যীশুর জন্ম বর্ণনায় মথির লেখা গণহত্যার কাহিনীটা ভিত্তিহীন গণ্য করেছেন অনেক গবেষক। এ কাহিনীর মূল বিষয় পূর্ব দেশের কয়েকজন পণ্ডিত একটা তারা দেখে জানতে পারেন যে, ‘ইহুদিদের রাজা’ মসীহ জন্মলাভ করেছেন। তাকে দেখার জন্য তারা জেরুজালেমে আগমন করেন। তারা মানুষদেরকে ইহুদিদের রাজার জন্মস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। তখন জুডিয়া বা এহুদা রাজ্যের রাজা ছিলেন হেরোদ। তিনি এবং জেরুজালেমের সকলে ভয়ে অস্থির হয়ে যান। রাজা ইহুদি পণ্ডিতদের প্রশ্ন করেন, মসীহ কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন। তারা বলেন, তিনি বৈথলেহেমে জন্মগ্রহণ করবেন। তখন রাজা পূর্বদেশীয় পণ্ডিতদের অনুরোধ করেন, তারা নবজাত শিশুটাকে সেজদা করে ফিরে এসে রাজাকে যেন তার ঠিকানা জানান, যেন রাজাও তাকে সেজদা করতে পারেন। পণ্ডিতরা স্বপ্নের মাধ্যমে জানেন যে, হেরোদ মূলত নবজাতক যীশুকে হত্যা করতে চান। এজন্য তারা  নবজাতক যীশুকে সেজদা করে নিজেদের দেশে ফিরে যান। হেরোদ বিষয়টা জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে বৈথলেহেম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ২ বছর বা কম বয়সের সকল পুত্র শিশুকে হত্যা করেন। এ বিষয়ে মথি ২/১৬ বলছে: ‘‘পরে হেরোদ যখন দেখলেন যে, তিনি পণ্ডিতগণ দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, তখন মহা ক্রুদ্ধ হলেন এবং সেই পণ্ডিতদের কাছে বিশেষ করে যে সময় জেনে নিয়েছিলেন, সেই অনুসারে দু’বছর ও তার অল্প বয়সের যত বালক বেথেলহেম ও তার সমস্ত পরিসীমার মধ্যে ছিল, লোক পাঠিয়ে তাদের সকলকে হত্যা করালেন।’’ (মো.-১৩)

ঐতিহাসিকভাবে, বুদ্ধি-বিবেচনায় এবং ইঞ্জিলের আলোকে এ কথাটা ভুল।

(ক) ঐতিহাসিকভাবে তথ্যটা অশুদ্ধ হওয়ার কারণ, গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য অ- খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকদের মধ্য থেকে কেউই এ ঘটনাটা লেখেননি। প্রথম খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর (৩৭-৯৫ খ্রি.) প্রসিদ্ধতম ইহুদি ঐতিহাসিক যোসেফাস (Flavius Josephus) বা অন্য কোনো সমসাময়িক ইহুদি ঐতিহাসিক এ ঘটনা উল্লেখ করেননি; অথচ এ সকল ইহুদি ঐতিহাসিক হেরোদকে জালিম হিসেবে চিত্রিত করেছেন এবং তার ছোট বড় সকল জুলুম ও অপরাধ বিস্তারিতভাবে লেখেছেন। নিরপরাধ কয়েক ডজন বা কয়েক শত শিশুকে হত্যা করা নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্করতম জুলুম। তা যদি প্রকৃতই ঘটে থাকত তাহলে এ সকল ঐতিহাসিক অবশ্যই তা বিস্তারিত বিবরণসহ লিখতেন। ঘটনার সমসাময়িক বা নিকটবর্তী সময়ের কোনো ঐতিহাসিক এ বিষয়ে কিছুই লেখেননি। পরবর্তী খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকরা একান্তই মথির এ কাহিনীর উপর নির্ভর করে লেখেছেন।

(খ) যুক্তির মাপকাঠিতেও বর্ণনাটা অসত্য। নিম্নের তিনটা বিষয় বিবেচনা করুন:

(১) মথির বর্ণনা অনুসারে যীশুর জন্মের পরপরই পূর্বদেশীয় পণ্ডিতরা এসেছিলেন। তাহলে রাজা হেরোদ হত্যাকাণ্ড-র জন্য দু বছর অপেক্ষা করলেন কেন?

