যীশুর শিষ্যদের বিষয়েও ইঞ্জিলগুলোতে কিছু তথ্য বিদ্যমান যা সত্য বলে গ্রহণ করা খুবই কঠিন। তাঁদের বিষয়ে এমন কিছু কথা বলা হয়েছে যেগুলো বিশ্বাস করলে তাঁদেরকে নির্বোধ, ভীরু, কাপুরুষ, কঠিন-হৃদয় ও ঈমানবিহীন বা মুনাফিক প্রকৃতির মানুষ বলে বিশ্বাস করতে হয়। বিষয়টা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। পরবর্তী যুগের খ্রিষ্টান প্রচারকরা যে বিশ্বাস, সাহস ও ধৈর্য দেখিয়েছেন ইঞ্জিলগুলোর বিবরণে তার সামান্য পরিমাণও আমরা যীশুর শিষ্যদের মধ্যে দেখি না।
ইঞ্জিলগুলোর বিবরণ অনুসারে যীশু বারবার তাঁর বিচার, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা শিষ্যদেরকে বলেছেন। (মথি ১২/৪০, ২৬/২; ২৭/৬৩; মার্ক ৮/৩১; লূক ৯/২২-২৩; যোহন ২/১৩-১৬) অথচ যীশুর বিচার, ক্রুশারোহণ ও পুনরুত্থানের বর্ণনায় প্রেরিতরা থেকে আমরা চরম অবিশ্বাস দেখতে পাই।
ইঞ্জিলগুলো বলছে, যীশু তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা বারবার বলেছেন; কিন্তু শিষ্যরা গুরুর কথা বোঝেননি এবং ভয়ে গুরুকে প্রশ্নও করেননি। (লূক ৯/৪৪-৪৫; ১৮/৩১-৩৪)। এ কথা সত্য বলে গ্রহণ করলে প্রেরিতগণকে নির্বোধ, বিশ্বাসহীন ও গুরুর প্রতি প্রেমবিহীন বলে মনে করা ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ যে ভাষায় কথাগুলো যীশু বলেছেন তা অতি সাধারণ মানুষেরও বোধগম্য। অথচ শিষ্যরা বুঝলেন না? অনেক কঠিন ও জটিল বিষয় তারা বুঝেন (মথি ১৩/৫১; মথি ১৭/১৩) অথচ এ সরল কথাগুলো বুঝলেন না? আর না বুঝলেও তাঁরা প্রশ্ন করলেন না? প্রিয় গুরু তাঁর মৃত্যুর কথা বলছেন আর তাঁরা না বুঝে চুপ করে থাকবেন? অথচ এর চেয়ে অনেক সাধারণ বিষয়ে তাঁরা গুরুকে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছেন।
যীশু যখন বলেন যে শিষ্যদের একজন তাঁকে শত্রুদের হাতে সমর্পণ করবে ‘‘তখন ঈসার সাহাবীদের এক জন, যাঁকে ঈসা মহববত করতেন, তিনি তাঁর কোলে হেলান দিয়া বসেছিলেন। ... তাতে তিনি সেরকম ভাবে বসে থাকাতে ঈসার বুকের দিকে মাথা কাত করে বললেন: প্রভু, সে কে?...’’ (ইউহোন্না ১৩/২৩-২৬, মো.-১৩)
এখানে আমরা দেখছি যে, যীশু শিষ্যদের অত্যন্ত নিকটবর্তী ছিলেন। শিষ্যরা তাঁর কোলে হেলান দিয়ে বসতেন, তাঁর বুকের উপর হেলে পড়ে প্রশ্ন করতেও ভয় বা সংকোচ বোধ করতেন না। অথচ গুরুর লাঞ্ছনা, হত্যা ও পুনরুত্থানের কথা বারবার তাঁর মুখ থেকে শুনবেন, অথচ বুঝবেন না এবং প্রশ্নও করবেন না?
