পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৯. ৩৫. খতনা মুক্তির চিরস্থায়ী বিধান না চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধক

বাইবেল পাঠ করলে পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, ত্বকচ্ছেদ বা খতনা বাইবেলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইংরেজি কিং জেমস বাইবেল বা অথোরাইযড বাইবেলে ত্বকচ্ছেদ বা খতনা (circumcise, circumcised, circumcising, circumcision, uncircumcised, uncircumcision) এবং লিঙ্গত্বক, লিঙ্গাগ্রচর্ম বা  বা পুরুষাঙ্গের মাথার চামড়া  (foreskin, foreskins) বিষয়ক শব্দাবলি ১৫৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে।

বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুক্তি লাভের জন্য স্রষ্টা অবরাহামের সাথে যে প্রতিজ্ঞা, চুক্তি, সন্ধি বা নিয়ম (covenant/ testament) প্রতিষ্ঠা করেন তার অন্যতম বিষয় খাতনা বা ত্বকচ্ছেদ করা (circumcision)। এ বিধানকে বাইবেলে অলঙ্ঘনীয় চিরস্থায়ী বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ১৭ অধ্যায়ে বলা হয়েছে: ‘‘(১০) ‘‘তোমাদের সঙ্গে ও তোমার ভাবী বংশের সংঙ্গে কৃত আমার যে নিয়ম (covenant/ testament সন্ধি, প্রতিজ্ঞা)  তোমরা পালন করবে, তা এই, তোমাদের প্রত্যেক পুরুষের খৎনা করতে হবে। ... (১৩) ... আর তোমাদের দেহে বিদ্যমান আমার নিয়ম চিরকালের নিয়ম হবে (my covenant shall be in your flesh for an everlasting covenant)। (১৪) কিন্তু যার পুরুষাঙ্গের সম্মুখের চামড়া কাটা না হবে, এমন খৎনা-না-করানো পুরুষ নিজের লোকদের মধ্য থেকে উচ্ছিন্ন হবে (that soul shall be cut off from his people); কারণ সে আমার নিয়ম ভঙ্গ করেছে।’’

এভাবে বাইবেল খতনার বিধানকে ঈশ্বরের চিরস্থায়ী (everlasting) ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করছে। এ নিয়মের কোনো পুরাতন বা নতুন নেই। এটা চিরস্থায়ী। এটা এমন একটা অলঙ্ঘনীয় বিধান যা পালন না করলে উচ্ছিন্ন বা নিহত হতেই হবে।

এর বিপরীতে ‘প্রেরিত’ পুস্তকের ১৫ অধ্যায়ে যীশুর প্রেরিত বা সাহাবীরা এ চিরস্থায়ী বিধানকে ক্ষণস্থায়ী ও বর্জনযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যত্র বলা হয়েছে যে, খতনা করা অথবা না করা উভয়ই সমান বিষয়। বিষয়টা একেবারেই গুরুত্বহীন: ‘‘খৎনা কিছুই নয়, অখৎনাও নয়, কিন্তু নতুন সৃষ্টিই আসল বিষয়।’’ (গালাতীয় ৬/১৫)

বাইবেলের পূর্ববর্তী বক্তব্যের সাথে এ বক্তব্যের বৈপরীত্য সুস্পষ্ট। পূর্ববর্তী বক্তব্য থেকে জানা যায় যে খতনা করা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ চিরস্থায়ী বিধান, যা পালন না করলে উচ্ছিন্ন হতেই হবে। পক্ষান্তরে এখানে বিষয়টাকে ঐচ্ছিক বা একেবারেই গুরুত্বহীন বলা হচ্ছে। তবে বৈপরীত্য এখানেই শেষ নয়। বাইবেলেই অন্যত্র খাতনাকে মুক্তির চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘‘দেখ, আমি পৌল তোমাদেরকে বলছি, যদি তোমাদের খৎনা করানো হয়, তবে মসীহের কাছ থেকে তোমাদের কোনই উপকার হবে না  (ইংরেজি: if ye be circumcised, Christ shall profit you nothing অর্থাৎ: যদি তোমাদের খৎনা করানো হয় তবে খ্রিষ্ট তোমাদের কোনোই উপকার করবেন না)। (গালাতীয় ৫/২)

এ থেকে জানা যায় যে,খতনা করা শুধু গুরুত্বহীনই নয়; বরং ভয়ঙ্করতম মহাপাপ। কারণ, ব্যভিচার, হত্যা, অপবিত্র খাদ্যভক্ষণ ইত্যাদি অপরাধ করলে কেউ খ্রিষ্টের অনুগ্রহ বা মুক্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। কিন্তু ত্বকছেদ করলে খ্রিষ্ট তার আর কোনোই উপকার করবেন না। খতনাকৃত ব্যক্তির মুক্তির আর কোনোই আশা থাকে না। খ্রিষ্টের উপর বিশ্বাসেও তার লাভ হবে না।

