পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৫. ১২. অলৌকিক খাদ্যের পর জনতার মূল্যায়ন

যীশুর অন্যতম অলৌকিক কর্ম ৫টা রুটি ও ২টা মাছ দিয়ে ৫০০০ মানুষকে খাওয়ানো। যোহন ৬/৫-১৪ শ্লোকে ঘটনাটা বর্ণনা করে লেখেছেন যে, উপস্থিত সকলে এ অলৌকিক কর্ম অনুধাবন করে এত বেশি প্রভাবিত হন যে, তারা তৎক্ষণাৎ যীশুকে তাদের রাজা বানানোর সিদ্ধান্ত নেন: ‘‘অতএব সেই লোকেরা তাঁর কৃত চিহ্ন কাজ দেখে বলতে লাগল, উনি সত্যিই সেই নবী, যিনি দুনিয়াতে আসছেন। তখন ঈসা বুঝতে পারলেন যে, তারা এসে তাঁকে বাদশাহ্ করার জন্য ধরতে উদ্যত হয়েছে, তাই আবার নিজে একাকী পর্বতে চলে গেলেন।’’ (ইউহোন্না/ যোহন ৬/১৪-১৫, মো.-১৩)

মার্ক ৬/৩৫-৪৪ শ্লোকে ঘটনাটা বর্ণনা করে বলেছেন যে, যীশুর শিষ্যরা এ অলৌকিক কর্ম বুঝতে পারেন নি। তিনি লেখেছেন, রুটির ঘটনার পর যীশু শিষ্যদেরকে ঝড় থামানো ও পানির উপর দিয়ে হাঁটার অলৌকিক কর্ম দেখান। এতে তাঁরা খুবই অবাক হন: ‘‘তাতে তাঁরা ভীষণ আশ্চর্য হলে। কেননা রুটির বিষয়ে তাঁরা বুঝতে পারেননি, তাঁদের অমত্মঃকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিল (for their heart was hardened.)।’’ ( মার্ক ৬/৫১-৫২, মো.-১৩)

দুটো তথ্যের মধ্যে সমন্বয় সম্ভব নয়। তবে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। উপস্থিত ৫০০০ সাধারণ জনগণ যীশুর অলৌকিক কর্ম ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন, এবং তাঁকে রাজা বানানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে তাঁর শিষ্য বা সাহাবীরা বিষয়টার অলৌকিকত্বও বুঝেন নি, ৫০০০ মানুষের কথাবার্তাও বুঝেন নি এবং যীশুকে রাজা বানানোর জন্য জনগণের উদ্যোগ থেকেও তাঁরা কিছুই বুঝেননি! কারণ সকল মানুষের চেয়ে তাঁরা সবচেয়ে কঠিন হৃদয় ছিলেন! মার্কের ভাষায় ‘কঠিন অমত্মঃকরণ’ অর্থ কী? স্থুলবুদ্ধি? নির্বোধ? ঈমানহীন?

রুটি ও ঝড় থামানোর আগেও যীশু তাঁর প্রেরিত ও শিষ্যদেরকে অনেক মহা অলৌকিক কার্য দেখিয়েছেন। রুটির স্থানে উপস্থিত ৫০০০ মানুষ একটা অলৌকিক কার্য দেখেই তাঁকে চিনে ফেললেন অথচ তাঁর প্রিয়তম সহচর, প্রেরিত বা সাহাবীরা এত কিছু দেখেও কিছুই বুঝলেন না? তাঁরা কি এতই নির্বোধ বা স্থুলবুদ্ধি ছিলেন?