এরপরও আমরা ধরে নিচ্ছি যে, প্রথম প্রথম তাঁরা গুরুর কথা বুঝেননি বা ভয়ে প্রশ্ন করেননি, কিন্তু গুরুর বারবার বলার পর তা বুঝেছেন।
মথি লেখেছেন: ‘‘সেই সময় থেকে ঈসা তাঁর সাহাবীদেরকে স্পষ্টই বলতে লাগলেন (মার্কের ভাষায়: তিনি তাঁদেরকে এই শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন) যে, তাঁকে জেরুশালেমে যেতে হবে এবং প্রাচীনদের, প্রধান ইমামদের ও আলেমদের কাছ থেকে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হবে ও হত (নিহত) হতে হবে, আর তৃতীয় দিনে উঠতে হবে। এতে পিতর তাঁকে কাছে নিয়ে অনুযোগ করতে লাগলেন, প্রভু, তা আপনার কাছ থেকে দূরে থাকুক, তা আপনার প্রতি কখনও ঘটবে না। কিন্তু তিনি মুখ ফিরিয়ে পিতরকে বললেন, আমার সম্মুখ থেকে দূর হও, শয়তান, তুমি আমার পথের বাধা; কেননা যা আল্লাহর তা নয়, কিন্তু যা মানুষের, তা-ই তুমি ভাবছো।’’ (মথি ১৬/২১-২৩, মো.-১৩) মার্ক ও লূকও বিষয়টা লেখেছেন (মার্ক ৮/৩১-৩৩; লূক ৯/২২)।
এখানে আমরা দেখছি যে, (১) যীশু তাঁর প্রচার কর্মের প্রথম পর্যায় থেকেই শিষ্যদেরকে এ বিষয়টা ‘স্পষ্টভাবে’ শিক্ষা দিতে শুরু করলেন, (২) শিষ্যরা তাঁর কথা বুঝতে পারেন এবং প্রথমবার এ বিষয় শোনার পর তাঁর প্রতি ভালবাসার কারণে শিষ্যরা তাঁর কাছে আবেদন করেন যে, এটা যেন তাঁর বিষয়ে না ঘটে এবং (৩) বিষয়টা যে অপ্রতিরোধ্য এবং ঘটতেই হবে তাও তিনি শিষ্যদের বলতে থাকেন।
মার্ক ৮ম অধ্যায়ে (৩১-৩৩) উপরের বিষয়টা এভাবে উল্লেখ করেছেন। এরপর ৯ম অধ্যায়ে (৯-১০) লেখেছেন: ‘‘পর্বত থেকে নামবার সময়ে তিনি তাঁদেরকে দৃঢ় হুকুম দিয়ে বললেন, তোমরা যা যা দেখলে, তা কাউকেও বলো না, যতদিন মৃতদের মধ্য থেকে ইবনুল-ইনসান উত্থাপিত না হন। তখন, মৃতদের মধ্য থেকে উত্থান কি, তাঁরা এই বিষয়ে পরস্পর আলোচনা করে সেই কথা নিজেদের মধ্যে রেখে দিলেন।’’ (মো.-১৩)
ইতোপূর্বে তাঁরা বিষয়টা বুঝার পরে এখানে পুনর্বার বিষয়টা শুনলেন। মার্কের বর্ণনায় এবার তাঁরা বিষয়টা নিজেদের মধ্যে পর্যালোচনা করলেন। এরপর মার্ক ৯ম অধ্যায়েই কয়েক শ্লোক পরে লেখেছেন: ‘‘কেননা তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে উপদেশ দিয়ে বলতেন: ইবনুল-ইনসানকে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হবে; তারা তাঁকে হত্যা করবে; তাঁর মৃত্যুর তিন দিন পরে তিনি আবার উঠবেন। কিন্তু তাঁরা সেই কথা বুঝলেন না এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেও ভয় করলেন।’’ (মার্ক ৯/৩১-৩২, মো.-১৩)
তৃতীয় বার মার্ক বিষয়টা উল্লেখ করলেন। মার্কের বর্ণনা থেকেই আমরা দেখলাম, যীশুর এ বিষয়ক কথা প্রথম বারেই সাহাবীরা বুঝলেন ও অনুযোগ করলেন, দ্বিতীয় বার নিজেরা আলোচনা করলেন এবং তৃতীয়বার বুঝলেন না এবং প্রশ্ন করতে ভয় পেলেন?
মার্ক ১০ অধ্যায়ে পুনরায় উল্লেখ করেছেন যে, জেরুজালেমের পথে চলতে চলতে যীশু আবার বলেন: ‘‘দেখ, আমরা জেরুশালেমে যাচ্ছি, আর ইবনুল-ইনসানকে প্রধান ইমাম ও আলেমদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে; তারা তাঁর প্রাণদ- বিধান করবে এবং অ-ইহুদীদের হাতে তাঁকে তুলে দেওয়া হবে। আর তারা তাঁকে বিদ্রূপ করবে, তাঁর মুখে থুথু দেবে, তাঁকে কশাঘাত করবে ও হত্যা করবে; আর তিন দিন পরে তিনি আবার জীবিত হয়ে উঠবেন।’’ (মার্ক ১০/৩৩-৩৪, মো.-১৩)
এখানে মার্ক কোনো মন্তব্য করেননি। এ থেকে প্রতীমান হয় যে, বারবার বিষয়টা বলা ও ব্যাখ্যা করার পর শিষ্যরা বিষয়টা ভালভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হন। মার্ক এর পরেও উল্লেখ করেছেন যে, যীশু আরো কয়েকবার শিষ্যদেরকে তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থান বিষয়টা অবগত করান (মার্ক ১০/৪৫ ও ১৪/২৭-২৮)
