পিতর বলেছেন: ‘‘নবীরা তাঁদের ইচ্ছামত কোন কথা বলেননি; পাক রুহের দ্বারা পরিচালিত হয়েই তাঁরা আল্লাহর দেওয়া কথা বলেছেন।’’
বাইবেল প্রমাণ করে, পিতরের এ বক্তব্যটা মূলতই ভুল। পবিত্র বাইবেলে আমরা দেখি যে, একজন নবী ‘ভাববাণী’ বা ঈশ্বরের বাণী হিসেবে মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলতে পারেন ও বলেছেন। বাইবেলের ভাষায়: ‘‘কোন নবী যদি প্ররোচিত (deceived: প্রতারিত) হয়ে কথা বলে, তবে জেনো, আমিই মাবুদ সেই নবীকে প্ররোচনা (deceived: প্রতারণা) করেছি; আমি তার বিরুদ্ধে আমার হাত বাড়িয়ে আমার লোক (প্রজা) ইসরাইলের মধ্য থেকে তাকে মুছে ফেলব।’’ (যিহিষ্কেল ১৪/৯, মো.-১৩)
এ থেকে আমরা জানছি যে, যে কোনো নবী বা ভাববাদী ঈশ্বরের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ঈশ্বরের নামে মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলতে পারেন।
বাইবেলের বর্ণনায় ইহুদিদের দুটো রাজ্য: ইস্রায়েল ও যিহূদা উভয় রাজ্যের রাজা একত্রিত হয়ে অরাম রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে ঈশ্বরের নিদের্শ জানার জন্য তারা নবীদের আহবান করেন। নবীরা যুদ্ধে গমনই ঈশ্বরের নির্দেশ বলে জানান: ‘‘পরে (যিহূদা রাজ্যের রাজা) যিহশাফট ইসরাইলের বাদশাহকে (আহাবকে) বললেন, আরজ করি, প্রথমে মাবুদের কালামের খোঁজ করুন। তাতে ইসরাইলের বাদশাহ নবীদেরকে, অনুমান চার শত জনকে একত্র করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি রামোৎ-গিলিয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করবো, না ক্ষান্ত হব? তখন তারা বললো, যাত্রা করুন; প্রভু তা বাদশাহর হাতে তুলে দিবেন।’’ (১ রাজাবিল ২২/৫-৬, মো.-১৩)
পরে ‘মীখায়’ নামক অন্য নবী রাজাকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেন। তিনি জানান যে, ঈশ্বর নবী বা ভাববাদীদের কাছে মিথ্যাবাদী আত্মা প্রেরণ করেছেন ‘‘আমি গিয়ে তার সমস্ত নবীর মুখে মিথ্যাবাদী রূহ হবো (I will be a lying spirit in the mouth of all his prophets) ... মাবুদ আপনার এ সব নবীর মুখে মিথ্যাবাদী রূহ দিয়েছেন (the LORD hath put a lying spirit) ...।’’ (১ রাজাবলি ২২/১৫-২৩; বিশেষত: ২২/২২-২৩। পুনশ্চ ২ বংশাবলি ১৮/৪-৫ ও ২১-২২)
বাইবেলীয় এ কাহিনীও নিশ্চিত করে যে, ভাববাদীরা ঈশ্বরের নামে ও ভবিষ্যদ্বাণীর নামে মিথ্যা বলতেন এবং স্বয়ং ঈশ্বরই তাদেরকে দিয়ে মিথ্যা বলাতেন।
এ ছাড়া বাইবেলীয় নবীরা মনগড়াভাবেও ঈশ্বরের নামে মিথ্যা বলতেন। ১ রাজাবলি ১২ অধ্যায় থেকে আমরা দেখি যে, শলোমনের মৃত্যুর পরে ইহুদি রাষ্ট্র বিভক্ত হয়। উত্তরের ‘ইসরাইল’ (ইস্রায়েল) বা শমরীয় রাজ্য (Israel/Samaria) এবং দক্ষিণে জেরুজালেম কেন্দ্রিক যিহূদা, এহূদা বা জুডিয়া রাজ্য (Judea, Judaea or Judah)। ইসরাইল রাজ্যের রাজা যারবিয়াম (Jeroboam I) মুর্তিপূজা শুরু করেন।
