নতুন নিয়মের ২০তম পুস্তিকা জেমস (James), যাকোব বা ইয়াকুব। পুস্তিকাটার ইংরেজি নাম: The Letter of James/ The Epistle of St. James the Apostle): প্রেরিত শিষ্য সাধু জেমস-এর পত্র। ‘জেমস’ নামটা কেরি ও জুবিলীর অনুবাদে ‘যাকোব’ এবং কিতাবুল মোকাদ্দসে ‘ইয়াকুব’ লেখা হয়েছে। পুস্তিকাটার শুরুতে বলা হয়েছে: James, a servant of God and of the Lord Jesus Christ, to the twelve tribes which are scattered abroad, greeting। কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: ‘‘আল্লাহ ও ঈসা মাসীহের গোলাম ইয়াকুব- নানা দেশে ছড়িয়ে পড়া বারো বংশের সমীপে সালাম জানাচ্ছি।’’

কে ছিলেন এ জেমস, যাকোব বা ইয়াকুব? উইকিপিডিয়ার ‘Epistle of James’-এর বক্তব্য অনুসারে এ বিষয়ে গবেষকদের ৭টা মত বিদ্যমান: “The writer only refers to himself as ‘James, a servant of God and of the Lord Jesus Christ.’ There are seven possible authors of James. As many as six different men may be referred to in the Bible as James, and if none of these men wrote this letter, a seventh man not mentioned in the Bible by the name of James could be the author.” ‘‘লেখক নিজেকে ‘আল্লাহর ও ঈসা মাসীহের গোলাম ইয়াকুব’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। এ পুস্তকটার ৭ জন সম্ভাব্য লেখক বিদ্যমান। বাইবেলে যীশুর শিষ্যদের মধ্যে ৬ জন যাকোব/ ইয়াকুব রয়েছেন। তাঁরা কেউ যদি না লেখে থাকেন তবে বাইবেলে উল্লেখ নেই এমন সপ্তম যাকোব সম্ভবত এটা লেখেছেন।’’

তবে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা দাবি করেছেন যে, যীশুর ভাই যাকোবই এ পত্রের লেখক। নতুন নিয়মের বিভিন্ন স্থানে যীশুর ভাইবোনদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন যীশুর বিষয়ে তাঁর গ্রামবাসীরা বলেন: ‘‘একি সেই ছুতার মিস্ত্রীর ছেলে নয়? তার মায়ের নাম কি মরিয়ম নয়? আর তার ভাইয়েরা কি ইয়াকুব (James), ইউসুফ (Joses), শিমোন (Simon) ও এহুদা (Judas) নয়? তার সব বোনেরা কি আমাদের মধ্যে নেই?’’ (মথি ১৩/৫৫-৫৬)

ক্যাথলিক বিশ্বাসে মরিয়ম আজীবন কুমারী ছিলেন এবং তাঁর সতীচ্ছদ আমরণ অক্ষত ছিল। তিনি কখনোই তাঁর স্বামী ইউসুফ বা যোশেফের সাথে মিলিত হননি। তাদের মতে এরা ছিলেন যীশুর জ্ঞাতি ভাই (cousin)। অর্থোডক্স বিশ্বাসে এরা ছিলেন যীশুর পিতা ইউসুফের পূর্বের স্ত্রীর সন্তান বা যীশুর বৈমাত্রেয় ভাইবোন। প্রটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসে যীশুর জন্মের পরে মরিয়ম তাঁর স্বামীর সাথে মিলিত হন এবং সন্তান-সন্ততি জন্ম দেন। তাদের মতে এরা ছিলেন যীশুর সহোদর ভাইবোন।[1] বাইবেলের উপরের বক্তব্য প্রটেস্ট্যান্ট মতটাই প্রমাণ করে। যীশুর গ্রামবাসীর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট যে, তারা যীশুর আপন ভাইবোনদের কথাই বলেছেন।

