গালাতীয় ৩/১০ শ্লোকে সাধু পল দাবি করেছেন যে, তৌরাত পালনের মাধ্যমে মুক্তির চেষ্টার অর্থই অভিশপ্ত হওয়া। তাঁর বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ অস্পষ্ট, এজন্য এখানে ইংরেজি পাঠ, আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ ও প্রচলিত বাংলা অনুবাদ উল্লেখ করছি:
KJV: For as many as are of the works of the law are under the curse: for it is written, Cursed is every one that continueth not in all things which are written in the book of the law to do them. RSV: For all who rely on works of the law are under a curse; for it is written, “Cursed be every one who does not abide by all things written in the book of the law, and do them.” CJB: For everyone who depends on legalistic observance of Torah commands lives under a curse, since it is written, “Cursed is everyone who does not keep on doing everything written in the Scroll of the Torah.” অর্থাৎ: ‘‘যত মানুষ তৌরাত পালন করে সকলেই অভিশাপ (লানত/ বদদোআ)-এর অধীন; কারণ লিখিত আছে: অভিশপ্ত প্রত্যেক ব্যক্তি যে তৌরাত পুস্তকের মধ্যে লিখিত সকল কিছু পালন করা অব্যাহত না রাখে।’’
কেরি: ‘‘বাস্তবিক যাহারা ব্যবস্থার ক্রিয়াবলম্বী (তৌরাত পালনকারী), তাহারা সকলে শাপের অধীন; কারণ লেখা আছে, ‘যে কেহ ব্যবস্থাগ্রন্থে লিখিত সমস্ত কথা পালন করিবার জন্য তাহাতে স্থির না থাকে, সে শাপগ্রস্ত।’’
জুবিলী: ‘‘বাস্তবিক যারা বিধানের আদিষ্ট কর্মের উপর নির্ভর করে, তারা সকলে অভিশাপের অধীন, কারণ লেখা আছে, যে কেউ বিধান-পুস্তকে লেখা সমস্ত কথা পালন করার জন্য তাতে স্থিতমূল না থাকে, সে অভিশপ্ত।’’
প. বা.-২০০০: ‘‘পবিত্র শাস্ত্রে লেখা আছে, ‘সেই লোক অভিশপ্ত যে আইন-কানুনে লেখা প্রত্যেকটা কথা পালন করে না।’ তাহলে দেখা যায়, যারা আইন-কানুন পালন করবার উপর ভরসা করে তাদের সকলের উপরে এই অভিশাপ রয়েছে।’’
কি. মো-২০০৬: ‘‘পাক কিতাবে লেখা আছে, ‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত যে শরীয়তে লেখা প্রত্যেকটা কথা পালন করে না।’ তাহলে দেখা যায়, যারা শরীয়ত পালন করবার উপর ভরসা করে তাদের সকলের উপরে এই বদদোয়া রয়েছে।’’
কি. মো.-২০১৩: ‘‘বাস্তবিক যারা শরীয়তের কাজ অবলম্বন করে তারা সকলে বদদোয়ার অধীন, কারণ লেখা আছে, ‘‘যে কেউ শরীয়ত কিতাবে লেখা সমস্ত কথা পালন করার জন্য তাতে স্থির না থাকে, সে বদদোয়াগ্রস্ত।’’
