উপরের পর্যালোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান একটা লক্ষণীয় বৈপরীত্য বিশ্বাস ও কর্ম বা ঈমান ও শরীয়তের সর্ম্পক। পুরাতন নিয়মের সর্বত্র ঈমান ও শরীয়তপালন অবিচ্ছেদ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানবিহীন শরীয়তপালন অথবা শরীয়তবিহীন ঈমান থাকতে পারে বলে তৌরাত ও পুরাতন নিয়মের পাঠক কল্পনাই করতে পারেন না। আমরা দেখলাম যে, যীশুও তৌরাত ও শরীয়ত পরিপূর্ণ পালনে ইহুদি আলিম ও ধার্মিকদের চেয়ে অধিকতর নিষ্ঠাবান হওয়া মুক্তির জন্য জরুরী বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা আরো দেখেছি যে, পল শরীয়ত পালনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন। বৈপরীত্যের এ দিকটা আমরা দেখলাম।
এ বৈপরীত্যের অন্য দিক পল ও যাকোবের বৈপরীত্য। পল ঈমানের সাথে শরীয়তের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, কর্মের বিধান নয় বিশ্বাসের বিধান দিয়েই মুক্তি। পক্ষান্তরে যাকোব শরীয়ত বিহীন ঈমান বা কর্মবিহীন ঈমানের কোনোরূপ কল্যাণ বা কার্যকারিতা অস্বীকার করেছেন। দুজন ধার্মিক মানুষের মত ও বক্তব্য হিসেবে এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে সমস্যা হয় যখন তাঁদের বক্তব্যকে পবিত্র আত্মা বা ঐশী প্রেরণায় লেখা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কারণ, সেক্ষেত্রে উভয় পুস্তকের লেখকই ‘পবিত্র আত্মা’ এবং একই লেখকের লেখা একই ধর্মগ্রন্থের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য থাকা অগ্রহণযোগ্য। এ বিষয়ে পলের কয়েকটা বক্তব্য দেখুন:
(ক) ‘‘শরীয়ত পালন করা ছাড়া ঈমান দ্বারাই মানুষ ধার্মিক বলে পরিগণিত হয়।’’ (রোমীয় ৩/২৮: মো.-১৩। পুনশ্চ রোমীয় ১০/১০)।
(খ) ‘‘শরীয়ত পালনের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন না, বরং ঈসা মসীহের উপর ঈমানের জন্যই তা করেন। ... শরীয়ত পালন করবার ফলে কাউকেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে না।’’ (গালাতীয় ২/১৬: মো.-০৬)।
(গ) ‘‘শরীয়ত পালন করবার জন্য আল্লাহ কাউকে ধার্মিক বলে গণ্য করেন না, কারণ পাক-কিতাবের কথামত, ‘যাকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হয় সে ঈমানের মধ্য দিয়েই জীবন পাবে।’ ঈমানের সংগে শরীয়তের কোন সম্বন্ধ নেই। শরীয়ত বরং বলে, ‘যে লোক শরীয়ত মত চলে সে তার মধ্য দিয়েই জীবন পাবে।’ শরীয়ত অমান্য করার দরুন যে বদদোয়া আমাদের উপর ছিল মসীহ সেই বদদোয়া নিজের উপর নিয়ে আমাদের মুক্ত করেছেন।...’’ (গালাতীয় ৩/১১-১৩ মো.-০৬)