যোহনের বর্ণনা অনুসারে যীশু প্রায় তিন বছর তাঁর প্রচারকার্য পরিচালনা করেন। প্রচারের শুরুতেই যোহন বাপ্তাইজক (বাপ্তিস্মদাতা ইয়াহিয়া) তাঁর শিষ্যদের সামনে যীশুর বিষয়ে সাক্ষ্য দেন যে, তিনিই ঈশ্বরের পুত্র ও মসীহ (যোহন ১/১৯-৩৪, ৩/২২-৩৬)। শিষ্যরাও শুরু থেকেই তাঁকে মসীহ বলে চিনেন ও বিশ্বাস করেন। (যোহন ১/৪১-৫১)। প্রচারের শুরু থেকেই তিনি মহা-অলৌকিক কর্ম দেখাতে শুরু করেন। যাতে শিষ্যরা ও হাজার হাজার মানুষ তাঁর উপর ঈমান আনেন (যোহন ২/১-১১, ২৩)।
তাঁর প্রেরিতগণ বা সাহাবীরা তাঁর সাথেই থাকতেন। তাঁরা তাঁর থেকে অসংখ্য মহা-অলৌকিক কর্ম দেখেন। যাতে তাঁদের ঈমান ক্রমান্বয়ে গভীর ও শক্তিশালী হতে থাকে। এ সকল বিষয়ের স্বাভাবিক পরিণতি নিম্নরূপ হওয়ার কথা:
(১) যীশুর সাহাবীরা ও হাজার হাজার শিষ্য তাঁর বিচার ও হত্যার প্রতিবাদ না করলেও তাঁর আশেপাশে থেকে প্রিয় গুরুর শেষ মুহূর্তগুলো প্রেমের সাথে অবলোকন করবেন এবং পুনরুত্থানের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করবেন।
(২) তৃতীয় দিবস সকালেই তাঁরা কবরের আশেপাশে বা তাঁদের সুবিধামত নিকটবর্তী নিরাপদ কোনো স্থানে অপেক্ষা করবেন।
(৩) পুনরুত্থিত যীশুকে তাঁরা মহানন্দে ও মহা সমারোহে অভ্যর্থনা করবেন। তাঁদেরকে নিয়ে যীশু জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের সকল গ্রামে ‘ইসরাইল বংশের হারানো ভেড়া বা মেষপালকে’ দেখা দিয়ে তাদের চিরস্থায়ী বিশ্বাস ও মুক্তির ব্যবস্থা করে বিদায় নিবেন।
কিন্তু ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনায় আমরা এর সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য দেখছি। আমরা দেখি যে, এত কিছুর পরেও যীশুর প্রেরিতগণ বা সাহাবীরা ও শিষ্যদের ঈমান অত্যন্ত দুর্বল ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে দোদুল্যমান। এমনকি পুনরুজ্জীবিত যীশুকে দেখার পরেও তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) ইহুদিদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে গেৎশিমানী (Gethsemane) বাগানে যীশু মর্মান্তিকভাবে দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে উঠেন। তিনি প্রার্থনা করতে চান এবং শিষ্যদেরকে তাঁর জন্য জেগে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন: ‘‘আমার প্রাণ মরণ পর্যন্ত দুঃখার্ত হইয়াছে (দুঃখে যেন আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে); তোমরা এখানে থাক, আমার সাথে জাগিয়া থাক।’’ (মথি ২৬/৩৮; মার্ক ১৪/৩৪)।
যে কোনো মানুষ তার প্রিয়জনকে এরূপ দুঃখার্ত দেখলে ইচ্ছা করলেও ঘুমাতে পারবে না। অথচ পাঠক এ অধ্যায়টা পড়ে দেখবেন, যীশুর শিষ্যরা গুরুর নির্দেশ সত্ত্বেও একটা ঘণ্টাও জেগে থাকতে পারলেন না। বারবার ফিরে এসে যীশু তাঁদেরকে ঘুমন্ত দেখে খুবই কষ্ট পেলেন, দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং তাঁদেরকে জাগ্রত থাকতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারপরও বারবারই তাঁরা অঘোরে ঘুমিয়ে গেলেন! (মথি ২৬/৩৬-৪৭; মার্ক ১৪/৩২-৪২; লূক ২২/৩৯-৪৬)। ঈমান না-ই থাক, ভালবাসার সামান্য অনুভূতি হৃদয়ে থাকলে কি কেউ এরূপ করতে পারে?
এ কথা কি বিশ্বাস করা সম্ভব যে, যীশুর সাহচর্যে এত দিন থাকার পর, তাঁর এত নসীহত, শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণের পর এবং অগণিত মহা-অলৌকিক কর্ম দেখার পরও যীশুর শিষ্যরা এরূপ অলস, নির্বোধ, প্রেমহীন ও ঈমানহীন ছিলেন? যীশুর সুপরিচিত শিষ্যদের বিষয়ে এরূপ অশোভন ধারণা পোষণ করার চেয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ইঞ্জিল লেখকদের বিষয়ে নির্বুদ্ধিতা, যাচাইবিহীন সংকলন বা মর্জি মাফিক সংযোজনের অভিযোগই কি অধিক সমীচীন নয়?