কারণ হিসেবে পল বলেছেন, খতনা করলে তাকে তৌরাতের সকল বিধান ও শরীয়ত পালন করতেই হবে। আর তৌরাত ও শরীয়ত পালন করে মুক্তি অসম্ভব; কারণ শরীয়ত পাপের ও অভিশাপের উৎস (গালাতীয় ৩/২২; রোমীয় ৩/২০; গালাতীয় ৩/১০-১৩)। এজন্য খতনা করার পরে তাওরাতের বিধান পালনের ক্ষেত্রে ত্রুটিজনিত পাপ ঈসা মসীহের প্রতি বিশ্বাসের মাধ্যমে ক্ষমা হবে না।  পক্ষান্তরে খতনা না করলে তাকে আর তৌরাতের কোনো বিধান মানতে হবে না। শুধু খৃস্টে বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই সে মুক্তি লাভ করবে। পল বলেন: ‘‘যে কোন মনুষ্য ত্বকচ্ছেদ প্রাপ্ত হয়, ... সে ঋণশোধের ন্যায় সমস্ত ব্যবস্থা পালন করিতে বাধ্য।’’ কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: ‘‘যাকে খৎনা করানো হয় সে সমস্ত শরীয়ত পালন করতে বাধ্য।’’ (গালাতীয় ৫/৩)

একই পুস্তকে একই বিধান কোথাও মহাগুরুত্বপূর্ণ চিরস্থায়ী বিধান, কোথাও গুরুত্বহীন এবং কোথাও মুক্তির চিরস্থায়ী বাধা হিসেবে উল্লেখ করা কিভাবে সম্ভব? ঐশী পুস্তক তো দূরের কথা কোনো মানবীয় কর্মে কি এরূপ বৈপরীত্য থাকা উচিত?

বাইবেলে এ প্রসঙ্গে আরেকটা বৈপরীত্য বা বৈচিত্র্য আমরা দেখি। এখানে সাধু পল বলেছেন যে, খতনা করলে যীশু তার কোনোই কাজে লাগবেন না। কিন্তু তিনি নিজেই কাউকে কাউকে যীশুর প্রতি বিশ্বাসের পরেও খতনা দিয়েছেন। প্রেরিত পুস্তকের ১৬ অধ্যায় লেখেছে: ‘‘পরে তিনি (সাধু পল) দর্বীতে ও লূস্ত্রায় উপস্থিত হলেন। আর দেখ, সেখানে তীমথি নামে এক সাহাবী ছিলেন। তিনি এক ঈমানদার ইহুদী মহিলার পুত্র, কিন্তু তাঁর পিতা গ্রীক; লুস্ত্রা ও ইকনীয়-নিবাসী ভাইয়েরা তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিত। পৌলের ইচ্ছা হল, যেন সেই ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে গমন করেন; আর তিনি ঐ সমস্ত স্থানের ইহুদীদের জন্য তাঁকে নিয়ে তাঁর খৎনা করলেন; কেননা তাঁর পিতা যে গ্রীক, তা সকলে জানতো।’’ (প্রেরিত ১৬/১-৩, মো.-১৩)

এভাবে পল নিজেই এ ঈমানদার সাহাবীকে খতনা করাচ্ছেন। তাঁর নিজের বক্তব্য অনুসারে তিনি নিজেই এ সাহাবীর জন্য যীশুর কল্যাণ লাভের দরজা চিরতরে রুদ্ধ করে দিলেন। তীমথির জন্য তৌরাত ও শরীয়তের বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করা ঋণশোধের মত জরুরি হয়ে গেল। আর শরীয়ত পালনের মাধ্যমে তার জন্য পাপ ও অভিশাপ পাওনা হবে। যীশু খ্রিষ্ট থেকে সে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হল!

বাইবেলের ভাষায় তিনি সে এলাকায় বসবাসরত ‘ইহুদিদের কারণে’ (because of the Jews) এরূপ করেছিলন। ইহুদিদের ভয়ে বা ইহুদিদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি একজন মানুষের মুক্তির পথ বন্ধ করলেন, তার জন্য শরীয়ত পালন আবশ্যক করে দিলেন এবং সর্বোপরি তাকে যীশুর কল্যাণ থেকে চিরতরে বঞ্চিত করলেন!