আমরা দেখেছি, যীশু বলেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র ইহুদি জাতি ছাড়া অন্য কারো জন্য প্রেরিত হননি। তিনি তাঁর প্রেরিতদের বা সাহাবীদেরকে অ-ইহুদি ও শমরীয়দের কাছে ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। ইঞ্জিল লেখকরা উল্লেখ করেছেন যে, যীশু পুনরুত্থানের পরে তাঁর প্রেরিতগণকে সকল জাতির নিকট ধর্ম প্রচারের আদেশ দেন। কিন্তু ‘প্রেরিত’ পুস্তক থেকে এ নির্দেশ পরবর্তী সংযোজন বলেই প্রতীয়মান হয়। আমরা দেখি যে, তাঁর তিরোধানের পরেও অনেক বছর তাঁর সাহাবীরা/ প্রেরিতগণ অ-ইহুদিদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করার কথা চিন্তা করেননি। তাঁরা কেবল ইহুদিদের মধ্যেই প্রচার করতেন। উপরন্তু তাঁরা অ-ইহুদিদেরকে অচ্ছ্যুৎ ও অপবিত্র বলে বিশ্বাস করতেন। প্রেরিত পুস্তকের ১০ অধ্যায়ে একটা বিশেষ স্বপ্নের মাধ্যমে ঈশ্বর পিতরকে নির্দেশ দেন যে, অ-ইহুদিদের মধ্যেও ধর্ম প্রচার করা যাবে। এরপর থেকে পিতর অ-ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চিন্তা শুরু করেন। পিতর যীশুর শেষ নির্দেশের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন না, বরং তাঁর স্বপ্নের উপর নির্ভর করছেন। (প্রেরিত ১০/২৮-২৯)
প্রেরিত ১৫ অধ্যায় থেকে আমরা দেখি যে, যীশুর অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী ও শিষ্য অ-ইহুদিদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের বিষয়ে আপত্তি করেন। সাহাবীদের এ মতভেদ সমাধানের জন্য ৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জেরুজালেমে সাহাবী ও ধর্মগুরুদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পিতর অ-ইহুদি বা পরজাতিদের মধ্যে যীশুর ধর্ম প্রচারের পক্ষে তাঁর পূর্ববর্তী স্বপ্নের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ‘‘হে ভাইয়েরা, তোমরা জান, এর অনেক দিন আগে আল্লাহ তোমাদের মধ্যে আমাকে মনোনীত করেছিলেন, যেন আমার মুখে অ-ইহুদীরা সুসমাচারের কালাম শুনে ঈমান আনে।’’ (প্রেরিত ১৫/৭, মো.-১৩)
এরপর যাকোব/ ইয়াকুব পিতরকে সমর্থন করে বলেন যে, অ-ইহুদিদের মধ্যে ধর্মপ্রচার ধর্মগ্রন্থ দ্বারা সমর্থিত: ‘‘আর নবীদের কালাম তার সঙ্গে মিলে, যেমন লেখা আছে, ‘এর পরে আমি ফিরে আসবো (After this I will return), দাউদের পড়ে যাওয়া কুটির পুনরায় গাঁথব, তার ধ্বংসস্থানগুলো পুনরায় গাঁথব, আর তা পুনরায় স্থাপন করবো; যেন অবশিষ্ট লোকেরা প্রভুর খোঁজ করে, আর যে জাতিদের উপরে আমার নাম কীর্তিত হয়েছে, তারা সকলেও করে (That the residue of men might seek after the Lord, and all the Gentiles, upon whom my name is called, saith the Lord, who doeth all these things)...।’’ (প্রেরিত ১৫/১৫-১৭, মো.-১৩)
জেরুজালেম সম্মেলন এবং সেখানে পিতর ও যাকোবের বক্তব্য থেকে আমরা আবারো নিশ্চিত হই যে, পুনরুত্থানের পরে অ-ইহুদিদের কাছে ধর্ম প্রচারের নির্দেশ যীশু দেননি। কারণ তিনি এরূপ নির্দেশ দিয়ে থাকলে কখনোই প্রেরিতগণ এ বিষয়ে মতভেদ করতেন না। পিতরও তাঁর কর্মের পক্ষে স্বপ্নের দলিল পেশ না করে যীশুর শেষ নির্দেশের কথা সকলকে স্মরণ করাতেন এবং যাকোবও যীশুর শিক্ষার উদ্ধৃতি দিতেন। পুরাতন নিয়মের উদ্ধৃতি দেওয়া, তা বিকৃত করা এবং তার অপ্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দিয়ে অ-ইহুদিদের দীক্ষা দেওয়ার বৈধতা দাবি করার কোনো প্রয়োজনই তাঁর থাকত না। যীশুর নির্দেশনা না থাকার কারণেই যাকোব পুরাতন নিয়মের বক্তব্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ইহুদি জাতি যেমন ‘প্রভুর অনুসন্ধান করবে’ তেমনি অন্যান্য জাতিও ‘সকলে তা করবে’। কাজেই অন্যান্য জাতির কাছে ধর্মপ্রচার অবৈধ নয়।
বাইবেল বিশেষজ্ঞরা একমত যে, যাকোব এখানে আমোষ বা আমোস (Amos) নবীর বক্তব্য বিকৃতভাবে উদ্ধৃত করেছেন। আমোসের বক্তব্য নিম্নরূপ: ‘‘সেদিন আমি দাউদের পড়ে যাওয়া কুটির পুনঃস্থাপন করবো (In that day will I raise up the tabernacle of David that is fallen), তার ফাটল বন্ধ করে দেব ও উৎপাটিত স্থানগুলো পুনর্গঠন করবো এবং আগের মত তা নির্মাণ করবো; যেন তারা ইদোমের অবশিষ্ট লোক এবং যত জাতির উপরে আমার নাম কীর্তিত হয়েছে, সকলের অধিকারী হয়: সকলের মালিকানা ইহুদিরা লাভ করে (That they may possess the remnant of Edom, and of all the heathen, which are called by my name)’’ (আমোস ৯/১১-১২, মো.-১৩)।
আমরা দেখছি যে, যাকোব অমোষের বক্তব্য অনেক স্থানে পরিবর্তন করেছেন। বিশেষত দুটো পরিবর্তন খুবই দৃষ্টি আকর্ষণ করে:
(ক) প্রথম শ্লোকের শুরুতে তিনি ‘‘এর পরে আমি ফিরে আসবো’’ কথা সংযোজন করেছেন যা মূল বক্তব্যে নেই।
(খ) দ্বিতীয় শ্লোকটার শব্দ ও অর্থ তিনি শতভাগ পরিবর্তন করেছেন। অমোষের বক্তব্যে প্রভুর অনুসন্ধানের কোনো কথাই নেই। অমোষ বলেছেন যে, সদাপ্রভু ইহুদি জাতিকে পুনরায় বিজয় দিবেন এবং ইহুদিরা তাদের শত্রু জাতিগুলোর মালিকানা, দখল বা কর্তৃত্ব লাভ করবে। পুরো বাক্যটা পরিবর্তন করে যাকোব বলেছেন যে, ইহুদি জাতি প্রভুর অন্বেষণ করবে এবং অন্যান্য জাতিও তা করবে। আর এ পরিবর্তিত ও বিকৃত উদ্ধৃতি দ্বারা তিনি তার মত প্রমাণ করেছেন।