ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনায় যীশু বারবার বলেছেন যে, তিনি ‘ব্যবস্থা’, অর্থাৎ তৌরাত ও শরীয়ত সংরক্ষণ করতে এসেছেন, বিলোপ বা বাতিল করতে আসেননি। তিনি বলেছেন: ‘‘মনে করো না যে, আমি শরীয়ত বা নবীদের কিতাব লোপ (destroy) করতে এসেছি; আমি তা লোপ করতে আসি নি, কিন্তু পূর্ণ (fulfil) করতে এসেছি। ... অতএব যে কেউ এসব ক্ষুদ্রতম হুকুমের মধ্যে কোন একটি হুকুম লঙ্ঘন (break) করে ও লোকদেরক তা লঙ্ঘন করতে শিক্ষা দেয়, তাকে বেহেশতী-রাজ্যে অতি ক্ষুদ্র বলা যাবে; কিন্তু যে কেউ সেসব পালন করে ও শিক্ষা দেয়, তাকে বেহেশতী-রাজ্যে মহান বলা যাবে। কেননা আমি তোমাদেরকে বলছি, আলেম ও ফরীশীদের চেয়ে তোমাদের ধার্মিকতা যদি বেশি না হয়, তবে তোমরা কোন মতে বেহেশতী-রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (মথি ৫/১৭-২০: কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩)
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬-এর অনুবাদ: ‘‘এই কথা মনে কোরো না, আমি তৌরাত কিতাব আর নবীদের কিতাব বাতিল করতে এসেছি.... তাই মূসার শরীয়তের মধ্যে ছোট একটা হুকুমও যে কেউ অমান্য করে এবং লোককে তা অমান্য করতে শিক্ষা দেয় তাকে বেহেশতি রাজ্যে সবচেয়ে ছোট বলা হবে। আমি তোমাদের বলছি, আলেম ও ফরীশীদের ধার্মিকতার চেয়ে তোমাদের যদি বেশী কিছু না থাকে তবে তোমরা কোনমতেই বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে না।’’
অন্যত্র যীশু বলেন: ‘‘কিন্তু শরীয়তের এক বিন্দু পড়ে যাওয়ার চেয়ে বরং আসমানের ও দুনিয়ার লোপ হওয়া সহজ।’’ (লূক ১৬/১৭: কি. মো.-১৩)।
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬-এর অনুবাদ নিম্নরূপ: ‘‘তবে তৌরাত শরীফের একটা বিন্দু বাদ পড়বার চেয়ে বরং আসমান ও জমীন শেষ হওয়া সহজ।’’
অন্যত্র যীশু সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, ইহুদি পণ্ডিত, আলিম ও ফরীশীরা যা হুকুম করেন সব কিছু মান্য করা খ্রিষ্টান বা যীশুর অনুসারীদের দায়িত্ব। ফরীশীদের কর্মের ভুলভ্রান্তির কারণে তাদের নির্দেশ অমান্য করা বৈধ নয়: ‘‘পরে ঈসা লোকদের কাছে ও তাঁর সাহাবীদের কাছে বললেন, ‘শরীয়ত শিক্ষা দেবার ব্যাপারে আলেমেরা ও ফরীশীরা মূসা নবীর জায়গায় আছেন। এজন্য তাঁরা যা কিছু করতে বলেন তা কোরো এবং যা পালন করবার হুকুম দেন তা পালন কোরো।’’ (মথি ২৩/১-৩)
যীশুর উপরের সকল কথা নিশ্চিত করে যে, যীশুর অনুসারী বা খ্রিষ্টানদের জন্য তৌরাত, শরীয়ত ও ফরীশীদের সকল নির্দেশ পালন করা বাধ্যতামূলক।
কিন্তু এর বিপরীতে সাধু পল সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, যীশু তৌরাত ও শরীয়ত বিলোপ করতে এসেছিলেন। তিনি বলেন: ‘‘শত্রুতাকে, বিধিবদ্ধ আজ্ঞাকলারূপ ব্যবস্থাকে নিজ মাংসে লূপ্ত করিয়াছেন (abolished in his flesh the enmity, even the law of commandments contained in ordinances)। অর্থাৎ মূসার শরীয়তের আজ্ঞা ও বিধানাবলি ছিল মানবসমাজে শত্রুতার মূল কারণ এবং যীশু নিজের দেহ দিয়ে এ শরীয়ত ও সকল হুকুম আহকাম বাতিল করেছেন। কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘তিনি তাঁর ক্রুশের উপরে হত্যা করা শরীরের মধ্য দিয়ে সমস্ত হুকুম ও নিয়ম সুদ্ধ মূসার শরীয়তের শক্তিকে বাতিল করেছেন’’ (ইফিষীয় ২/১৪-১৫)। কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: ‘‘তিনি শরীয়তের সমস্ত হুকুম ও অনুশাসনকে বাতিল করেছেন।’’
ইব্রীয় পুস্তকের বক্তব্য: ‘‘কারণ এক পক্ষে পূর্বকার বিধির দুর্বলতা ও নিষ্ফলতা প্রযুক্ত তাহার লোপ হইতেছে- কেননা ব্যবস্থা কিছুই সিদ্ধ করে নাই (On the one hand,a former commandment is set aside because of its weakness and uselessness, for the Law made nothing perfect)’’। (ইব্রীয় ৭/১৮-১৯)