(খ) যীশুকে গ্রেফতার করার পর সাহাবীরা পালিয়ে গেলেন। যীশু তাঁদেরকে অস্ত্রধারণ করতে নিষেধ করেন; তবে তিনি তাঁদেরকে পালাতে বলেননি। তিনি নিজেকে সমর্পণ করে শিষ্যদের গ্রেফতার না করার বিষয় নিশ্চিত করে গ্রেফতারকারীদেরকে বলেন: ‘‘তোমরা যদি আমার খোঁজ কর তবে এদেরকে যেতে দাও।’’ (ইউহোন্না/ যোহন ১৮/৮)। আর গুরু পালাতে বললেও ঈমানদার কোনো শিষ্য পালাতে পারেন না। কিন্তু ইঞ্জিল লেখকরা নিশ্চিত করছেন যে, সাহাবীরা পলিয়ে গিয়েছিলেন: ‘‘তখন সাহাবীরা সকলে তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। আর একজন যুবক উলঙ্গ শরীরে একখানি চাদর জড়িয়ে তাঁর পিছনে পিছনে চলতে লাগল; তারা তাকে ধরল, কিন্তু সে সেই চাদরখানি ফেলে উলঙ্গই পালিয়ে গেল।’’ (মার্ক ১৪/৫০-৫১, মো.-১৩। পুনশ্চ: মথি ২৬/৬৫)
ইঞ্জিলগুলো বলছে যে, যীশু অনেক আগে থেকে বারবার তাঁদেরকে তাঁর গ্রেফতার, লাঞ্ছনা, হত্যা ও পুনরুত্থানের কথা বলতেন। তিনি যদি সত্যই এ সকল কথা তাঁদেরকে বলতেন তবে তাঁরা মনোকষ্ট পেলেও হতাশ হয়ে এভাবে পালাতেন না।
গ্রেফতার, ক্রুশে মৃত্যু ও পুনরুত্থান বিষয়ে ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনা সত্য হলে বুঝতে হবে যে, যীশু তাঁদেরকে তাঁর গ্রেফতার, হত্যা ও পুনরুত্থান বিষয়ক কিছুই বলেননি। তিনি বলেছিলেন যে, তিনিই মসীহ। আর ইহুদি বিশ্বাস অনুসারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিষ্যরা বিশ্বাস করতেন যে, যীশুই সেই প্রতিশ্রুত মসীহ যিনি ইহুদিদের হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করবেন। যখন তাঁকে সত্যিই গ্রেফতার হতে দেখলেন তখন তাঁরা সব আশা হারিয়ে এভাবে পালিয়ে গেলেন।
(গ) পিতরের অস্বীকারের কাহিনীও অবিশ্বাস্য। যীশুকে গ্রেফতারের আগে পিতর বললেন, তিনি যীশুর সাথে কারাগারে যেতে ও মৃত্যু বরণ করতে প্রস্তুত। আর অল্প সময় পরে তিনি বারবার শপথ করে ও অভিশাপ দিয়ে যীশুর সাথে তার সম্পর্ক বা পরিচয় অস্বীকার করছেন। (মথি ২৬/৬৯-৭৫; মার্ক ১৪/৬৬-৭২; লূক ২২/৫৫-৬২; যোহন ১৮/১৬-১৮ ও ২৫-২৭)। যে কোনো মানবীয় বিচারে এটা অবিশ্বাস্য।
সামান্যতম বুদ্ধি, বিশ্বাস বা ভালবাসা থাকলে কি কেউ এরূপ করতে পারে? বিশেষ করে ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনা অনুসারে পিতর যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান বিষয়ক বক্তব্য শুনেছিলেন, বুঝেছিলেন এবং যীশুর কাছে অনুযোগ করেছিলেন যে, এরূপ কিছু গুরুর জন্য না ঘটুক। স্বভাবতই তিনি যখন এ সকল ঘটতে দেখলেন তখন তাঁর বিশ্বাস আরো জোরদার ও গভীর হবে বলেই স্বাভাবিক।
ইঞ্জিলের এ সকল বক্তব্য সত্য বলে গ্রহণ করলে আমাদের মেনে নিতে হবে যে, যীশুর সাহচর্য, শিক্ষা, অলৌকিক কর্ম অবলোকন ইত্যাদির মাধ্যমে পিতর কিছুই লাভ করেননি। সব কিছুর পরেও তিনি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে দোদুল্যমান ছিলেন। এরূপ ধারণা শুধু পিতরের জন্যই নয়; স্বয়ং যীশুর জন্যও অবমাননাকর যে, তাঁর একান্ত সাহচর্যে এত দিন থেকেও এ শিষ্য কিছুই অর্জন করতে পারলেন না।
