পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৭. ১২. যীশু প্রথম কাকে কোথায় সাক্ষাৎ দিলেন?

যীশুর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অলৌকিকত্ব মৃত্যুর পরে জীবিত হওয়া। আর এটা সর্বপ্রথম কে কোন স্থানে প্রত্যক্ষ করলেন তার বর্ণনায় পবিত্র পুস্তকের মধ্যে অবিশ্বাস্য বৈপরীত্য বিদ্যমান। কেউ বলছেন সর্বপ্রথম মগ্দলীনী মরিয়মকে কবরের পাশে, কেউ বলছেন, মগ্দলীনী মরিয়ম ও অন্য মরিয়মকে জেরুজালেমের পথে দৌড়ানোর সময়, কেউ বললেন, ক্লিয়পা ও অন্য শিষ্যকে ইম্মায়ূ গ্রামে যাওয়ার পথে এবং কেউ বললেন পিতরকে যীশু পুনরুত্থানের পর সর্বপ্রথম দেখা দেন। এত বড় ঘটনার বর্ণনায় ঐশ্বরিক প্রেরণায় লেখা ধর্মগ্রন্থ তো দূরের কথা সাধারণ ইতিহাস লেখকরা কি এরূপ সাংঘর্ষিক তথ্য দিতে পারেন? যদি এরূপ তথ্য দেওয়া হয় তবে তা মূল ঘটনাকেই কি কাল্পনিক বলে প্রমাণ করে না? এ বিষয়ে পবিত্র পুস্তকের বর্ণনাগুলো নিম্নরূপ:

(ক) মথির বর্ণনা অনুসারে দুই মরিয়ম: মগ্দলীনী মরিয়ম ও অন্য মরিয়ম স্বর্গদূতের মুখ থেকে যীশুর জীবিত হওয়ার সংবাদ জেনে শিষ্যদেরকে সংবাদ প্রদানের জন্য দৌড়াচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় যীশু তাদের দু’জনকে সাক্ষাৎ প্রদান করে বলেন ‘‘ভয় করো না; তোমরা গিয়ে ভাইদের গালীলে যেতে বল। তারা সেখানেই আমাকে দেখতে পাবে।’’ (মথি ২৮/৮-১০)

(খ) এর বিপরীতে যোহন লেখেছেন যে, যীশু সর্বপ্রথম একমাত্র মগ্দলীনী মহিলাকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন এবং তাঁর কবরের পাশেই তাকে দেখা দেন। এরপর সেদিনই সন্ধ্যায় অন্যান্য শিষ্যদের সাক্ষাৎ প্রদান করেন।

আমরা দেখলাম, মরিয়ম কবরের মুখ খোলা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পিতর ও অন্য শিষ্যকে সংবাদ দেন। তাঁরা কবর পরীক্ষা করে লাশ না দেখে ফিরে চলে যান। মরিয়ম কবরের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। ‘‘তিনি কাঁদতে কাঁদতে নীচু হয়ে কবরের ভিতরে চেয়ে দেখলেন, যীশুর দেহ যেখানে শোওয়ানো ছিল সেখানে সাদা কাপড় পরা দু’জন স্বর্গদূত বসে আছেন... তাঁরা মরিয়মকে বললেন, ‘কাঁদছ কেন?’ মরিয়ম তাঁদের বললেন, ‘লোকেরা আমার প্রভুকে নিয়ে গেছে এবং তাঁকে কোথায় রেখেছে জানি না।’ এ কথা বলে মরিয়ম পিছনে ফিরে দেখলেন যীশু দাঁড়িয়ে আছেন....। তখন মগ্দলীনী মরিয়ম শিষ্যদের কাছে গিয়ে সংবাদ দিলেন, তিনি প্রভুকে দেখেছেন... । সেই একই দিনে, সপ্তার প্রথম দিনের সন্ধ্যাবেলায় শিষ্যেরা যিহূদী নেতাদের ভয়ে ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ করে এক জায়গায় মিলিত হয়েছিলেন। তখন যীশু এসে তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমাদের শান্তি হোক’...।’’ (যোহন ২০/১১-১৯: বাইবেল-২০০০)

(গ) মার্কের ইঞ্জিলেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যীশু সর্বপ্রথম মগ্দলীনী মরিয়মকে দেখা দেন। (মার্ক ১৬/৯)। তবে মার্কের বর্ণনায় সাক্ষাতের স্থান ভিন্ন বলেই প্রতীয়মান হয়। তিনি লেখেছেন যে, মগ্দলীনী মরিয়ম, যাকোবের মা মরিয়ম ও শালোমী যীশুর কবরের মধ্যে ঢুকে স্বর্গদূতের কথা শুনে ‘‘কিছু বুঝতে না পেরে কাঁপতে কাঁপতে কবরের গুহা থেকে বের হয়ে আসলেন এবং সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। তারা এত ভয় পেয়েছিলেন যে, কাউকে কিছু বললেন না। সপ্তার প্রথম দিনের ভোর বেলায় যীশু মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠলেন। তিনি পরে মগ্দলীনী মরিয়মকে প্রথম দেখা দিলেন। (মার্ক ১৬/৮-৯) এতে প্রতীয়মান হয় যে, কবর থেকে পালিয়ে কাউকে কিছু না বলে তিনি নিজের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন এবং তার বাড়িতেই যীশুর সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

(ঘ) লূকের বর্ণনা মথি, মার্ক ও যোহন সকলের সাথে সাংঘর্ষিক। লূকের বর্ণনা অনুসারে পুনরুত্থান দিবসের রাত পর্যন্ত যীশু কোনো মহিলাকে সাক্ষাৎ দেননি। বরং সে দিনই প্রথম দুজন শিষ্যকে দেখা দেন।

তাঁর বর্ণনা অনুসারে, মহিলারা কবর থেকে ফিরে শিষ্যদেরকে খবর দেন যে, তাঁরা কবরে যীশুর লাশ দেখেন নি এবং স্বর্গদূতেরা তাদের বলেছেন যে, যীশু বেঁচে আছেন।’’ যীশুকে দেখার কথা তারা বলেননি। (লূক ২৪/৯-১০ ও ১৭-২৪) এরপর ‘‘সেই দিনই দুজন শিষ্য ইম্মায়ু নামে একটা গ্রামে যাচ্ছিলেন। গ্রামটা যিরূশালেম থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে ছিল। যা ঘটেছে তা নিয়ে তাঁরা আলাপ আলোচনা করছিলেন। সেই সময় যীশু নিজেই সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সংগে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। ....’’ (লূক ২৪/১৩-১৬: বাইবেল-২০০০)। লূক উল্লেখ করেছেন যে, দুজনের একজনের নাম ক্লিয়পা (Cleopas)। (লূক ২৪/১৮)

(ঙ) সাধু পল এ সকল তথ্যের বিপরীত তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, যীশু প্রথম পিতরকে সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন। তিনি লেখেছেন: ‘‘এবং কবর প্রাপ্ত হলেন, আর কিতাব অনুসারে তিনি তৃতীয় দিবসে উত্থাপিত হয়েছেন। আর তিনি কৈফাকে (পিতরকে), পরে সেই বারো জনকে দেখা দিলেন  (And that he was seen of Cephas, then of the twelve)। তারপর একেবারে পাঁচশোর বেশী ভাইকে দেখা দিলেন। .... তার পরে তিনি ইয়াকুবকে, পরে সকল প্রেরিতকে দেখা দিলেন।’’ (১ করিন্থীয় ১৫/৪-৭)