অর্থাৎ তৌরাত ও শরীয়ত কোনো কিছুই সিদ্ধ করতে পারেনি; এজন্য দুর্বলতা ও নিষ্ফলতা হেতু তৌরাতের বিলোপ করা হয়েছে। কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘মূসার শরীয়ত কোন কিছুকেই পূর্ণতা দিতে পারেনি, তাই আগের ইমামের কাজের যে নিয়ম ছিল তা দুর্বল ও অকেজো বলে বাতিল করা হয়েছে।’’ কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: ‘‘কারণ এক দিকে আগের নিয়ম দুর্বল ও নিষ্ফফ ছিল বলে তা লোপ হচ্ছে- কেননা শরীয়ত কোন কিছুকেই পূর্ণতা দান করেনি।’’
সাধু পল তৌরাতের বিধানগুলোকে মানব রচিত বা হাতে লেখা বিধান বলে উপহাস করেছেন। তিনি বলেছেন যে, যীশু ক্রুশের পেরেকের সাথে এগুলোকে গেঁথে দিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেন: ‘‘আমাদের প্রতিকূল যে বিধিবদ্ধ হস্তলেখ্য (the handwriting of ordinances) আমাদের বিরুদ্ধে ছিল, তাহা তিনি মুছিয়া ফেলিয়াছেন, এবং প্রেক দিয়া ক্রুশে লটকাইয়া দূর করিয়া দিয়া ক্রুশেই সেই সকলের উপর বিজয়-যাত্রা করিয়া তাহাদিগকে স্পষ্টরূপে দেখাইয়া দিয়াছেন। অতএব ভোজন কি পান, কি উৎসব কি অমাবস্যা, কি বিশ্রামবার, এই সকলের সম্বন্ধে কেহ তোমাদের বিচার না করুক।’’ (কলসীয় ২/১৪-১৬)
তিনি বলেন: ‘‘তোমরা যখন জগতের অক্ষরমালা ছাড়িয়া খ্রিষ্টের সহিত মরিয়াছ, তখন কেন জগজ্জীবীদের ন্যায় এই সকল বিধির অধীন হইতেছ, যথা, ধরিও না, আস্বাদ লইও না, স্পর্শ করিও না? .. ঐ সকল বিধি মানুষ্যদের বিবিধ আদেশ ও ধর্মসূত্রের অনুরূপ।’’ (কলসীয় ২/২০-২২)
এখানে যীশুর বক্তব্য ও পলের বক্তব্যের মধ্যে বৈপরীত্য খুবই প্রকট। কার মত অধিক গ্রহণযোগ্য তা আমাদের বিবেচ্য নয়। আমরা দেখছি যে, একই ধর্মগ্রন্থের মধ্যে একই বিষয়ে সাংঘর্ষিক তথ্য প্রদান করা হয়েছে। যীশু নিজে নিজেকে তৌরাত ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং এর ক্ষুদ্রতম বিধানও পালনীয় বলে নির্দেশ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে পল যীশুকে সকল বিধান বিলোপকারী বলে উল্লেখ করেছেন। স্বাভাবিক বিচারে দুজনের একজনকে সত্যবাদী ও একজনকে মিথ্যাবাদী বলে মনে করতে হবে। তবে এখানে গ্রন্থ একটাই এবং লেখকও একজন: পবিত্র আত্মা।
এ প্রসঙ্গে LiberalsLikeChrist.Org ওয়েবসাইটের বক্তব্য:
“When it comes to the inspiration of the ‘Old Testament’, it's fascinating how everything in the Old Testament that they can use to torture other people is ‘the innerant word of God’, while anything that they don't understand or don't want applied to themselves, is dismissed in an instant with the mantra, ‘Christians are not bound by the Law. Jesus freed us from the ancient Law.’ There was no New Testament at all when Jesus said the following. He was speaking strictly of the Old Testament when he said: "Do not think that I came to abolish the Law or the Prophets...”
‘‘যখন পুরাতন নিয়মের ঐশ্বরিক প্রেরণার কথা আসে তখন অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখি যে, পুরাতন নিয়মের যে সকল বক্তব্য তারা অন্য মানুষদের নির্যাতন করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন তা সব কিছুই ‘ঈশ্বরের অভ্রান্ত বাণীতে’ পরিণত হয়। আর যা কিছু তারা বুঝেন না বা নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চান না সেগুলোকে তাৎক্ষণিক একটা মন্ত্র দিয়ে বাতিল করেন: ‘খ্রিষ্টানরা তৌরাত মানতে বাধ্য নন। যীশু আমাদেরকে প্রাচীন তৌরাত থেকে মুক্ত করেছেন।’ অথচ যীশু বলেন: ‘এই কথা মনে কোরো না, আমি তৌরাত কিতাব আর নবীদের কিতাব বাতিল করতে এসেছি.... ’ তিনি যখন এ কথাগুলো বলেছিলেন তখন ‘নতুন নিয়ম’ বলতে কিছুই ছিল না। তিনি সুনির্দিষ্টভাবেই পুরাতন নিয়মের উল্লেখ করে এ কথাগুলো বলেছিলেন।’’[1]