বাইবেল বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে, এখানে পল দ্বিতীয় বিবরণের ২৭ অধ্যায়ের ২৬ শ্লোকটা উদ্ধৃত করেছেন। এ শ্লোকের অভিশাপ বা বদদোআ বুঝতে এর পূর্বের শ্লোকগুলো পড়তে হবে। দ্বিতীয় বিবরণের ২৭ অধ্যায়ের ৯-২৫ শ্লোকে মোশি বা মূসা (আ.) বনি-ইসরাইলদেরকে ১১টা মহাপাপ থেকে সতর্ক করে সে সকল পাপে লিপ্তদের অভিশাপ বা বদদোআ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পাপগুলো নিম্নরূপ: (১) প্রতিমা স্থাপন বা অনুরূপ কর্মের দ্বারা শিরকে লিপ্ত হওয়া (২) পিতা বা মাতাকে অবজ্ঞা করা, (৩) প্রতিবেশীর সীমানা-চিহ্ন সরানো, (৪) অন্ধকে পথভ্রষ্ট করা, (৫) বিদেশী, এতিম বা বিধবার বিচারে অন্যায় করা, (৬) পিতার স্ত্রীর (সৎমায়ের) সাথে শয়ন (দৈহিক সম্পর্ক) করা, (৭) পশুর সাথে শয়ন করা, (৮) বোনের সাথে শয়ন করা, (৯) শাশুড়ির সাথে শয়ন করা, (১০) প্রতিবেশীকে গোপনে হত্যা করা এবং (১১) নিরপরাধকে খুন করতে ঘুষ নেওয়া। তিনি বলেন, লেবীয়গণ প্রত্যেক পাপের কথা উল্লেখ করে বলবেন: অভিশপ্ত সে ব্যক্তি যে এ পাপটা করে। তখন সকল মানুষ বলবেন: আমীন।
শেষে ২৬ শ্লোকে মোশি পল উদ্ধৃত অভিশাপটা বলেন। অভিশাপটার ইংরেজি পাঠ ও আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ দেখুন: KJV: Cursed be he that confirmeth not all the words of this law to do them. ‘‘যে ব্যক্তি এ বিধানের সকল কথা নিশ্চিত না করে তাতে লিপ্ত হয় সে অভিশপ্ত।’’ RSV: Cursed be he who does not confirm words of this law by doing them ‘‘যে ব্যক্তি এসকল কর্মে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা এ বিধানের কথাগুলো দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে না বা নিশ্চিত করে না সে অভিশপ্ত।’’
কেরি: ‘‘যে কেহ এই ব্যবস্থার কথা সকল পালন করিবার জন্য সেই সকল অটল না রাখে, সে শাপগ্রস্ত।’’ কি. মো.-২০০৬: ‘‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে এই শরীয়তের কথাগুলো পালন করে না এবং তার ক্ষমতাকে অস্বীকার করে।’’ কি. মো.-১৩: ‘‘যে কেউ এই শরীয়তের সমস্ত কথা পালন করার জন্য তাতে অটল না থাকে, সে বদদোয়াগ্রস্ত।’’
পাঠক, আশা করি অনুধাবন করতে পারছেন যে, সাধু পল তৌরাতের বক্তব্যটার মধ্যে শব্দ ও অর্থের পরিবর্তন করেছেন। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(১) সাধু পল ‘this law’ বা ‘এই বিধান’ বাক্যাংশকে পরিবর্তন করে ‘the book of the law’ অর্থাৎ ‘তৌরাত’ বা ‘ব্যবস্থাগ্রন্থ’ লেখেছেন।
(২) তিনি ‘confirm’ শব্দটার বদলে ‘continue’ লেখেছেন। কনফার্ম অর্থ নিশ্চিত করা বা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করা। পক্ষান্তরে কন্টিনিউ অর্থ স্থায়ী থাকা। এতে অর্থ পুরোই উল্টে গিয়েছে। তৌরাতের কথা: মহাপাপগুলোর নিষেধাজ্ঞা ‘নিশ্চিত’ বা ‘সমর্থন’ না করলে, অর্থাৎ অস্বীকার করলে অভিশাপ। কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদে ‘ক্ষমতা অস্বীকার করলে অভিশাপ’। আর পলের কথা: তৌরাতের ছোট বড় বিধানের যে কোনো একটা পালনে ‘স্থায়ী না থাকলে’ অভিশাপ।