আরো লক্ষণীয় যে, এ ঘটনার কিছুদিন আগেই, যীশু শিষ্যদেরকে এই একই সাগরে (তিবরিয়া বা গালীল সাগর) একই রকম অলৌকিক চিহ্ন দেখিয়েছিলেন। মার্ক ৪র্থ অধ্যায়ে লেখেছেন যে, যীশু শিষ্যদের সাথে সন্ধ্যার পরে নৌকায় ওপারে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ভীষণ ঝড় ওঠে এবং নৌকা পানিতে ভরে ডুবে যাচ্ছিল। যীশু বাতাসকে ধমক দেন এবং সমুদ্রকে শান্ত হতে বলেন। এতে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। তখনও শিষ্যরা বা সাহাবীরা ‘‘ভীষণ ভয় পেয়ে পরস্পর বলতে লাগলেন, ইনি তবে কে যে, বাতাস এবং সমুদ্রও এঁর হুকুম মানে?’’ (মার্ক ৪/৩৫-৪১, মো.-১৩)

যীশু ও তাঁর প্রেরিতদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোনো ব্যক্তি কি ইঞ্জিলের এ তথ্য সত্য বলে গ্রহণ করতে পারেন? অগণিত মহা অলৌকিক চিহ্ন-কার্য দেখেও তাঁরা কিছুই বুঝছেন না? যীশু সবকিছু তাদের বুঝাতেন: ‘‘সাহাবীরা যখন তাঁর সংগে একা থাকতেন তখন তিনি সব কিছু তাঁদের বুঝিয়ে দিতেন’’ (মার্ক ৪/৩৪, মো.-০৬)। এরপরও তাঁরা কিছুই বুঝলেন না? তৎকালীন সময়ের কোনো একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও কি যীশুর শিষ্য হননি? যীশু তাঁর এত সুন্দর উপদেশ ও এত মহা অলৌকিক কর্ম দ্বারা কি বুদ্ধিমান ও প্রাজ্ঞ কোনো মানুষকে ঈমানের দিকে আকর্ষণ করতে পারেন নি? শুধু কিছু স্থুলবুদ্ধি ‘কঠিন হৃদয়’ মানুষ তাঁর শিষ্য হয়েছিল? এ সকল বর্ণনাকে নির্ভুল ও সত্য বলে গ্রহণ করলে যীশু ও শিষ্যদের বিষয়ে এরূপ অশোভন ধারণা করা ছাড়া উপায় থাকে না।

আধুনিক অনেক গবেষক পুরো ঘটনাগুলোকেই ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। ইঞ্জিল লেখকরা বলেছেন যে, ৫ হাজার মানুষকে ৫টা রুটি ও ২ টা মাছ খাওয়ানোর পরে অবশিষ্ট গুঁড়াগাড়া ১২ ডালা (বাস্কেট: baskets) পূর্ণ হয়। (মথি ১৪/২০; মার্ক ৬/৪৩; লূক ৯/১৭; যোহন: ৬/১৩)। বিরুদ্ধবাদীরা বলেন, যে বিজন প্রান্তরে খাদ্য সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, সেখানে বাস্কেটগুলো কোথা থেকে এল? শিষ্যরা বা সমবেত মানুষেরা কি খাদ্য ছাড়া শুধু খালি বাস্কেট নিয়ে বেড়াতেন?[1]

ঝড় থামানো প্রসঙ্গে ইঞ্জিলগুলো লেখেছে যে, ‘চতুর্থ প্রহর রাত্রিতে’ (আধুনিক হিসেবে রাত ১০ টা) যীশু যখন হেঁটে সাগর পার হচ্ছিলেন তখন সমুদ্রের উপর দিয়ে তাঁকে হাঁটতে দেখে সাহাবীরা ‘‘ভীষণ ভয় পেয়ে বললেন, এ যে ভূত! আর ভয়ে চেঁচাতে লাগলেন।’’ (মথি ১৪/২৬; মার্ক ৬/৪৯; যোহন ৬/১৯)। সংশয়বাদীরা বলেন: যীশুর শিষ্যরা তাঁর অলৌকিক কর্ম হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা রাখতেন না, কিন্তু গভীর রাতে সমুদ্রের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যীশুকে দূর থেকে দেখার ক্ষমতা রাখতেন!! [2]

[1] http://www.jesusneverexisted.com/galilee.html
[2] http://www.jesusneverexisted.com/galilee.html