পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৯. ৩৯. শনিবার পালন চিরস্থায়ী না অস্থায়ী বিধান?

পবিত্র বাইবেলের কোথাও বলা হয়েছে যে, শনিবার কর্মহীন বিশ্রাম পালন অলঙ্ঘনীয়, কোথাও বলা হয়েছে তা প্রয়োজনীয় তবে এ দিনে মানুষের কল্যাণের কর্ম করা যেতে পারে এবং কোথাও বলা হয়েছে তা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। একই ধর্মগ্রন্থে একই বিষয়ে আমরা সাংঘর্ষিক বিধান দেখতে পাই।

বাইবেলে বারবার বলা হয়েছে যে, শনিবার (the sabbath of the LORD)-কে সম্মান করা এবং এ দিনে সকল প্রকার কাজকর্ম বন্ধ রাখা একটা অলঙ্ঘনীয় চিরস্থায়ী বিধান ও নিয়ম (a perpetual covenant) (যাত্রাপুস্তক ৩১/১৬)। বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে স্রষ্টা ছয় দিনে (রবি-শুক্র) মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিন (শনিবার) বিশ্রাম করেন। এজন্য সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি এ দিবসটাকে সম্মানিত ও আশীর্বাদপুষ্ট করেছেন। কেউ এ দিনে সামান্যতম কর্মও করতে পারবেন না, এমনকি এ দিনে প্রয়োজনে আলো জ্বালানো বা চুলায় আগুন ধরানোও নিষিদ্ধ। কেউ যদি এ দিনে কোনো প্রকারের কর্ম করেন তবে তাকে তাৎক্ষণিক পাথর মেরে হত্যা করতে হবে। পুরাতন নিয়মের পুস্তকাদির বিভিন্ন স্থানে বারবার এ বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন: আদিপুস্তক ২/৩; যাত্রাপুস্তক ২০/৮-১১, ২৩/১২ ও ৩৪/২১; ৩৫/১-৩; লেবীয় ১৯/৩ ও ২৩/৩; দ্বিতীয় বিবরণ ৫/১২-১৫; যিরমিয় ১৭/১৯-২৭; যিশাইয় ৫৬/১-৮ ও ৫৮/১৩-১৪; নহিমিয় ৯/১৪; যিহিষ্কেল ২০/১২-২৪।

এ দিনে সামান্য কর্ম করলেই তাকে হত্যা করতে হবে (যাত্রাপুস্তক ৩১/১২-১৭ ও ৩৫/১-৩)। মূসার (আ.) সময়ে ইহুদিরা এক শনিবারে এক ব্যক্তিকে কাঠ সংগ্রহ করতে দেখেন। তখন তারা সেই কাঠ সংগ্রহকারীকে আটক করেন এবং সদাপ্রভুর নির্দেশে তাকে পাথর মেরে হত্যা করেন। (গণনা পুস্তক ১৫/৩২-৩৬)

তৌরাতের চিরস্থায়ী ‘দশ আজ্ঞা’-র অন্যতম শনিবার পালন। যাত্রাপুস্তক ২০/১-১১ পাঠ করলে দেখবেন যে, দশ আজ্ঞার ৪র্থ আজ্ঞা শনিবার পালন। তবে এ চতুর্থ আজ্ঞাটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ১০ আজ্ঞার মধ্যে ৪র্থ আজ্ঞাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা দেখেছি যে, যীশু খ্রিষ্ট তৌরাতের বিধানগুলো পূর্ণভাবে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশের মধ্যে ৪র্থ ও অন্যতম বিধান শনিবার পালনও রয়েছে। তিনি নিজেও শনিবার পালন করতেন। শনিবারের বিধান যে মানুষের কল্যাণের জন্যই দেওয়া হয়েছে তাও তিনি বলেছেন। তিনি বলেন: ‘‘বিশ্রামবার মনুষ্যের নিমিত্তই হইয়াছে, মনুষ্য বিশ্রামবারের নিমিত্ত হয় নাই।’’ (মার্ক ২/২৭)। এজন্য যীশু শনিবার পালনের পাশাপাশি শনিবারে অসুস্থ মানুষকে দুআ করা বা ভাল কর্ম করা যায় বলে উল্লেখ করেছেন। (মার্ক ২/২৩-২৮)

এর বিপরীতে পল বলেন, শনিবার পালন একান্তই ব্যক্তিগত অভিরুচি মাত্র। এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো এক প্রকারের ইঙ্গিত বা ছায়া মাত্র। তিনি বলেন: ‘‘এক জন এক দিন হইতে অন্য দিন অধিক মান্য করে; আর এক জন সকল দিনকেই সমানরূপে মান্য করে; প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন মনে স্থিরনিশ্চয় হউক’’ ( রোমীয় ১৪/৫)। তিনি আরো বলেন: ‘‘অতএব ভোজন কি পান, কি উৎসব কি অমাবস্যা, কি বিশ্রামবার, এই সকলের সম্বন্ধে কেহ তোমাদের বিচার না করুক। এ সকল ত আগামী বিষয়ের ছায়ামাত্র, কিন্তু দেহ খ্রিষ্টের।’’ (কলসীয় ২/১৬)

একই ধর্মগ্রন্থে কোথাও এ বিধানকে চিরস্থায়ী এবং কোথাও একে ক্ষণস্থায়ী ও ব্যক্তিগত অভিরুচি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐশ্বরিক কর্ম তো দূরের কথা, মানবীয় কোনো কর্ম, বিধানগ্রন্থ বা সংবিধানে এরূপ বৈপরীত্য থাকলে তা নিন্দিত হবে।