মথি ২৭/৫০-৫৩ শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘পরে ঈসা আবার জোরে চিৎকার করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। আর দেখ, বায়তুল-মোকাদ্দসের পর্দা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চিরে দু’ভাগ হয়ে গেল, ভূমিকম্প হল ও শৈলগুলো বিদীর্ণ হল, এবং কবরগুলো খুলে গেল, আর অনেক পবিত্র লোকের দেহ জীবিত হয়ে উঠল; এবং তাঁর পুনরুত্থানের পর তাঁরা কবর থেকে বের হয়ে পবিত্র নগরে প্রবেশ করলেন, আর অনেক লোককে দেখা দিলেন।’’ (মো.-১৩)
বায়তুল মোকাদ্দসের পর্দা বিদীর্ণ হওয়ার কথা মার্ক (১৫/৩৮) ও লূক (২৩/৪৫) উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাকি বিষয়গুলো, অর্থাৎ পাথর ফেটে যাওয়া, কবর খুলে যাওয়া, মৃত লাশ বেরিয়ে আসা, জেরুজালেমে প্রবেশ করা, তথাকার অধিবাসীদের সাথে মৃতদের সাক্ষাত হওয়া ইত্যাদি বিষয় তারা উল্লেখ করেননি।
নিম্নের বিষয়গুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই কাহিনীটা ভুল ও ভিত্তিহীন:
প্রথমত: ক্রুশের পরদিন ইহুদিরা পীলাতকে বলেন: ‘‘হুজুর, আমাদের মনে পড়ছে, সেই প্রবঞ্চক জীবিত থাকতে বলেছিল, তিন দিনের পরে আমি জীবিত হয়ে উঠবো। অতএব তৃতীয় দিন পর্যন্ত তার কবর পাহারা দিতে হুকুম করুন।’’ (মথি ২৭/৬২-৬৪, মো.-১৩) মথিই উল্লেখ করেছেন যে, পীলাত এবং তার স্ত্রী যীশুকে হত্যা করতে রাজি ছিলেন না (মথি ২৭/১৭-২৫)। যদি এ সকল বিষয় সত্যই সংঘটিত হত, তবে ইহুদিদের জন্য এ কথা বলা সম্ভব হত না। যে সময়ে মন্দিরের পর্দা উপর হইতে নিচ পর্যন্ত চিরে দু’খান হয়ে রয়েছে, পাথরগুলো বিদীর্ণ হয়ে রয়েছে, কবরগুলো খোলা রয়েছে, মৃতরা জীবিতদের সাথে কথা বলেছেন, ভূমিকম্পের আতঙ্ক সকলের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, সে সময়ে তারা পীলাতের কাছে যেয়ে কিভাবে বলবেন যে, লোকটা প্রবঞ্চক ছিল। পীলাত তো প্রথম থেকেই তাকে হত্যা করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি এ সকল বিষয় দেখতে পেলে অবশ্যই ইহুদিদের উপর ক্ষিপ্ত হতেন ও তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলতেন। অনুরূপভাবে হাজার হাজার মানুষ তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলে ঘোষণা করত।
দ্বিতীয়ত: এগুলো অনেক বড় অলৌকিক নিদর্শন। যদি সত্যই এগুলো ঘটত তবে স্বভাবতই অনেক রোমান ও ইহুদি যীশুর উপর বিশ্বাস স্থাপন করত। যীশুর পুনরুত্থানের পরে, তাঁর প্রেরিত শিষ্যরা যখন পবিত্র আত্মায় পূর্ণ হলেন এবং বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন তখন মানুষেরা আশ্চর্যান্বিত ও চমৎকৃত হয়ে কমবেশি তিন হাজার লোক তাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং তাদের সাথে সংযুক্ত হন (প্রেরিত ২/১-৪১)। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার চেয়ে, ভূমিকম্প, মৃত লাশ জীবিত হয়ে উঠে আসা, কথা বলা ইত্যাদি অনেক বড় অলৌকিক নিদর্শন।
তৃতীয়ত: মথির দাবি অনুসারে এ বিষয়গুলো প্রকাশ্যে সকলেই অবলোকন করেছিলেন। অথচ একমাত্র মথি ছাড়া সে সময়ের অন্য কোনো ঐতিহাসিক বা ইঞ্জিল লেখক এ ঘটনাগুলো লিখলেন না! পরের যুগের কোনো ঐতিহাসিকও এ বিষয়ে কিছু লেখেননি। বিশেষত লূক ছিলেন আশ্চর্য ও অলৌকিক ঘটনাবলি সংকলনে অত্যন্ত আগ্রহী। তার লেখা ইঞ্জিলের প্রথম অধ্যায় এবং ‘প্রেরিতদের কার্য-বিবরণ’-এর প্রথম অধ্যায় থেকে জানা যায় যে, তিনি যীশুর সকল কর্মকান্ড ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে সবিশেষ অনুসন্ধান করতেন। এ কথা কিভাবে কল্পনা করা যায় যে, ইঞ্জিল লেখকরা সাধারণ ঘটনাগুলো লেখবেন, অথচ মথি ছাড়া কেউই এ অসাধারণ অলৌকিক ঘটনাগুলো লেখবেন না? মার্ক ও লূক মন্দিরের পর্দা ফেটে যাওয়ার কথা লেখবেন (মার্ক ১৫/৩৮ ও লূক ২৩/৪৫), অথচ বাকী অত্যাশ্চর্য ঘটনাগুলো সম্পর্কে কিছুই লেখবেন না?
চতুর্থত, মন্দিরের পর্দা ছিল অত্যন্ত পাতলা কাতান কাপড়ের (হিজরত/ যাত্রাপুস্তক ২৬/৩১-৩৫)। তাহলে ভূমিকম্পের ধাক্কায় মন্দিরের পর্দা উপর হতে নিচ পর্যন্ত চিরে দু’ভাগ হওয়ার অর্থ কী? আর যদি ভূমিকম্পের ধাক্কায় পর্দাটা এভাবে ফেটে যায় তাহলে মন্দিরের ভবনটা কিভাবে অক্ষত থাকল? অথচ পর্দা ছেড়ার কথা মথি, মার্ক ও লূক তিনজনেই লেখেছেন।
পঞ্চমত, ‘অনেক পবিত্র লোকের দেহ জীবিত হয়ে উঠা’ বাইবেলের অন্যান্য বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা ইতোপূর্বে বৈপরীত্য প্রসঙ্গে দেখেছি যে, নতুন নিয়মের বিভিন্ন পুস্তকে বারবার বলা হয়েছে যে, যীশুই মৃতদের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম পুনরুত্থিত হন। (প্রেরিত ২৬/২৩; ১ করিন্থীয় ১৫/২০-২৩; কলসীয় ১/১৮)। তাঁর পুনরুত্থানের তিন দিন আগে অনেক মানুষ জীবিত হয়েছেন বলে দাবি করা বাইবেলের অন্যান্য বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক।