নতুন নিয়মের ২৭টা পুস্তকের মধ্যে ২৩টা পুস্তকে যীশুর কোনো অলৌকিক কর্মের উল্লেখ নেই। সাধু পল ও অন্যান্যদের পুস্তিকা ও পত্রগুলো পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে, যীশু কোনো অলৌকিক কর্মই করেননি। কারণ তারা যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান ছাড়া অন্য কোনো অলৌকিক কর্মের কথা উল্লেখ করেননি। এর বিপরীতে প্রথম চারটা পুস্তক বা ইঞ্জিলগুলোতে যীশুর অনেক অলৌকিক কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারণভাবে আমরা দেখি যে, অলৌকিক কর্ম, বিশেষত রোগ সারানো ও ভূত তাড়ানো কর্মের মাধ্যমেই যীশু তাঁর প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কারণ তিনি শত শত বা হাজার হাজার মানুষের সামনে এগুলো করতেন। (মথি ৪/২৩-২৫, ৯/২৬, ৩৫; ১১/২১-২৩; মার্ক ১/২১-৪৫; ৬/১৪, ৫৬; ৭/৩৬; লূক ৪/৩১-৪৪ ৫/১৫; ৮/৩৯; ২৩/৮; যোহন ১ম ও ২য় অধ্যায়, যোহন ১১/৪৫-৪৮)।
উপরন্তু তিনি এগুলো প্রচার করতে নির্দেশ দিতেন। যীশু একজন ভূতগ্রস্থের ভূত তাড়িয়ে দেন। এরপর তাকে বলেন: ‘‘তুমি বাড়ি ফিরে যাও এবং আল্লাহ তোমার জন্য কত বড় কাজ করেছেন তা প্রচার কর। সেই লোকটা তখন গ্রামে গেল এবং ঈসা তার জন্য কত বড় কাজ করেছেন তা সমস্ত জায়গায় বলে বেড়াতে লাগল।’’ (লূক ৮/৩৯; মার্ক ৫/১৮-২০, মো.-১৩) মৃত লাসারকে জীবিত করার সময় যীশু ঈশ্বরকে সম্বোধন করে বলেন: ‘‘অবশ্য আমি জানি সব সময়ই তুমি আমার কথা শুনে থাক। কিন্তু যে সব লোক চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা যেন বিশ্বাস করতে পারে যে, তুমি আমাকে পাঠিয়েছ, সেই জন্যই এই কথা বললাম।’’ (ইউহোন্না ১১/৪২, মো.-১৩)
নবী-রাসূলদের জন্য এটাই স্বাভাবিক যে তাঁরা অলৌকিক কর্ম প্রচারের মাধ্যমে যথাসম্ভব বেশি মানুষকে ঈমানের পথে আকৃষ্ট করবেন।
কিন্তু এর বিপরীতে ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে রয়েছে যে, যীশু তাঁর অলৌকিক কর্ম গোপন করার নির্দেশ দিতেন। মথি (৯/৩০-৩১) লেখেছেন যে, যীশু দুজন অন্ধ ব্যক্তির অন্ধত্ব দূর করেন এবং ‘‘খুব কঠোরভাবে তাদের বললেন, দেখো, কেউ যেন জানতে না পারে।’’ মার্ক লেখেছেন (৭/৩১-৩৬) যীশু একজন বোবা বা বয়রা ও তোতলা মানুষকে সুস্থ করেন এবং ‘‘এই বিষয়ে কাউকে বলতে লোকদের বারণ করলেন।’’ (মো.-০৬)
মার্ক ও লূক লেখেছেন যে, যীশু একজন চর্মরোগীকে সুস্থ করেন। এরপর ‘‘তাকে কড়াকড়িভাবে বললেন, দেখ, এই কথা কাউকে বোলো না।’’ (মার্ক ১/৪৪; লূক ৫/১৪, মো.-০৬)। মথি এ ঘটনায় লেখেছেন যে, যীশু যখন চর্মরোগীকে সুস্থ করেন তখন অনেক মানুষ তাঁর পিছে পিছে চলছিল। এরপর তিনি লোকটাকে সুস্থ করে বিষয়টা গোপন রাখতে নির্দেশ দেন (মথি ৮/১-৪)। বিষয়টা অবোধ্য! শতশত মানুষের সামনে অলৌকিক কর্ম দেখিয়ে তা গোপন রাখতে বলার অর্থ কী হতে পারে?