(৩) তৌরাতের ‘না’-কে তিনি ‘হাঁ’ বানিয়েছেন। তৌরাতের বক্তব্য: যারা এ বিধান নিশ্চিত না করে ‘নিষিদ্ধ’ কর্মগুলো করবে তারা অভিশপ্ত। পক্ষান্তরে পলের বক্তব্য: যারা ‘ব্যবস্থাপুস্তকে’ ‘আদিষ্ট’ কর্মগুলো ‘করবে না’ তারা অভিশপ্ত।
(৪) পল অভিশাপের অর্থ ও নির্দেশনাও পরিবর্তন করেছেন। তাঁর ভাষাতেই অভিশাপটা হল: ‘‘সেই লোক বদদোয়াপ্রাপ্ত, যে শরীয়তে লেখা প্রত্যেকটা কথা পালন না করে।’’ এর অর্থ সুস্পষ্ট। শরীয়তের সকল কথা পালন কর, নইলে অভিশাপ। কিছু কথা বাদ দিলে কিছু অভিশাপ আর সকল কথা বাদ দিলে সকল অভিশাপ। কিন্তু সাধু পল দাবি করছেন যে, ‘তৌরাতের সব নির্দেশ সর্বদা পালন না করলে অভিশাপ।’ তবে ‘সব নির্দেশ সর্বদা অমান্য করলে’ অভিশাপ থেকে মুক্তি! তাঁর মতে, শরীয়তের কোনো কথাই পালন করা যাবে না; করলেই অভিশপ্ত হতে হবে। তবে পুরোটাই বাতিল, অস্বীকার ও অবমাননা করলে কোনোই অভিশাপ বা বদদোআ নেই।
এ বিকৃতির মাধ্যমে পল দাবি করছেন, শরীয়ত পালন করে মুক্তি পেতে হলে শরীয়তের সকল কিছু স্থায়ীভাবে মানতে হবে। সামান্য ব্যতিক্রম হলেই অভিশাপ। আর এরূপ মানা সম্ভব নয়। শরীয়ত সামান্য অমান্য করলেই যেহেতু অভিশাপ, সেহেতু শরীয়ত মেনে মুক্তির চিন্তা বাদ দিতে হবে! বাইবেলই বলছে যে, মানুষ শরীয়তের বিধান পালন করতে ব্যর্থ হবে, পাপ করবে, পুনরায় তাওবা করলে তার বিগত পাপ ক্ষমা করা হবে (যিহিস্কেল ১৮/১৯-২৩)। কিন্তু পল বলছেন, কোনো একটা বিধান মানতে ত্রুটি হলেই অভিশাপ। এ অভিশাপ থেকে বাঁচতে পুরো তৌরাত অস্বীকার ও অমান্য কর!
মোশি বললেন, উপরের ১১টা মহাপাপকে যে মহাপাপ হিসেবে নিশ্চিত করবে না, বরং এগুলোর কোনো পাপে লিপ্ত হবে সে বদদোআপ্রাপ্ত। পল দাবি করলেন যেহেতু এ সকল মহাপাপের যে কোনো একটাতে লিপ্ত হলেই অভিশাপ, কাজেই এ বিধান পুরোপুরি অমান্য করে ১১টা মহাপাপ সবগুলোই একত্রে ও সর্বদা পালন করলেও কোনো সমস্যা নেই। যীশুর উপর বিশ্বাসের মাধ্যমে শরীয়ত লঙ্ঘনের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে: ‘‘শরীয়ত অমান্য করার দরুন যে বদদোয়া আমাদের উপর ছিল মসীহ সেই বদদোয়া নিজের উপর নিয়ে আমাদের মুক্ত করেছেন।’’ (গালাতীয় ৩/১০-১৩)
তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি এ কথাটাই বলেছেন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার: “Be a sinner, and sin boldly, ... even if we commit fornication and murder a thousand times a day....” ‘‘পাপী হও এবং সাহসিকতার সাথে পাপ কর। ... যদি প্রতিদিন হাজার বার ব্যভিচার করতে হয় এবং হাজার বার খুন করতে হয় তবুও... যীশুর প্রতি বিশ্বাসই মুক্তি দিবে।’’