পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

যীশুর দ্বাদশ প্রেরিতের একজন ‘Judas Iscariot’। বাংলা বাইবেলে ‘ইস্করিয়োতীয় যিহূদা’, ‘ইস্করিয়োতীয় এহুদা’ বা ‘যিহূদা/ এহুদা ইস্কারিয়োৎ’। তিনিই বিশ্বাসঘাতকতা করে যীশুকে ইহুদি যাজক ও প্রধানদের হাতে সমর্পণ করেন। চার ইঞ্জিলেই বিষয়টা উল্লেখ করা হয়েছে। যিহূদী নেতা ও যাজকরা যীশুকে চিনতেন না। যিহূদা তাদেরকে বলেন, আমি যাকে চুম্বন করব তিনিই যীশু। তাঁকে আপনারা ধরবেন। যিহূদা এসে তাঁর হাতে চুমু দেন সঙ্গে সঙ্গে ইহুদিরা তাঁকে গ্রেফতার করে। লূক কিছু ব্যতিক্রম লেখেছেন এবং যোহন একেবারেই ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। বাইবেল বিশেষজ্ঞরা ও খ্রিষ্টান পাঠকরা সহজেই এ ব্যতিক্রম বুঝতে পারনে। কিন্তু সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্য পুরো বক্তব্য উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করছি।

মথি লেখেছেন: ‘‘তিনি যখন কথা বলছেন, দেখ, এহুদা, সেই বার জনের এক জন, আসলো এবং তার সঙ্গে অনেক লোক তলোয়ার ও লাঠি নিয়ে প্রধান ইমামদের ও লোকদের প্রাচীনদের কাছ থেকে আসলো। যে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, সে তাদেরকে এই সঙ্কেত বলেছিল, আমি যাকে চুম্বন করবো, সে ঐ ব্যক্তি, তোমরা তাকে ধরবে। সে তখনই ঈসার কাছে গিয়ে বললো, রবিব, আসসালামু আলাইকুম, আর তাঁকে আগ্রহ পূর্বক চুম্বন করলো। ঈসা তাকে বললেন, বন্ধু, যা করতে এসেছো, কর। তখন তারা কাছে এসে ঈসার উপর হস্তক্ষেপ করে তাঁকে ধরলো। আর দেখ, ঈসার সঙ্গীদের মধ্যে এক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে তলোয়ার বের করলেন এবং মহা-ইমামের গোলামকে আঘাত করে তার একটা কান কেটে ফেললেন। (মথি ২৬/ ৪৭-৫১, মো.-১৩)

মার্ক লেখেছেন: ‘‘আর তিনি যখন কথা বলছেন, তৎক্ষণাৎ এহুদা, সেই বার জনের একজন আসল এবং তার সঙ্গে অনেক লোক তলোয়ার ও লাঠি নিয়ে প্রধান ইমামদের, আলেমদের ও প্রাচীনদের কাছ থেকে আসলো। যে তাঁকে ধরিয়ে দিচ্ছিল, সে আগে তাদেরকে এই সঙ্কেতে বলেছিল, আমি যাকে চুম্বন করবো, সে-ই ঐ ব্যক্তি, তোমরা তাকে ধরে সাবধানে নিয়ে যাবে। সে এসে তৎক্ষণাৎ তাঁর কাছে গিয়ে বললো, রবিব; আর তাঁকে আগ্রহ পূর্বক চুম্বন করলো। তখন তারা তাঁর উপর হস্তক্ষেপ করে তাঁকে ধরলো। কিন্তু যারা পাশে দাড়িয়ে ছিল, তাদের মধ্যে একজন তাঁর তলোয়ার খুলে মহা-ইমামের গোলামকে আঘাত করে তার একটা কান কেটে ফেললো।’’ (মার্ক ১৪/৪৩-৪৭, মো.-১৩)

পাঠক দেখছেন যে, মথি ও মার্কের মধ্যে কয়েকটা শব্দের পার্থক্য ছাড়া সকল তথ্য একই। কিন্তু লূক লেখেছেন: ‘‘তিনি কথা বলছেন, এমন সময়ে দেখ, অনেক লোক এবং যার নাম এহুদা- সেই বার জনের মধ্যে এক জন- সে তাদের আগে আগে আসছে; সে ঈসাকে চুম্বন করার জন্য তাঁর কাছে আসল। কিন্তু ঈসা তাঁকে বললেন, এহুদা, চুম্বন দ্বারা কি ইবনুল ইনসানকে (the Son of man: মানব-সন্তানকে, কেরি: মনুষ্যপুত্রকে) ধরিয়ে দিচ্ছ? তখন কি কি ঘটবে, তা দেখে যাঁরা তাঁর কাছে ছিলেন, তাঁরা বললেন, প্রভু, আমরা কি তলোয়ার দ্বারা আঘাত করবো। আর তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি মহা-ইমামের গোলামকে আঘাত করে তার ডান কান কেটে ফেললেন। ... পরে তারা তাকে ধরে নিয়ে গেল ...।’’ (লূক ২২/৪৭-৫৪, মো.-১৩)