(ঘ) ‘‘অতএব গর্ব করার আর কি আছে? কিছুই নেই। কিরূপ শরীয়ত দ্বারা? কাজের শরীয়ত দ্বারা? না, তা নয়; কিন্তু ঈমানের শরীয়ত দ্বারা। কেননা আমরা এই কথা জানি যে, শরীয়ত পালন করা ছাড়া ঈমান দ্বারাই মানুষ ধার্মিক বলে পরিগণিত হয়। ... তবে দৈহিক দিক থেকে আমাদের আদিপিতা যে ইবরাহিম তাঁর সম্বন্ধে কি বলবো, তিনি কি পেয়েছেন? কারণ ইবরাহিম যদি কাজের জন্যই ধার্মিক পরিগণিত হয়ে থাকেন, তবে গর্ব করার বিষয় তাঁর আছে; কিন্তু আল্লাহর কাছে তাঁর গর্ব করার কোন বিষয় নেই; কেননা পাক-কিতাব কি বলে? ‘ইবরাহিম আল্লাহর উপরে ঈমান আনলেন এবং সেই ঈমানই তাঁর পক্ষে ধার্মিকতা বলে পরিগণিত হল।’ যে কাজ করে, তার বেতন তো তার পক্ষে রহমতের বিষয় বলে নয়, কিন্তু প্রাপ্য বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের কাজের উপরে নির্ভর না করে যিনি ভক্তিহীনকে ধার্মিক বিবেচনা করেন কেবল তাঁরই উপর ঈমান আনে, তার সেই ঈমানই ধার্মিকতা বলে পরিগণিত হয়।’’ (রোমীয় ৩/২৭-২৮, ৪/১-৫, মো.-১৩)
(ঘ) ‘‘ব্যবস্থা খ্রিষ্টের কাছে আনিবার জন্য আমাদের স্কুল মাস্টার (our schoolmaster) যেন আমরা বিশ্বাস হেতু ধার্মিক গণিত হই।’’ (গালাতীয় ৩/২৪)। ‘‘শাস্ত্র সকলই পাপের অধীনতায় রুদ্ধ (শাস্ত্র, পাক-কিতাব বা বাইবেল সকলকে পাপের মধ্যে আবদ্ধ করেছে: the scripture hath concluded all under sin) (গালাতীয় ৩/২২)।
(ঙ) ‘‘বাস্তবিক যাহারা ব্যবস্থার ক্রিয়াবলম্বী (শরীয়ত পালনকারী), তাহারা সকলে শাপের অধীন; কারণ লেখা আছে, ‘ যে কেহ ব্যবস্থাগ্রন্থে লিখিত সমস্ত কথা পালন করিবার জন্য তাহাতে স্থির না থাকে, সে শাপগ্রস্ত।’’ (গালাতীয় ৩/১০)।
এর বিপরীতে যাকোব/ ইয়াকুব শরীয়ত-বিহীন ঈমান বা কর্ম ছাড়া ঈমানের দাবিকে মিথ্যা ও অকার্যকর বলে উল্লেখ করেছেন। সুনিশ্চিতভাবেই পলের মত খণ্ডন করতে যাকোব তাঁর পত্রটা লেখেছিলেন। কারণ, পাঠক দেখবেন যে, তিনি পলের বিভিন্ন ‘দলিল’ খণ্ডন করেছেন এ পত্রে। তাঁর পত্রের ২য় অধ্যায়ে তিনি বলেন:
‘‘যা হোক, ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহববত কোরো’, পাক-কিতাবের এই কথা অনুসারে যদি তোমরা রাজকীয় শরীয়ত পালন কর, তবে ভাল করছো। কিন্তু যদি পক্ষপাতিত্ব কর, তবে গুনাহ করছো এবং শরীয়ত (the law: তৌরাত) দ্বারা তোমাদের হুকুম লঙ্ঘনকারী বলে দোষী করা হচ্ছে। কারণ যে কেউ সমস্ত শরীয়ত পালন করে, কেবল একটা বিষয়ে হোঁচট খায়, সে সকলেরই দায়ী হয়েছে। কেননা যিনি বলেছেন ‘জেনা করো না’, তিনিই আবার বলেছেন, ‘নরহত্যা করো না’; ভাল, তুমি যদি জেনা না করে খুন কর, তা হলে শরীয়তের লঙ্ঘনকারী হয়েছ। তোমরা স্বাধীনতার শরীয়ত (the law of liberty, মো.-০৬: যে আইন মানুষকে স্বাধীনতা প্রদান করে সেই আইন) দ্বারা বিচারিত হবে বলে তদনুরূপ কথা বল ও কাজ কর। কেননা যে ব্যক্তি করুণা করে নি, বিচার তার প্রতি নির্দয়; করুণাই বিচারের উপর জয়ী হয়।