অথবা আমাদের মনে করতে হবে যে, পিতর বিষয়ক চার ইঞ্জিলের এ বর্ণনা বানোয়াট। সম্ভবত পিতরের অস্বীকার বিষয়ক যীশুর অলৌকিক জ্ঞান ও ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করতে এ সকল কাহিনী উদ্ভাবন ও প্রচার করা হয়। অথবা যীশু তাঁর গ্রেফতার, হত্যা ও পুনরুত্থান বিষয়ে শিষ্যদের আগে থেকে বলেছিলেন বলে ইঞ্জিলের বর্ণনাগুলো ভিত্তিহীন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনিই মসীহ। অন্যান্য শিষ্যের মত পিতরও যীশুকে প্রতিশ্রুত মসীহ বলে বিশ্বাস করতেন। আর ইহুদি বিশ্বাস অনুসারে তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, যীশুর মাধ্যমে তাঁরা হারানো রাজ্য ফিরে পাবেন। তাই যখন তাঁকে গ্রেফতার হতে দেখলেন তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তিনি এভাবে অস্বীকার করেন।
(ঘ) ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনায় আমরা দেখি যে, যীশুর হত্যাকাণ্ড দেখার জন্য অনেক মানুষই উপস্থিত হয়েছিল। (লূক ২৩/৪৭-৪৮)। বধ্যভূমিতে দূরে ও কাছে অনেক মহিলা সেবিকা উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু পুরুষ শিষ্য ও প্রেরিতদের তেমন উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। (মথি ২৭/৫৫-৫৬; মার্ক ১৫/৪০-৪১; লূক ২৩/৪৯)।
(ঙ) যোহন বাপ্তাইজককে রাজা হেরোদ হত্যা করেন। এরপর যোহনের শিষ্যরা তাঁর মৃতদেহ নিয়ে কবর দেন (মার্ক ৬/২৭-২৯) অথচ যীশুর সাহাবীরা কেউ তার মৃতদেহ নিতে আসলেন না। যোহনের শিষ্যদের চেয়ে যীশুর শিষ্যরা কি অনেক বেশি ভীত ও কাপুরুষ ছিলেন? না কি যীশুর প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বাস মোটেও ছিল না? গোপন ভক্তদের একজন বা দুজনে কবর দিলেন। সাহাবীরা কবর দেখতেও গেলেন না। শুধু মহিলারাই কবর দেখতে গেলেন (মথি ২৭/৬১; মার্ক ১৫/৪০-৪১)।
(চ) ইঞ্জিলগুলো বলছে যে, যীশু বারবার শিষ্যদের বলেছিলেন, তিনি তিন দিন পর উঠবেন। স্বাভাবিক মানবীয় বিবেচনার দাবি যে, শিষ্যরা তৃতীয় দিবসের শুরুতে কবরের নিকটবর্তী হবেন। কিন্তু আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখছি। শনিবার বিশ্রাম দিবসে ইহুদিরা বের হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্রাম দিবসের পরেও কোনো পুরুষ শিষ্য বা ‘সাহাবী’ কবরের কাছে গেলেন না। যীশুর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে তো নয়ই; এমনকি প্রিয় গুরুর প্রতি ভক্তি প্রকাশ করতেও গেলেন না। শুধু মহিলা সেবিকারা কবরে গেলেন। তাঁরাও তাঁর প্রতিশ্রুত পুনরুত্থানের প্রত্যাশা নিয়ে যাননি। তাঁরা শুধু কবর দেখতে ও মৃতদেহে সুগন্ধি মাখাতে গেলেন (মথি ২৮/১; মার্ক ১৬/১-২; লূক ২৩/৫৬, ২৪/১)। এমনকি কবর খোলা দেখেও তাঁদের মনে একবারের জন্যও যীশুর কয়েকদিন আগে বলা কথাগুলো মনে পড়েনি!