মার্ক (৫/২১-৪২) ও লূক (৮/৪০-৫৬) লেখেছেন, এক কিশোরী অচেতন হয়ে পড়ে। মেয়েটা মারা গিয়েছে ভেবে অনেক মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়ে কান্নাকাটি করছিল। যীশু বালিকাটার ঘর থেকে সবাইকে বের করে তাকে সুস্থ করেন এবং ‘‘এই ঘটনার কথা কাউকে না জানানোর জন্য যীশু কড়া আদেশ দিলেন।’’ (মো.-০৬)
এত মানুষ তাকে মৃত মনে করে গোলমাল ও কান্নাকাটি করছে। এরপর মেয়েটা জীবিত হয়ে তাদের মধ্যে ফিরে এল। তাহলে বিষয়টা গোপন করার অর্থ কী?
মার্ক লেখেছেন: ‘‘আর নাপাক রূহ্রা তাঁকে দেখললেই তাঁর সম্মুখে পড়ে চেঁচিয়ে বলতো, আপনি আল্লাহ্র পুত্র; ১২ কিন্তু তিনি তাদেরকে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করে দিতেন, যেন তারা তাঁর পরিচয় না দেয়।’’ (মার্ক ৩/১১-১২, মো.-১৩)
বড়ই অবাক বিষয়! তিনি নিজে মহা মহা অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করে নিজের বিষয় প্রমাণ করছেন, আবার অশুচি আত্মাদেরকে পরিচয় গোপন করতে নির্দেশ দিচ্ছেন! এছাড়া বাইবেল থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, কাউকে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ বলা যীশুর সমকালীন ইহুদি সমাজে কোনোরূপ দূষণীয় বিষয় ছিল না। যে কোনো সৎ মানুষকে, এমনকি সকল ইহুদিকেই ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘ঈশ্বরের পুত্র’ বলা হত। কাজেই এ কথাতে তাঁর কিইবা পরিচয় প্রকাশ পেত? এবং এ কথা গোপন করলেই বা কী হত?
সর্বাবস্থায় আরো কিছু অলৌকিক কর্ম গোপন রাখতে যীশু নির্দেশ দেন বলে ইঞ্জিলগুলো উল্লেখ করেছে। যেমন, যীশুর উজ্জ্বল চেহারা বা আকৃতি পরিবর্তনের ঘটনা গোপন রাখতে তিনি শিষ্যদেরকে নির্দেশ দেন (মথি ১৭/১-৯; মার্ক ৯/২-৯)। এছাড়া যীশু যে সকল ভূত, অশুচি আত্মা বা বদ-রূহ তাড়িয়ে দেন তাদের কাউকে কাউকে তাঁর পরিচয় গোপন রাখতে নির্দেশ দেন। (মার্ক ১/৩৪, ৩/১১-১২)
অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করে মানুষদেরকে বিশ্বাসী হতে সাহায্য করার সাথে অলৌকিক কর্ম গোপন করার নির্দেশনা নিঃসন্দেহে সাংঘর্ষিক। অলৌকিক কর্ম গোপন করার অর্থ মানুষদের জন্য বিশ্বাসকে কঠিন করা বা বিশ্বাসের দরজা রুদ্ধ করা।
বাইবেল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এড প্যারিশ স্যান্ডার্স এ বৈপরীত্যের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন যে, ইঞ্জিল লেখকগণ যীশুর অলৌকিক কর্ম বর্ণনায় বাড়াবাড়ি করেছেন। তাদের বর্ণনা থেকে মনে হয়, হাজার হাজার মানুষ যীশুর অলৌকিক কর্ম দেখে তাঁর অনুসারী হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তাঁর অনুসারী ছিল কম এবং বাস্তবে যীশু অনেক কম অলৌকিক কর্ম দেখান। তাঁর ১২ শিষ্য, অল্প কিছু অনুসারী ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল সবাইকে একত্রিত করলে সংখ্যা পাঁচ শতের অধিক হয় না। পল লেখেছেন, যীশু পুনরুত্থানের পর এরূপ সংখ্যক মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করেন। (১ করিন্থীয় ১৫/৬)। ‘এত অধিক অলৌকিক কর্ম কিন্তু এত অল্প শিষ্য’ চোখে পড়ার মত বৈপরীত্য। এর সমন্বয়ের জন্য ইঞ্জিল লেখকরা মাঝে মাঝে গোপনীয়তার কথা লেখেছেন।[1]