(২) মথির বর্ণনা অনুসারে হেরোদ ও জেরুজালেমের সকলেই আতঙ্কিত যে, মসীহের জন্ম হয়েছে, যিনি ইহুদিদের রাজা হবেন। তারা এটাও নিশ্চিত হন যে, তার জন্ম হয়েছে বৈৎলেহমে। রাজা হেরোদ ‘মহান হেরোদ’ (Herod the Great) উপাধিতে ভুষিত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও জালিম ছিলেন। মথির বর্ণনা যদি সত্য হত তবে তিনি পূর্বদেশীয় পণ্ডিতদের উপর নির্ভর না করে নিজের গোয়েন্দাদের লাগিয়ে নিজেই অতি সহজে জেনে নিতে পারতেন যে, শিশুটা কে এবং তাকে হত্যা করতে পারতেন। তিনি পণ্ডিতদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা না করে তার দু’চার জন গোয়েন্দা তাদের পিছনে লাগিয়ে দিতেন।

(৩) বৈৎলেহম একটা ছোট্ট শহর ছিল, কোনো বড় শহর ছিল না, আর তা ছিল  হেরোদের রাজধানী জেরুজালেমের কাছেই, কোনো দূরবর্তী শহর ছিল না। শহরটা ছিল হেরোদের নিয়ন্ত্রণাধীন, অন্য কারো নিয়ন্ত্রণে ছিল না। যদি পণ্ডিতদের উপরে নির্ভর করে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা সত্য হত তবে হেরোদের পক্ষে খুবই সহজ ছিল যে, তিনি নিজের রাজধানীর নিকটবর্তী নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন এই ছোট্ট জনপদটাতে খোঁজ নিয়ে জেনে নেবেন যে, পণ্ডিতরা কার বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং কার পুত্র কাকে তারা উপহারাদি প্রদান করেছিলেন। কাজেই নিরপরাধ নিষ্পাপ শিশুদেরকে বধ করার তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কোনো মহা জালিম শাসকও চায় না যে, অকারণে শাসিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনরোষ সৃষ্টি হোক। যীশুর ক্রশবিদ্ধ করার বিষয়ে বাইবেলের বর্ণনা থেকে আমরা দেখি যে, রোমান গভর্নর যীশুকে নিরপরাধ মনে করতেন এবং তাঁকে শাস্তি প্রদানে আগ্রহী ছিলেন না, ইহুদি জনমতের প্রতি লক্ষ্য রেখে যীশুকে শাস্তি দেন। তাহলে আমরা কিভাবে কল্পনা করতে পারি যে, একেবারেই অপ্রয়োজনে জালিম শাসক অগণিত নিরপরাধ শিশুকে বধ করে ইহুদি জনগোষ্ঠীকে ক্ষিপ্ত করবেন?

(গ) ইঞ্জিলের বর্ণনার আলোকেও ঘটনাটা মিথ্যা। লূকের বর্ণনা দু’দিক থেকে মথির বর্ণনাকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করে।

(১) গণহত্যার বিষয়ে লূক একটা শব্দও লেখেননি। এটা প্রমাণ করে যে, মথির গল্প ভিত্তিহীন। সকল খ্রিষ্টান পণ্ডিত একমত যে, মথির ইঞ্জিলের অনেক পরে লূকের ইঞ্জিল লেখা। লূক তার ইঞ্জিলের প্রথমেই উল্লেখ করেছেন যে, যীশুর বিষয়ে বর্ণিত ও প্রচলিত সকল তথ্য বিবেচনা ও গবেষণা করে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। গণহত্যা যদি সত্যই ঘটত তবে নিঃসন্দেহে প্রথম শতকের ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ থাকত এবং লূক তা জানতেন। এছাড়া সত্যই যদি মথির ইঞ্জিল শিষ্য মথির লেখা হতো তবে নিশ্চয় যীশু বিষয়ক প্রচলিত সকল তথ্যের মধ্যে এ ‘ইঞ্জিলটিও’ লূক পড়েছিলেন। তাহলে তিনি গণহত্যার বিষয়ে একটা শব্দও লেখলেন না কেন?