১ রাজাবলির ১৩ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, যিহূদা রাজ্যের একজন ঈশ্বরের মানুষ (a man of God) ঈশ্বরের বাক্য দ্বারা (by the word of the LORD) যিহূদা রাজ্য থেকে বৈথলে ইসরাইল-রাজা পূজার বেদিতে উপস্থিত যারবিয়ামের নিকট এসে তাকে সতর্ক করেন। তিনি যারবিয়ামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে জানান যে, তিনি প্রতিমার জন্য যে বেদি নির্মাণ করেছেন তা দাউদের বংশের যোশিয় নামক এক শাসক ধ্বংস করে দেবেন এবং পৌত্তলিকদেরও ধ্বংস করবেন। চিহ্ন হিসেবে তিনি বেদিটার ফেটে যাওয়ার কথা বলেন এবং বেদিটা ফেটে যায়। রাজা তাঁকে ধরতে চাইলে রাজার হাতটা শুকিয়ে যায়। পরে তিনি উক্ত নবীর কাছে দুআ চাইলে তিনি দুআ করেন এবং হাতটা ভাল হয়ে যায়। রাজা তাকে খাদ্য গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং জানান যে, আল্লাহ তাঁকে এ দেশে কোনো পানাহার করতে নিষেধ করেছেন।
বৈথলের একজন ‘প্রাচীন ভাববাদী’ বা বৃদ্ধ নবী (old prophet) তাঁর পুত্রদের মুখে যিহূদা রাজ্যের এ নবীর পৌত্তলিকতা বিরোধী বক্তব্য ও অলৌকিক কর্মকাণ্ডর কথা শুনে ঈর্ষান্বিত হন। তিনি উক্ত নবীকে প্রতারণা পূর্বক হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বাহনে আরোহণ করে এহুদা রজ্যের উক্ত নবীর নিকট যেয়ে বলেন যে, তিনিও একজন নবী ‘‘আপনি যেমন নবী, তেমনি আমিও একজন নবী: I am a prophet also as thou art’’। এরপর তিনি আল্লাহর নামে জালিয়াতি করে বলেন যে, আল্লাহ পক্ষ থেকে নির্দেশ যে, যিহূদা রাজ্যের নবীকে ইসরাইল রাজ্যের নবীর বাড়িতে পানাহার করতে হবে: ‘‘মাবুদের কথামত একজন ফেরেশতা আমাকে বলেছেন যেন আমি আপনাকে আমার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাই যাতে আপনি খাবার ও পানি খেতে পারেন।’’ বাইবেলেই ঈশ্বর বলছেন: ‘‘কিন্তু তিনি মিথ্যা কথা বললেন (he lied unto him)।’’ সরলপ্রাণ যিহূদীয় নবী ইসরাইলীয় নবীর মিথ্যায় প্রতারিত হয়ে তাঁর বাড়িতে পানাহার করেন। আর ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে বৈথলে পানাহার করার কারণে ঈশ্বর প্রতারিত নবীকে হত্যা করবেন বলে প্রতারক নবীকে জানিয়ে দেন: ‘‘তাঁরা যখন খাওয়ার টেবিলের কাছে বসে আছেন, এমন সময় যিনি আল্লাহর বান্দাটিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই নবীর উপর মাবুদের কালাম নাজিল হল...।’’ উক্ত যিহূদীয় নবী যিহূদার দিকে যাত্রা করলে পথে এক সিংহ তাঁকে হত্যা করে। (১ বাদশাহনামা/ রাজাবলি ১৩/১-৩২, মো.-০৬)
এখানে আমরা দেখছি যে, একজন নবী প্রতিমাপূজার বিরুদ্ধে কথা বলে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন। এতে আরেক নবী ঈর্ষান্বিত ও বিরক্ত হয়ে আল্লাহর কালামের নামে ও ‘ওহীর’ নামে মিথ্যা বলে প্রতারণা পূর্বক তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন! সর্বাবস্থায় পবিত্র কিতাবের বক্তব্য সন্দেহাতীতাবে প্রমাণ করে যে, পবিত্র কিতাবের বা বাইবেলের নবীরা আল্লাহর নামে, ধর্মের নামে, ধর্ম প্রচারের নামে বা ভাববাণীর নামে মিথ্যা কথা বলতে পারতেন এবং বলতেন।