২. ১৪. ৮. বাইবেল বিকৃতিতে অধ্যাপকদের লেখনি

আমরা জানি যে, ‘Scribes’ শব্দের অর্থ লিপিকার বা অনুলিপিকার। আর প্রাজ্ঞ ধর্মগুরু পণ্ডিতরা ছাড়া আর কারো জন্য বাইবেল অনুলিপি করার সুযোগ ছিল না। এজন্য Scribe বা লিপিকার শব্দের অর্থে কেরি লেখেছেন ‘অধ্যাপক’ এবং কিতাবুল মোকাদ্দস লেখেছে ‘আলেম’। যিরমিয় বললেন, আলিম, অধ্যাপক বা লিপিকারদের মিথ্যা কলম বাইবেলকে মিথ্যা বানিয়েছে এবং নবী থেকে ইমাম (ভাববাদী থেকে যাজক) পর্যন্ত সকলেই প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। বাইবেলের বিকৃতি সম্পর্কে যিরমিয়ের এ ভবিষ্যদ্বাণী (prophecy)-এর গুরুত্ব পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারি যখন আমরা দেখি যে, বাইবেল কখনোই গণপাঠ্য বা সাধারণের ব্যবহারযোগ্য পুস্তক ছিল না। ইহুদি ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের বাইবেলের ব্যবহার ও প্রচলন একান্তভাবেই লিপিকার (অধ্যাপক বা আলেম), ভাববাদী (নবী) ও যাজকদের (ইমামদের) মধ্যে সীমাবদ্ধ ও তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। সাধারণ ধার্মিক মানুষেরা বাইবেলের বিধান, গল্প ইত্যাদি শুনতেন, শিখতেন ও জানতেন। প্রার্থনামূলক কিছু কাব্যিক শ্লোক মুখস্থ করতেন। এছাড়া বাইবেলের মূল পাঠ থেকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এমনকি মাতৃভাষায় বাইবেল অনুবাদও চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার পরেও মাতৃভাষায় বাইবেল মুদ্রণ ধর্মদ্রোহিতা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে চার্চ ও পোপ।

খৃস্টধর্মীয় বাইবেলের সকল কপিই গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় রচিত ছিল। এ দুটো ভাষা একান্তই উচ্চশিক্ষিত ও ধর্মগুরুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এজন্য বাইবেলের সামান্য কিছু অংশ ছাড়া মূল পাঠ সাধারণ খ্রিষ্টানদের আওতার বাইরে ছিল। এরপরও চার্চের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষদের জন্য গ্রিক বা ল্যাটিন বাইবেল পাঠ নিষিদ্ধ ছিল।[1]

১৩৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বৃটিশ দার্শনিক জন উইকলিফ (John Wycliffe) প্রথম ইংরেজি ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেন। এজন্য খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের নির্দেশে বৃটিশ পার্লামেন্ট তাকে অক্সফোর্ড থেকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত দেয়। রাজা রিচার্ড ২ (King Richard II) নিদের্শ জারি করেন: ‘‘Wycliffe be removed from Oxford, and that all who preached or wrote against Catholicism be imprisoned:  উইকলিফ অক্সফোর্ড থেকে বহিষ্কৃত হবেন এবং ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে যারাই লেখবেন বা প্রচার করবেন সকলেই কারারুদ্ধ হবেন।’’ ১৩৮৪ খ্রিষ্টাব্দে উইকলিফ মৃত্যৃবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ত্রিশ বছর পরে খ্রিষ্টান মহাযাজকদের মহাসম্মেলন ‘কন্সট্যান্সের সম্মেলন’ (The Council of Constance) ৪ঠা মে ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ধর্মদ্রোহী বলে ঘোষণা দেয়। এ বিষয়ে উইকিপিডিয়া লেখেছে:

declared Wycliffe a heretic and under the ban of the Church. It was decreed that his books be burned and his remains be exhumed. The exhumation was carried out in 1428 when, at the command of Pope Martin V, his remains were dug up, burned, and the ashes cast into the River Swift ...The "Constitutions of Oxford" of 1408 ... naming John Wycliffe in a ban on certain writings, and noting that translation of Scripture into English by unlicensed laity is a crime punishable by charges of heresy.