(ছ) মহিলারা কবর খোলা দেখে শিষ্যদের খবর দিলে শিষ্যরা সে খবরকে অবিশ্বাস করলেন ও রূপকথা মনে করলেন! ‘‘আর তাহারা কবর হইতে ফিরিয়া গিয়া সেই এগারো জনকে এবং অন্য সকলকে এই সমস্ত সংবাদ দিলেন। ... কিন্তু এই সকল কথা তাঁহাদের নিকট গল্পতুল্য (idle tales রূপকথা) বোধ হইল; তাঁহারা তাঁহাদের কথায় অবিশ্বাস করিলেন। তথাপি পিতর উঠিয়া কবরের নিকটে দৌড়িয়া গেলেন, এবং হেঁট হইয়া দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, কেবল কাপড় পড়িয়া রহিয়াছে; আর যাহা ঘটিয়াছে তাহাতে আশ্চর্য জ্ঞান করিয়া স্বস্থানে চলিয়া গেলেন।’’ (লূক ২৪/৯-১০)
তাহলে আমরা দেখছি যে, শিষ্যদের মনের মধ্যে যীশুর পুনরুজ্জীবিত হওয়ার বিষয়ে সামান্যতম প্রত্যাশা, ধারণা বা কল্পনাও ছিল না। থাকলে তাঁরা মহিলাদের কথা শুনে রূপকথা বা কল্পকাহিনী বলে মনে করতেন না, বরং অন্তত একবার বিষয়টা মনে আসত। স্বচক্ষে কবর খালি দেখে শুধু আশ্চর্য হয়ে চলে যেতেন না, বরং তাঁর পুনরুত্থানের বিষয়টা মনে উদিত হত।
(জ) যোহন ২০ অধ্যায়ে লেখেছেন যে, মগ্দলীনী মরিয়ম যীশুর কবরের মুখ খোলা দেখেই মনে করেন যে, যীশুর মৃতদেহ চুরি হয়েছে। তিনি জীবিত হয়েছেন এর সামান্যতম কল্পনাও তাঁর মনে আসেনি। তিনি পিতর ও অন্য শিষ্যকে সংবাদ দিলে তাঁরা কবর পরীক্ষা করে দেখেন যে, লাশ নেই। তাঁরাও খুবই আশ্চর্য হলেন। কিন্তু তাঁরা অপেক্ষা না করে ফিরে গেলেন। যীশু পুনরুজ্জীবিত হতে পারেন এ কল্পনাও তাঁরা করেননি। ( যোহন ২০/১-১০)।
ইউহোন্না এর ব্যাখ্যায় লেখেছেন (২০/৯, মো.-১৩): ‘‘কারণ এই পর্যন্ত তাঁরা পাক-কিতাবের এই কথা বুঝেননি যে, মৃতদের মধ্য থেকে তাঁকে উঠতে হবে।’’
আমরা যোহনের সাথে একমত যে, তাঁরা পাক-কিতাবের কথা বুঝেননি; কারণ পাক কিতাবে- অর্থাৎ বাইবেলের পুরাতন নিয়মে- মসীহ বিষয়ে কোথাও বলা হয়নি যে, মসীহকে দুঃখভোগ করতে হবে, নিহত হতে হবে এবং তিন দিন পরে উঠতে হবে। পুরাতন নিয়মের বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য জোড়া দিয়ে সাধু পল ও পরবর্তী খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা এ বিশ্বাসটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। ইহুদি ঐতিহ্যে মসীহ বলতে বিজয়ী রাজাকে বুঝানো হয়েছে; দুঃখভোগকারী মসীহের কথা কোথাও নেই। কাজেই এ বিষয়ে পাক-কিতাবের কোনো কথাই সাহাবীরা জানতেন না।
কিন্তু ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনা অনুসারে স্বয়ং যীশু যে তাঁদেরকে বিগত কয়েকটা মাস ধরে বারবার এ কথা বললেন তাও কি তাঁরা বুঝেননি? না বুঝলেও কথাটা অন্তত মনে রাখেননি? যদি মনে থাকত তবে অন্তত তাৎক্ষণিক অর্থ বুঝতে পারতেন।
(ঝ) যখন শিষ্যরা মরিয়মের মুখে ও অন্যান্য শিষ্যের মুখে গুরুর জীবিত হওয়ার সংবাদ পেলেন তখনও তাঁরা বিশ্বাস করলেন না। কয়েকদিন আগে বারবার করে বলা গুরুর শিক্ষা ও প্রতিশ্রুতির কথা ঘুণাক্ষরেও মনে পড়ল না। মার্ক লেখেছেন: ‘‘তিনিই (মগ্দলীনী মরিয়ম) গিয়ে যারা ঈসার সঙ্গে থাকতেন তাঁদেরকে সংবাদ দিলেন, তখন তাঁরা শোক ও কান্নাকাটি করছিলেন। যখন তাঁরা শুনলেন যে, তিনি জীবিত আছেন ও তাকে দর্শন দিয়েছেন, তখন সেই কথা তারা বিশ্বাস করলেন না। তারপর তাঁদের দু’জন যখন পল্লীগ্রামে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি আর এক আকারে তাঁদের কাছে প্রকাশিত হলেন। তারা গিয়ে অন্য সকলকে এই কথা জানালেন, কিন্তু তাঁদের কথাতেও তাঁরা বিশ্বাস করলেন না।’’ (মার্ক ১৬/১০-১৩, মো.-১৩)
