Brief History of the Bible) প্রবন্ধে খ্রিষ্টধর্ম সাধারণ ফোরাম (Christianity General forum)-এর রবার্ট বয়ড (Robert Boyd) লেখেছেন: “People who accept on blind faith that the Bible they have in their hands is "the Word of God" mistakenly believe that what they have in their hands is the same as what the author of the bible wrote 2000 or more years ago. But it isn't. Take, for example, the popular story (John 7:53-8:11) in which Jesus saves a woman from being stoned as an adulteress. ... Although I always found this to be a most inspiring Gospel story and message, I must in good conscience face the fact that... this entire story is missing from the earliest version of John ...”
‘‘যে সকল মানুষ অন্ধ বিশ্বাসে মেনে নেন যে, তাদের হাতের বাইবেল ‘ঈশ্বরের বাণী’ তারা বিভ্রান্তিকরভাবে বিশ্বাস করেন যে, ২০০০ বছর বা তার আগের লেখক যা লেখেছিলেন তাই তাদের নিকট বিদ্যমান। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। উদাহরণ হিসেবে সেই সুপ্রসিদ্ধ গল্পটা ধরুন, যাতে ব্যভিচারী মহিলাকে প্রস্তরাঘাতে নিহত হওয়া থেকে যীশু উদ্ধার করেন (যোহন ৭/৫৩-৮/১১)। ইঞ্জিলের গল্প ও বাণীর মধ্যে এটাকেই আমি সর্বদা সবচেয়ে বেশি প্রেরণাদায়ক বলে গণ্য করেছি। তারপরও বিবেকের তাড়নায় আমাকে এ বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে যে ... যোহনের ইঞ্জিলের প্রাচীনতম সংস্করণে এ গল্পের কিছুই নেই।’’[1]
এ প্রসঙ্গে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিকৃতি (Distortions of the Roman Catholic Church) প্রবন্ধের বক্তব্য নিম্নরূপ:
“The two earliest fragments of John's gospel, for example, are copies transcribed in 200 A.D. -- at least 100 years after the death of the Apostle himself. Not surprisingly, this fact has caused many to speculate whether the manuscript really represents the words of John at all. Meanwhile, mainstream historians, linguists, and religious scholars agree that the Gospel of John, as we know it, differs markedly from the Gospel of John that was available to the early Christian Church. Take, for example, the popular story (John 7:53-8:11) in which Jesus saves a woman from being stoned as an adulteress. ... Interestingly enough, this entire story is missing from the earliest version of John. It is also missing from early Latin translations of the text, missing from older versions used in the Holy Land and in fact, according to the 12th century Byzantine scholar Euthymius Zigabenus (the earliest church father to comment on the passage), accurate copies of the Gospel of John do not and should not contain it. Furthermore, if one blocks out the entire little story, John 7:52 flows just fine into John 8:12, lending further credence to the idea that the passage was simply inserted after the fact. Who inserted it, and why, remains a mystery.”
‘‘যোহনের ইঞ্জিলের প্রাচীনতম খণ্ডতে পাণ্ডুলিপি দুটো ২০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিলিপি করা অনুলিপি, অর্থাৎ প্রেরিত যোহনের মৃত্যুর কমপক্ষে ১০০ বছর পরে এগুলো লেখা। কাজেই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এ কারণে অনেকেই সন্দেহ করেন যে, এ পাণ্ডুলিপি আদৌ যোহনের বক্তব্য উপস্থাপন করছে কি না। এছাড়া মূলধারার ঐতিহাসিক, ভাষাবিদ এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা একমত যে, আমাদের নিকট যোহনের ইঞ্জিল নামে যা পরিচিত তার সাথে প্রথম যুগের খ্রিষ্টীয় চার্চের নিকট বিদ্যমান যোহনের ইঞ্জিলের অনেক অমোচনীয় পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ব্যভিচারিণীকে প্রস্তরাঘাত থেকে রক্ষা করার সেই প্রসিদ্ধ গল্পটা ধরুন (যোহন ৭/৫৩-৮/১১)। ... অত্যন্ত মজার বিষয় হল, যোহনের প্রাচীনতম সংস্করণগুলো থেকে পুরো গল্পটাই গায়েব। এছাড়া যোহনের প্রাচীনতম ল্যাটিন অনুবাদের মধ্যেও এ গল্পটা নেই। পবিত্র ভূমিতে ব্যবহৃত প্রাচীনতর সংস্করণগুলোর মধ্যেও এ গল্পটা নেই। দ্বাদশ শতাব্দীর বাইযান্টাইন গবেষক ইউথিমিয়াস যিগাবেনাসই প্রথম ধর্মগুরু যিনি এ গল্পটার বিষয়ে মন্তব্য করেন। তার মতানুসারে, বাস্তব বিষয় হলো, যোহনের ইঞ্জিলের বিশুদ্ধ কোনো কপিতে কখনো এ গল্প ছিল না এবং থাকা উচিতও নয়। উপরন্তু, যদি কেউ এ ছোট গল্পটা পুরোটা বাদ দেন তবে যোহন ৭/৫২ অত্যন্ত সুন্দর আবহে যোহন ৮/১২-র সাথে মিলে যাবে। এ গল্পটা যে পরবর্তীকালে সংযোজিত তা এ বিষয়টা আরো নিশ্চিত করে। তবে কে গল্পটা ঢুকাল তা রহস্যই রয়ে গেল!’’[2]
[2] http://www.rotten.com/library/religion/bible/historical-construction/catholic-distortions/