‘‘সম্মেলন ঘোষণা দেয় যে, উইকলিফ একজন ধর্মদ্রোহী এবং চার্চমণ্ডলীর নিষেধাজ্ঞাধীন। তা আরো ঘোষণা দেয় যে, তার লেখনিগুলো আগুনে পোড়াতে হবে এবং তার মৃতদেহ কবর থেকে তুলে পোড়াতে হবে। কবর থেকে লাশ তোলার  এ নির্দেশ ১৪২৮ সালে বাস্তবায়িত হয়। পোপ ৫ম মার্টিনের নির্দেশে কবর থেকে তার লাশের অবশিষ্ট তোলা হয়, আগুনে পোড়ানো হয় এবং ছাইগুলো সুইফট নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। .... অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪০৮ খ্রিষ্টাব্দের গঠনতন্ত্রে ... বিশেষভাবে উইকলিফের নাম উল্লেখ করে তার লেখনিগুলো নিষিদ্ধ করে... উল্লেখ করা হয় যে, লাইসেন্স বিহীন সাধারণ মানুষদের জন্য ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ করা একটা অপরাধ, যে অপরাধের জন্য ধর্মদ্রোহিতার শাস্তি দেওয়া যাবে।’’

উল্লেখ্য যে, এ সম্মেলনেই অপর খ্রিষ্টান সংস্কারক জ্যান হাস (Jan Hus)- কে সমবেত খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা জীবন্ত খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করেন।[2]

ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ হওয়ার পরেও খ্রিষ্টীয় চার্চমণ্ডলী ও পোপ সর্বদা সকলের জন্য বাইবেল পাঠের দাবি ধর্মদ্রোহিতা বলে গণ্য করেছেন।

‘‘(The reading of the Holy Scriptures is for all men): সকলের জন্য বাইবেল পাঠ’ কথাটাকে জ্যানসেনীয় ধর্মদ্রোহিতা (Jansenist heresies) গণ্য করে ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে পোপ একাদশ ক্লিমেন্ট (Pope Clement XI) লেখেন:

"We declare, condemn and disallow all and each of these Propositions as false, captious, ill-sounding, offensive to pious ears, scandalous, pernicious, rash, injurious to the Church and its practices, not only outrageous against the Church but even against the secular powers, seditious, impious, blasphemous, suspected of heresy and savouring of heresy itself, as also encouraging heretics and heresies and even schism, erroneous, often condemned, and lastly also heretical, containing divers heresies manifestly tending to innovation".

‘‘এরূপ সকল মত আমরা নিন্দা করছি, অস্বীকার করছি এবং ঘোষণা করছি যে, এরূপ মত মিথ্যা, ছিদ্রান্বেষী, শুনতে মন্দ, পবিত্র কানগুলোর জন্য অশালীন, কুৎসামূলক, ধ্বংসকর, হঠকারি, খ্রিষ্টীয় চার্চ-মণ্ডলী এবং তার কার্যাভ্যাসের জন্য ক্ষতিকর, চার্চের জন্য জঘন্য নীতিবিরুদ্ধ, উপরন্তু ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসনের জন্যও জঘন্য নীতিবিরুদ্ধ, রাষ্ট্রদ্রোহী, অসাধু, ঈশ্বরনিন্দনীয়, ধর্মদ্রোহিতায় অভিযুক্ত এবং প্রকৃত ধর্মদ্রোহিতার দুর্গন্ধযুক্ত, উপরন্তু ধর্মদ্রোহিতার উস্কানিমূলক, বিভক্তি সৃষ্টিকারী, ভ্রান্ত, প্রায়শ নিন্দিত এবং সর্বশেষ ধর্মদ্রোহী, বহুপ্রকার ধর্মদ্রোহিতাযুক্ত, সুস্পষ্টভাবে নতুনত্ব সৃষ্টিকারী।’’[3]

১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ১৬শ গ্রেগরি বাইবেল সোসাইটিগুলোর উদ্দেশ্যে লেখা প্রচারপত্রে বলেন: "... in the rules written by the fathers chosen by the Council of Trent. . .   and placed in the Index of forbidden books, we read the statute declaring that vernacular Bibles are forbidden. . .  ". ‘‘চার্চ পিতারা যে সকল বিধান লেখেছেন এবং ট্রেন্টের মহাসম্মেলনে নিষিদ্ধ পুস্তকের তালিকায় স্বীকৃত যে নীতিমালা আমরা পড়ি, তাতে মাতৃভাষায় লিখিত বাইবেলগুলো নিষিদ্ধ।’’[4]