(ঞ) সর্বশেষ যখন তাঁরা তাঁকে দেখলেন তখনও তাঁরা ভুত দেখেছেন বলে ভয় পেলেন; কিন্তু তাঁর পুনরুত্থানের প্রতিশ্রুতি তাদের মনে পড়ল না! ‘‘তাঁরা পরস্পর এসব কথাবার্তা বলছেন, ইতোমধ্যে তিনি নিজে তাঁদের মধ্যস্থানে দাঁড়ালেন ও তাঁদেরকে বললেন: ‘তোমাদের শান্তি হোক’। এতে তাঁরা ভীষণ ভয় পেয়ে ও আতঙ্কিত হয়ে মনে করলেন, রূহ (ভূত) দেখছি।’’ (লূক ২৪/৩৬-৩৭, মো.-১৩)
অর্থাৎ, প্রেরিতরা সামান্যতম প্রত্যাশাও করতেন না যে, যীশু ফিরবেন।
(ট) এ হল পুনরুত্থানের দিনে জেরুজালেমের সাক্ষাৎ। গালীলের সাক্ষাতের সময়েও কেউ কেউ সন্দেহ করছেন। মথি বলেন: ‘‘পরে এগার জন সাহাবী গালীলে ঈসার নির্ধারিত পর্বতে গমন করলেন, আর তাঁকে দেখে সেজদা করলেন; কিন্তু কেউ কেউ সন্দেহ করলেন।’’ (মথি ২৮/১৬-১৭, মো.-১৩)
(ঠ) মৃত্যুর পর মহাপুরুষদের উঠে আসার বিশ্বাস ইহুদিদের মধ্যে ছিল বলেই ইঞ্জিল লেখকরা আমাদের জানিয়েছেন। যীশু তাঁর শিষ্যদের কাছে জানতে চান, মানুষেরা তাঁর সম্পর্কে কী বলে? উত্তরে তাঁরা বলেন: ‘‘কেউ কেউ বলে আপনি বাপ্তিস্মদাতা ইয়াহিয়া; কেউ কেউ বলে আপনি ইলিয়াস; আর কেউ কেউ বলে, আপনি ইয়ারমিয়া কিম্বা নবীদের কোন এক জন।’’ (মথি ১৬/১৪; মার্ক ৮/২৮) লূকের ভাষায়: ‘‘বাপ্তিস্মদাতা ইয়াহিয়া; কিন্তু কেউ কেউ বলে, আপনি ইলিয়াস; আর কেউ কেউ বলে, পূর্বকালীন নবীদের একজন জীবিত হয়ে উঠেছেন।’’ (লূক ৯/১৯, মো.-১৩)
বাপ্তিস্মদাতা ইয়াহিয়াকে হত্যা করার পরে রাজা হেরোদ যখন যীশুর অলৌকিক কর্মকাণ্ডর কথা শুনেন তখন ভাবেন যে নিহত ইয়াহিয়া বোধহয় পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন। ‘‘আর, যা যা হচ্ছিল, বাদশাহ হেরোদ সমস্তই শুনতে পেলেন এবং তিনি বড় অস্থির হলেন, কারণ কেউ কেউ বলিত, ইয়াহিয়া মৃতদের মধ্য থেকে উঠেছেন; আর কেউ কেউ বলত, ইলিয়াস দর্শন দিয়েছেন; এবং কেউ কেউ বলত, পূর্বকালীন নবীদের একজন মৃতদের মধ্য থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন।’’ (লূক ৯/৭-৮, মো.-১৩)
তাহলে মৃত নবীদের বেঁচে উঠার বিশ্বাস ইহুদি সমাজে ছিল। এরপরও যীশুকে দেখে ভূত দেখছি মনে করে আতঙ্কিত হয়ে গেলেন তাঁরা!
(ড) লূক (২৪/১৩-৩৩) লেখেছেন: কবর থেকে উঠার পর যীশু ইম্মায়ু গ্রামে গমনরত দুজন শিষ্যকে সাক্ষাৎ দিলেন ও পথ চলতে চলতে অনেক গল্প করলেন। শিষ্যদ্বয় তাঁকে চিনতে পারেননি। পারিপার্শ্বিক বিষয় সম্পর্কে যীশু অজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং কি ঘটছে তা জানতে চান। তখন শিষ্যরা বলেন: ‘‘নাসরতীয় ঈসা বিষয়ক ঘটনা, যিনি আল্লাহর ও সব লোকের সাক্ষাতে কাজে ও কথায় পরাক্রমী নবী ছিলেন; আর কিভাবে প্রধান ইমামেরা ও আমাদের নেতৃবর্গরা প্রাণদ- দেবার জন্য তুলে দিলেন ও ক্রুশে হত্যা করালেন। কিন্তু আমরা আশা করছিলাম যে, তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি ইসরাইলকে মুক্ত করবেন (redeemed Israel)।’’ (লূক ২৪/১৯-২১, মো.-১৩)
এ কথা থেকে পাঠক কী বুঝলেন?
