পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৬. ৮. কোন্ অভিযোগে ইহুদিরা যীশুর বিচার করলেন?

সম্মানিত পাঠক যদি মথির ২৬ অধ্যায় (বিশেষত ৫৯-৬৬ শ্লোক), মার্কের ১৪ অধ্যায় (বিশেষত ৫৩-৬৪ শ্লোক), লূকের ২২ অধ্যায় (বিশেষত ৬৬-৭১ শ্লোক) এবং যোহনের ১৮ অধ্যায় (বিশেষত ১৯-২৪ শ্লোক) অধ্যয়ন করে যীশুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করেন তবে সাংঘর্ষিক বর্ণনার সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবেন। কারণ একেক জন একেক ভাবে অভিযোগগুলো লেখেছেন। বিশেষ করে প্রথম তিন ইঞ্জিলের সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য প্রদান করেছেন যোহন।

মথি ও মার্কের বর্ণনা অনুসারে দুটো অভিযোগে যীশুকে ইহুদি মহাসভা মৃত্যুর যোগ্য বলে গণ্য করে: (১) তিনি ইহুদিদের উপাসনা-ঘর বা মসজিদ ভেঙ্গে তিন দিনের মধ্যে গড়ে দিবেন এবং (২) তিনি নিজেকে ইবনুল্লাহ বা ঈশবরের পুত্র অথবা মসীহ বলে দাবি করেন। পক্ষান্তরে লূকের বর্ণনা অনুসারে শুধু দ্বিতীয় অভিযোগে, অর্থাৎ নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বা ইবনুল্লাহ বলে দাবি করায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

যোহনের বর্ণনায় এ দুটোর কোনো অভিযোগই তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়নি। যোহনের বর্ণনায় মহা-ইমাম (মহাপুরোহিত) যীশুকে তাঁর শিষ্যরা ও তাঁর শিক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। যীশু উত্তরে বলেন যে, আমি তো গোপন কোনো শিক্ষা দিইনি। কাজেই আমাকে প্রশ্ন না করে যারা শুনেছে তাদেরকে প্রশ্ন করুন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে একজন তাঁকে বেয়াদবীর অভিযোগে আঘাত করেন। এরপর তাঁকে কাইয়াফার কাছে এরপর পীলাতের কাছে পাঠিয়ে দেন। অন্য কোনো অভিযোগই তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়নি।

এ বৈপরীত্যের পাশাপাশি প্রথম দুটো অভিযোগের বর্ণনায়, বিশেষত দ্বিতীয় অভিযোগের বর্ণনায় প্রথম তিন ইঞ্জিলের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে।

মথি: ‘‘মহা-ইমাম (কেরি: মহাপুরোহিত) তাঁকে বললেন, আমি তোমাকে জীবন্ত আল্লাহ্র নামে কসম দিচ্ছি, আমাদেরকে বল দেখি, তুমি কি সেই মসীহ্, আল্লাহ্র পুত্র (whether thou be the Christ, the Son of God.)? জবাবে ঈসা বললেন, তুমিই বললে; আরও আমি তোমাদেরকে বলছি, এখন থেকে তোমরা ইবনুল-ইনসানকে (Son of man : মনুষ্যপুত্রকে) পরাক্রমের (সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের) ডান পাশে বসে থাকতে দেখবে। তখন মহা-ইমাম তাঁর কাপড় ছিঁড়ে বললেন, এ কুফরী করলো, আর সাক্ষীতে আমাদের কি প্রয়োজন? ... এ মৃত্যুর যোগ্য।’’ (মথি ২৬/৬৩-৬৫, মো.-১৩)

মার্ক ১৪/৬১-৬৪: ‘‘মহা-ইমাম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সেই মসীহ্, পরমধন্যের পুত্র (Art thou the Christ, the Son of the Blessed)? ঈসা বললেন, আমি সেই; আর তোমরা ইবনুল-ইনসানকে পরাক্রমের ডান পাশে বসে থাকতে ও আসমানের মেঘসহ আসতে দেখবে। তখন মহা-ইমাম নিজের কাপড় ছিঁড়ে বললেন, আর সাক্ষীর আমাদের কি প্রয়োজন, তোমরা তো কুফরী শুনলে; ... এ মৃতুর যোগ্য।’’ (মো.-১৩)

লূক ২২/৬৬-৭১, ২৩/১, মো.-১৩: ‘‘তাদের মাহফিলের (মহাসভার/council) মধ্যে তাঁকে আনলো, আর বললো, তুমি যদি সেই মসীহ হও, তবে আমাদেরকে বল। তিনি তাদেরকে বললেন, যদি তোমাদেরকে বলি, তোমরা বিশ্বাস করবে না; আর যদি তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, কোন উত্তর দিবে না; কিন্তু এখন থেকে ইবনুল-ইনসান আল্লাহর পরক্রমের ডান পাশে উপবিষ্ট থাকবেন।  তখন সকলে বললো, তবে তুমি কি আল্লাহর পুত্র (Son of God)? তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরাই বলছো যে, আমি সেই। তখন তারা বললো, আর সাক্ষ্য আমাদের কি প্রয়োজন? আমরা নিজেরাই তো এর মুখে শুনলাম। পরে তারা দলশুদ্ধ সকলে উঠে তাঁকে পীলাতের কাছে নিয়ে গেল।’’

তিনটা বর্ণনার বৈপরীত্য সুস্পষ্ট। মথি ও মার্কের বর্ণনায় মহা-ইমাম বা মহা-পুরোহিতের প্রশ্ন ছিল একটাই এবং যীশু সরাসরি উত্তর প্রদান করেন। কিন্তু লূকের বর্ণনায় জেরার প্রশ্ন দুটো। মথি ও মার্কের বর্ণনায় যীশু নিজেকে মাসীহ হিসেবে স্বীকার করেছেন। আর লূকের বর্ণনায় যীশু নিজেকে মাসীহ হিসেবে স্বীকার বা অস্বীকার করেননি, তবে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে স্বীকার করেন।