লূক যীশুর জন্মের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। হেরোদে ও অন্যান্য প্রসঙ্গে অনেক ক্ষুদ্র ও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি বিস্তারিত লেখেছেন। কিন্তু গণহত্যা এবং এ গণহত্যা থেকে শিশু যীশুকে রক্ষা করার অলৌকিক বিষয়ে তিনি কিছুই লেখেননি। এর কারণ দুটোর একটা: (১) তিনি গণহত্যার বিষয়টা মথিতে পড়েছিলেন কিন্তু তার গবেষণায় তা ভিত্তিহীন ও অসত্য হওয়ার কারণে তা লেখেননি। (২) অথবা আদৌ তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তার ইঞ্জিল রচনার পরে এ সকল গল্প সমাজে ছড়িয়েছে এবং মথির নামে লেখা ইঞ্জিলে তা লেখা হয়েছে।

(২) লূক যা লেখেছেন তা নিশ্চিত করে যে, মথির লেখা শিশু-গণহত্যার এ কাহিনী অসত্য। লূক দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন যে, যীশুর জন্মের পরেই ফেরেশতারা রাখালদেরকে সংবাদ দেন যে মসীহের জন্ম হয়েছে এবং রাখালরা যীশুকে দেখে নিশ্চিত হয়ে তা বলাবলি করতে থাকেন। লূক আরো লেখেছেন যে, যীশুর জন্ম-পরবর্তী পবিত্রতা লাভ করার পরেই তাঁর পিতামাতা তাকে নিয়ে জেরুজালেমে উপাসনাগৃহে (বায়তুল মোকাদ্দসে) গমন করেন এবং সেখানে কুরবানী দেন। তখন ‘শিমিয়োন (শামউন) নামক ব্যক্তি‘ যিনি ‘‘ধার্মিক ও ভক্ত... এবং পবিত্র আত্মা তাঁহার উপরে ছিলেন। আর পবিত্র আত্মা দ্বারা তাঁহার কাছে প্রকাশিত হইয়াছিল যে, তিনি প্রভুর খ্রিষ্টকে দেখিতে না পাইলে মৃত্যু দেখিবেন না’’ সে ব্যক্তি পবিত্র আত্মায় পূর্ণ হয়ে বায়তুল মোকাদ্দসে প্রবেশ করেন এবং যীশুকে তার কোলে তুলে নেন। তিনি সেখানে যীশুর গুণাবলি বর্ণনা করেন। অনুরূপভাবে হান্না নাম্মী এক বৃদ্ধা নবী ‘‘সেই দন্ডে উপস্থিত হইয়া ঈশ্বরের ধন্যবাদ করিলেন, এবং যত লোক যিরূশালেমের মুক্তির অপেক্ষা করিতেছিল, তাহাদিগকে যীশুর কথা বলিতে লাগিলেন।’’ (লূক ২/২২-৩৮)

এ বিবরণ প্রমাণ করে যে মথির কাহিনী অসত্য। কারণ জেরুজালেমবাসী সকলেই বা অনেকেই তাঁর বিষয় জানতেন। হেরোদ বা অন্য কেউ তার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন না। আর যদি সত্যই হেরোদ তাঁকে হত্যা করতে চাইতেন তবে সহজেই তাকে চিনে নিতে পারতেন। পূর্বদেশীয় পণ্ডিতদের উপর নির্ভর করার বা অকারণে অনেকগুলো শিশু হত্যা করার কোনোই প্রয়োজনীয়তা ছিল না।