বিগত কয়েক শতাব্দী যাবৎ প্রটেস্ট্যান্টদের নেতৃত্বে বাইবেল বহুল প্রচারিত হয়েছে এবং খ্রিষ্টান প্রচারকরা বর্তমানে বাইবেল প্রচার করেন। কিন্তু আমরা দেখছি যে, মাত্র দু শতাব্দী পূর্বেও খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা, বিশেষত ক্যাথলিক চার্চ ও পোপরা বাইবেলকে শুধু যাজকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন। বিশেষত, মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহারের পূর্বে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাইবেলের মূল পুস্তকের ব্যবহার, প্রচলন ও প্রচার একান্তভাবেই ‘অধ্যাপক’ বা লিপিকার এবং যাজকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর অধ্যাপকদের মিথ্যা কলম যদি বাইবেলকে মিথ্যা করতে থাকে এবং নবী থেকে যাজকরা প্রবঞ্চনায় লিপ্ত হন তবে বাইবেলের মূল পাঠ কিরূপ বিকৃত হতে পারে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারছি। অভ্রান্ততা বিরোধী বাইবেল বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন যে, বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান অগণিত ভুলভ্রান্তি এ অনুমানকে নিশ্চিত জ্ঞানে পরিণত করে।

এ প্রসঙ্গে liberalslikechrist.org ওয়েবসাইটের বক্তব্য:

Why is it so difficult for intelligent and informed Christians to recognize – and openly and publicly admit – that the Bible is NOT free of all errors? It is no accident that most of those who teach the doctrine of "Biblical Inerrancy" act as though they themselves cannot be wrong.  They want everybody to believe that they are in possession of a goose that "lays golden eggs", so to speak; or in this case, a "Holy Spirit" that provides the correct answer to every question.  But is the Holy Spirit of God intended to be such a "golden goose" for people who make themselves into "Bible experts"? The Bible itself warns against trusting the "Scribes", i.e.  those who transcribed the sacred texts by hand, thousands of years before the first printing press was invented.

‘‘বুদ্ধিমান ও তথ্যাভিজ্ঞ খ্রিষ্টানদের জন্য এ কথা মেনে নেওয়া এবং প্রকাশ্যে ও জনসম্মুখে স্বীকার করা কেন কষ্টকর যে, বাইবেল সকল ভুলভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়? এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় যে, যারা বাইবেলীয় অভ্রান্ততার শিক্ষা প্রচার করেন তাদের অধিকাংশই এমন আচরণ করেন যেন তাদের কোনো ভুল হতেই পারে না। তারা চান, সকলেই বিশ্বাস করুক, ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহংসীটা তাদের মালিকানাতেই রয়েছে’। তাদের ক্ষেত্রে এ ‘সোনার ডিম দেওয়া রাজহংসীটা’ হল ‘পবিত্র আত্মা’। এ ‘পবিত্র আত্মা’ প্রত্যেক প্রশ্নের সঠিক উত্তর সরবরাহ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, যারা নিজেদেরকে ‘বাইবেল  বিশেষজ্ঞ’ বানিয়েছেন ঈশবরের পবিত্র আত্মা কি তাদের সুবর্ণ রাজহংসী হওয়ার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত? বাইবেল নিজেই সতর্ক করেছে, অনুলিপিকারদেরকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে। অর্থাৎ প্রথম মুদ্রণালয় আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত হাজার হাজার বছর ধরে যারা হাতে প্রতিলিপি করে পবিত্র পুস্তক প্রচার করেছেন তাদেরকে বিশ্বাস করতে স্বয়ং বাইবেলই সতর্ক করছে।’’[5]

[1] এনকার্টা: Inquisition of Toulouse Forbids Bible Reading
[2] Wikipedia: Wycliffe's Bible, Council of Constance. Encarta Encyclopedia: Jan Hus, Execution of Jan Hus
[3] p. 232 of Vicars of Christ, by Peter De Rosa . Catholic Ban on Bibles in the Vernacular, http://liberalslikechrist.org/about/biblestats.html
[4] http://liberalslikechrist.org/about/biblestats.html, Pope Gregory XVI, Encyclical of Pope Gregory XVI on Biblical Societies."
[5] http://LiberalsLikeChrist.Org/inerrancy.html