ইহুদি জাতি রোমানদের কাছে তাদের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র হারিয়েছিল। পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ ও বিজাতীয়দের নিপীড়নে অস্থির স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় স্বাধীনতাপ্রিয় ইহুদি জাতি গভীর আগ্রহে প্রতিশ্রুত মাসীহের অপেক্ষা করছিল, যিনি বিদেশী শত্রুদের হটিয়ে ইহুদিদের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবেন। যীশুর শিষ্যরা সর্বদা যীশুকে সে প্রতিশ্রুত ‘নবী মসীহ’ বলেই আশা করেছেন, যিনি ইহুদিদের হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করবেন। কখনোই তাঁকে ‘ঈশ্বরের একজাত পুত্র’ ও ‘মানুষদের পাপমুক্তির জন্য জীবনদানকারী’ মসীহ হিসেবে বিশ্বাস করেননি। এ জন্য তাঁর মৃত্যু ছিল তাঁদের কাছে অকল্পনীয় আঘাত। তিনি যখন রাজ্য উদ্ধারের পরিবর্তে নিজেই গ্রেফতার হলেন তখন তাঁদের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু ঘটতে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাঁরা পালিয়ে গেলেন এবং আর তাঁর কাছে ফিরলেন না। তাঁরা প্রিয় গুরুর জন্য শোক করছিলেন, কিন্তু তাঁর পুনরুত্থানের কোনোরূপ আশা করছিলেন না।
ইঞ্জিলের বর্ণনায় যীশু শিষ্যদেরকে অনেকবার স্পষ্ট করে তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা জানিয়েছেন। ইঞ্জিল লেখকদের কথা সত্য হলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, যীশুর শিষ্যরা এমন মাত্রার নির্বোধ ছিলেন যে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে প্রিয়তম গুরু বারবার যে কথা বলেছেন, এক দিন আগেও যে কথা বলেছেন সে কথাও তাঁরা মনে রাখতে পারতেন না। তাঁরা বুঝতেন না, মনে রাখতেন না এবং বিশ্বাসও করতেন না। যীশুর শিষ্যদের প্রতি এরূপ অশোভন ধারণা করার চেয়ে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর অজ্ঞাত পরিচয় লেখকদের প্রতি অবিশ্বাস করা অধিক শোভনীয় ও যৌক্তিক। মানুষদের পাপের জন্য হত হওয়া ও তিন দিন পরে উঠার যে কথাগুলো যীশুর নামে তাঁরা লেখেছেন সেগুলো সবই পরের যুগের মানুষদের বানানো কথা যা তারা সংকলন করেছেন।
(ঢ) ইঞ্জিলের বর্ণনা অনুসারে গ্রেফতারের আগের দিন পর্যন্ত যীশু ছিলেন হাজার হাজার মানুষের প্রাণপ্রিয় গুরু। হাজার হাজার মানুষ তাঁর অলৌকিক কর্ম দেখে বিশ্বাস করছেন, পিছনে চলছেন ও গুণকীর্তন করছেন। ঠিক পরদিন তিনি একজন পরিত্যক্ত ব্যক্তি। ইহুদি গুরুদের কথা মত জেরুজালেমের জনগণ সবাই তাঁকে হত্যা করার জন্য উদগ্রীব। স্বয়ং গভর্নর পীলাত তাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন কিন্তু জনগণ কেউই তাঁর মুক্তি মেনে নিচ্ছেন না। বরং সকলেই যে কোনো মূল্যে তাঁর মৃত্যু চাচ্ছেন।
‘‘তারা সকলে বলল, ওকে ক্রুশে দেওয়া হোক। তিনি (পীলাত) বললেন, কেন? সে কি অপরাধ করেছে? কিন্তু তারা আরও চেঁচিয়ে বললো, ওকে ক্রুশে দেওয়া হোক। পীলাত যখন দেখলেন তাঁর চেষ্টা বিফল, বরং আরও গোলোযোগ হচ্ছে, তখন পানি নিয়ে লোকেদের সাক্ষাতে হাত ধুয়ে বললেন, এই ধার্মিক ব্যক্তির রক্তপাতের সম্বন্ধে আমি নির্দোষ, তোমরাই তা বুঝবে। তাতে সমস্ত লোক জবাবে বললো, ওর রক্ত আমাদের উপরে ও আমাদের সন্তানদের উপর বর্তুক।’’ (মথি ২৭/২২-২৫, মো.-১৩)
বিষয়টা এক কথায় অবিশ্বাস্য। যীশুর হাজার হাজার ভক্ত কোথায় গেলেন? কেউই কি সত্য সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসলেন না? ইহুদি গুরুদের ভয় কোনো অজুহাতই নয়। রোমান শাসনাধীনে ইহুদি প্রধানদের তেমন কোনো ক্ষমতাই ছিল না। ইহুদি প্রধানরাই জনগণের বিরুদ্ধতার ভয় পেতেন বলে ইঞ্জিলেও উল্লেখ করা হয়েছে। (মথি ২৬/৫) বিশেষত স্বয়ং গভর্নর যীশুর পক্ষে, তারপরও কেউ তাঁর পক্ষে বললেন না?
যে কোনো বিচারে ইঞ্জিলের সামগ্রিক বর্ণনা অতি-নাটুকে ও কল্পকাহিনী পর্যায়ের। কোনো বাস্তব ঐতিহাসিক বর্ণনা এরূপ হতে পারে না। আমরা দেখেছি যে, প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে খ্রিষ্টধর্ম ইহুদি ধর্ম থেকে পৃথক একটা অ-ইহুদি বা রোমান ধর্মে পরিণত হয়। এ সময়ে ইহুদিদেরকে শত্রু এবং রোমানদেরকে বন্ধু হিসেবে গণ্য করতেন খ্রিষ্টানরা। এ সময়েই এ সকল ইঞ্জিল লেখা হয়। সম্ভবত যীশুর রক্তের জন্য ইহুদিদের দায়ী করা এবং রোমানদেরকে দায়মুক্ত করার জন্য এ জাতীয় গল্পগুলো ডালপালা ছাড়ায়।