হে আমার ভাইয়েরা, যদি কেউ বলে, আমার ঈমান আছে, আর তার কাজ না থাকে, তবে তাতে তার কি লাভ হবে? সেই ঈমান কি তাকে নাজাত দিতে পারে? ... ঈমানের সঙ্গে কাজ যুক্ত না থাকলে (বিশ্বাসও কর্মবিহীন হইলে) নিজে একা বলে তা মৃত। কিন্তু কেউ বলবে তোমার ঈমান আছে, আর আমার কাজ আছে; তোমার কাজ ছাড়া ঈমান আমাকে দেখাও, আর আমি তোমাকে আমার কাজের মধ্য দিয়ে ঈমান দেখাব। তুমি ঈমান এনোছে যে, আল্লাহ এক, ভালই করছো; বদ-রুহুরাও (শয়তানেরাও: the devils) তা বিশ্বাস করে এবং ভয়ে কাঁপে। কিন্তু হে অসার মানুষ, তুমি কি জানতে চাও যে, কাজ ছাড়া ঈমান (কর্মবিহীন বিশ্বাস) কোন কাজের নয়? আমাদের পিতা ইব্রাহিম তাঁর কাজের জন্য, অর্থাৎ কোরবানগাহর উপরে তাঁর পুত্র ইসহাককে কোরবানী করার জন্য কি ধার্মিক বলে গ্রহন করা হয়নি? তুমি দেখছো, ঈমান তাঁর কাজের সহকারী ছিল এবং কাজের জন্য তাঁর ঈমান সিদ্ধ হল; তাতে পাক কিতাবের এই কথা পূর্ণ হল, ‘ইব্রাহিম আল্লাহর উপরে ঈমান আনলেন এবং তা তাঁর পক্ষে ধার্মিকতা বলে গণনা করা হল’, .... তোমরা দেখছো, কাজের জন্য মানুষকে ধার্মিক বলে গণনা করা হয়, শুধু ঈমানের মধ্য দিয়ে নয়। ... বাস্তবিক যেমন রুহ ছাড়া দেহ মৃত, তেমন কাজ ছাড়া ঈমান মৃত।’’ (ইয়াকুব/ যাকোব ২/৮-২৬, মো.-১৩)
পাঠক দেখছেন যে, পলের মত ও ‘দলিল’ খণ্ডন করছেন যাকোব। সাধু পল বললেন, খৃস্টে বিশ্বাস তৌরাত ও শরীয়ত থেকে বিশ্বাসীকে মুক্ত করে। এর বিপরীতে যাকোব বললেন, খৃস্টে বিশ্বাস বিশ্বাসীকে ব্যবস্থা বা তৌরাত ও শরীয়তের সাথে সংযুক্ত করে। তাকে ব্যবস্থা পালন করতে হবে এবং ব্যবস্থা পালন বা লঙ্ঘনের ভিত্তিতেই তার বিচার হবে। এ পালন নিরপেক্ষ ও সার্বিক হতে হবে।
ব্যবস্থা বা শরীয়ত পুরোপুরি পালন নভ করলে শাস্তি পেতে হবে- এ নীতিকে পল ব্যবস্থা বাতিল করার অজুহাত হিসেবে পেশ করেছেন। পক্ষান্তরে এ নীতিকে যাকোব ব্যবস্থা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে পেশ করেছেন। কিছু মানলে হবে না; তুমি সব মানতে চেষ্টা কর। বিচারে দয়া পাওয়ার জন্য ব্যবস্থা লঙ্ঘন ও বাতিল নয়, বরং ব্যবস্থা পালনের সাথে তুমি দয়াশীল হও।