মথি ও মার্কের সাথে লূকের শব্দের পার্থক্য ছাড়াও তথ্যের ভিন্নতা পাঠকের নিকট স্পষ্ট। প্রথম দুজনের বর্ণনায় যিহূদা কিছু কথা বলে যীশুকে চুম্বন করেন। আর লূকের বর্ণনায় যিহূদা কোনো কথা না বলে যীশুকে চুম্বন করতে আসেন, কিন্তু তিনি চুম্বন করেননি, বরং চুম্বনের আগেই যীশু তার সাথে কথা বলেন। এছাড়া প্রথম দুজনের বর্ণনায় গ্রেফতারের পরে খড়গ বের করা ও কান কাটার ঘটনা ঘটে। পক্ষান্তরে লূকের বর্ণনায় গ্রেফতারের আগেই তা ঘটে। এরপরও আমরা মথি ও মার্কের বর্ণনার সাথে লূকের বর্ণনাকে সাংঘর্ষিক বলে গণ্য করছি না। আমরা ধরে নিচ্ছি যে, তিনি চুম্বনের জন্য আগমন করার কথা বলে চুম্বন করা বুঝিয়েছেন এবং একই ঘটনা বর্ণনায় তিনি কিছু আগে পিছে করেছেন।

কিন্তু যোহনের বর্ণনাকে সাংঘর্ষিক বলা ছাড়া উপায় নেই। কারণ যোহন এ ঘটনার বর্ণনায় লেখেছেন: ‘‘আর এহুদা, যে তাঁকে দুশমনদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, সে সেই স্থানটা চিনত, কারণ ঈসা অনেক বার তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে সেই স্থানে একত্র হতেন। অতএব এহুদা সৈন্যদলকে এবং প্রধান ইমামদের ও ফরীশীদের কাছ থেকে পদাতিকদের সঙ্গে নিয়ে মশাল, প্রদীপ ও অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে সেখানে আসল। তখন ঈসা, তাঁর প্রতি যা যা ঘটতে যাচ্ছে সমস্ত কিছু জেনে বের হয়ে আসলেন, আর তাদেরকে বললেন, কার খোঁজ করছো? তারা তাঁকে জবাবে বললো, নাসরতীয় ঈসার। তিনি তাদেরকে বললেন, আমিই তিনি। আর এহুদা, যে তাঁকে ধরিয়ে দিচ্ছিল, সে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। তিনি যখন তাদেরকে বললেন, আমিই তিনি, তখন তারা পিছিয়ে গেল এবং ভূমিতে পড়ে গেল। পরে তিনি আবার তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কার খোঁজ করছো? তারা বলল, নাসরতীয় ঈসার। জবাবে ঈসা বললেন, আমি তো তাদেরকে বললাম যে, আমিই তিনি; অতএব তোমরা যদি আমার খোঁজ কর, তবে এদেরকে (শিষ্যদেরকে) যেতে দাও ... তখন শিমোন পিতরের কাছে তলোয়ার থাকাতে তিনি তা খুলে মহা-ইমামের গোলামকে আঘাত করে তার ডান কান কেটে ফেললেন। ... তখন ঈসা পিতরকে বললেন, তলোয়ার খাপে রাখ; আমার পিতা আমাকে যে পানপাত্র দিয়েছেন তা থেকে কি আমি পান করবো না? তখন সৈন্যদল ও সহস্রপতি ও ইহুদীদের পদাতিকেরা ঈসাকে ধরলো ও তাঁকে বেঁধে ... নিয়ে গেল।’’ (ইউহোন্না ১৮/২-১২, মো.-১৩)

পাঠক দেখছেন যে, লূকের সাথে মথি ও মার্কের সমন্বয়ের মত যোহনের সাথে সমন্বয়ের কোনোই পথ নেই। যোহন সম্পূর্ণ বিপরীত বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে যিহূদা যীশুকে চেনাতে আসেননি, বরং স্থান চেনাতে এসেছেন। যীশুকে চুম্বন দেওয়া তো দূরের কথা তিনি যীশুর সাথে কোনো কথাও বলেননি, নিকটবর্তীও হননি। স্বয়ং যীশুই সৈন্যদের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলেছেন। এজন্য আমরা বৈপরীত্যের মধ্যে যোহনের সাথে মথি ও মার্কের বৈপরীত্য আলোচনা করেছি। লূকের বিষয়টা সমন্বয়যোগ্য ধরে এড়িয়ে গিয়েছি।