পলের মতে শরীয়ত পালন বা কর্মের সাথে বিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই। কর্মকারীর মনে কর্মের কারণে গৌরব বা অহঙ্কার আসতে পারে যে, সে দয়া নয়, পাওনা নিচ্ছে। এ জন্য যে কর্ম করে না কিন্তু ভক্তিবিহীনকেও যিনি ক্ষমা করেন তার উপর বিশ্বাস রাখে সে ব্যক্তিই সত্যিকারের ধার্মিক। পক্ষান্তরে যাকোব বলছেন যে, কর্ম বিহীন বিশ্বাস এবং আত্মাবিহীন দেহ একইরূপ মৃত। কর্ম বিহীন ঈমান কোনো কাজে লাগে না এবং কাউকে মুক্তি দিতে পারে না।
যাকোব পলের প্রমাণ খণ্ডন করছেন। পল দাবি করেছেন যে, ইবরাহিম (আ.) কর্ম হেতু ধার্মিক গণিত হননি; বরং শুধু বিশ্বাসের কারণে। পক্ষান্তরে যাকোব বলছেন যে, শুধু বিশ্বাসের কারণে তিনি ধার্মিক গণিত হননি; কর্ম তাঁর বিশ্বাসকে সিদ্ধ করার কারণেই তিনি ধার্মিক গণিত হন।
আরো লক্ষণীয়, পল ব্যবস্থা বা শরীয়তকে পরাধীনতা, পাপের মধ্যে আবদ্ধতা, ও শত্রুতা হিসেবে গণ্য করেছেন এবং যীশু তাঁর দেহ দ্বারা এ সকল থেকে স্বাধীনতা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। পক্ষান্তরে যাকোব তৌরাত ও শরীয়তকেই মূল স্বাধীনতা বলে দাবি করে শরীয়তকে ‘স্বাধীনতার শরীয়ত’ বা ‘স্বাধীনতা প্রদানকারী আইন’ (law of liberty) বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
সুপ্রিয় পাঠক, কোন্ মতটা সঠিক তা আমরা বিবেচনা করছি না। তবে ‘পবিত্র আত্মা’ নামক একই লেখক রচিত ‘বাইবেল’, পাক-কিতাব বা কিতাবুল মোকাদ্দস নামক একই ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিদ্যমান এ বৈপরীত্য, বিবাদ ও বিতর্ক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পবিত্র আত্মা কি নিজেই নিজের সাথে বিবাদ করেন?
উল্লেখ্য যে, প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মগুরু মার্টিন লুথার পলের অনুসারী ছিলেন। পাপ বর্জনের চেষ্টাকে তিনি মুক্তির প্রতিবন্ধক বলে গণ্য করেছেন এবং সাহসিকতার সাথে মহাপাপ করতে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন: “Be a sinner, and sin boldly, ... even if we were to fornicate thousand of times, even thousand times each day, or committed murder/ we commit fornication and murder a thousand times a day.” ‘‘পাপী হও এবং সাহসিকতার সাথে পাপ কর। ... এমনকি আমাদেরকে যদি প্রতিদিন হাজার বার ব্যভিচার করতে হয় এবং হাজার বার খুন করতে হয় তবুও।’’[1]
এজন্যই লুথার যাকোবের পত্রটার কঠোর সমালোচনা করতেন। রবার্ট বয়ড বলেন: “Martin Luther called the Epistle of James ‘a right epistle of straw’ ... Elsewhere he branded it as worthless”: ‘‘মার্টিন লুথার যাকোবের পত্রকে জঞ্জালের পত্র হিসেবেই সঠিক বলে উল্লেখ করেন। ... অন্যত্র তিনি একে অথর্ব বলেন।’’[2]
[2] A Brief History of the Bible http://liberalslikechrist.org/about/biblestats.html