সর্বাবস্থায়, ইঞ্জিলগুলো নিশ্চিত করেছে যে, যীশুর মাতা ও ভাইয়েরা তাঁকে পাগল বলতেন এবং তাঁকে অবিশ্বাস করতেন। তাঁরা তাঁর উপর ঈমান আনেননি। ইউহোন্না বা যোহন লেখেছেন (৭/৫): ‘‘আসলে ঈসার ভাইয়েরাও তাঁর উপর ঈমান আনেননি।’’ শুধু তাই নয়; উপরন্তু তাঁরা যীশুকে পাগল মনে করতেন। মার্ক (৩/২১) লেখেছেন, ‘‘ইহা শুনিয়া তাঁহার আত্মীয়েরা (family) তাঁহাকে ধরিয়া লইতে বাহির হইল, কেননা তাহারা বলিল, সে হতজ্ঞান হইয়াছে (কি. মো.: তাঁরা বললেন, ‘ও পাগল হয়ে গেছে’)’’।

আর এজন্যই যীশুও তাদেরকে অবিশ্বাসী হিসেবেই অপমান করতেন। তাঁকে পাগল বলার পর যখন তাঁর মা ও ভাইয়েরা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন তখন তিনি তাঁদের সাক্ষাৎ দিতে অস্বীকার করেন এবং তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছা পালন করেন না বলে উল্লেখ করেন। যীশুকে পাগল বলার বিষয়টা উল্লেখ করার কয়েক লাইন পরে মার্ক লেখেছেন: ‘‘এর পরে ঈসার মা ও ভাইয়েরা সেখানে আসলেন এবং বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে ডেকে পাঠালেন। ঈসার চারিদিকে তখন অনেক লোক বসেছিল। তারা তাঁকে বলল, ‘আপনার মা ও ভাইয়েরা বাইরে আপনার খোঁজ করছেন।’ যীশু বললেন: কে আমার মা, আর কারা আমার ভাই? যারা তাঁকে ঘিরে বসে ছিল তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই তো আমার মা ও ভাইয়েরা! আল্লাহর ইচ্ছা যারা পালন করে তারাই আমার ভাই, বোন ও মা।’’ (মার্ক ৩/৩১-৩৫; মথি ১২/৪৬-৫০, লূক ৮/১৯-২১)

সম্ভবত এ অবিশ্বাসের কারণেই যীশুর ভাই যাকোব/ ইয়াকুব, এহুদা/ জুদাস বা অন্য কেউ তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে যাননি এবং তাঁর মৃতদেহ গ্রহণেরও চেষ্টা করেননি। শুধু তাঁর মা এবং শিষ্য যোহন তাঁর পাশে ছিলেন। যীশুর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের বর্ণনায় যোহন লেখেছেন: ‘‘নিজের মাকে ও তাঁর পাশে যে শিষ্যকে তিনি ভালবাসতেন তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যীশু মাকে বললেন, নারী, ওই দেখ তোমার ছেলে। তারপর তিনি শিষ্যটাকে বললেন, ‘ওই দেখ, তোমার মা।’ আর সেই ক্ষণ থেকে শিষ্যটা তাঁকে নিজের ঘরে গ্রহণ করে নিলেন। (জুবিলী বাইবেল: যোহন ১৯/২৬-২৭, মো.-১৩)

এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, যীশুর মাতা মাতৃত্বের টানে ক্রুশবিদ্ধ পুত্রকে দেখতে গেলেও তাঁরা ভাইয়েরা তাঁকে এতই অবিশ্বাস করতেন যে, রক্তের টানেও তাঁরা তাঁর কাছে যাননি। সম্ভবত তাঁরা তাঁদের মাকেও দেখতেন না। আর এজন্যই যীশু তাঁর মাতাকে তাঁর শিষ্যের নিকট সমর্পণ করে যান। যদিও প্রশ্ন থেকেই যায় যে, যীশুর অতগুলো ভাইবোন থাকা সত্ত্বেও যীশুর মাতাকে একজন শিষ্যের কাছে সমর্পন করার অর্থই বা কী এবং প্রয়োজনই বা কী?

কিন্তু যীশুর স্বর্গারোহণের পরে যীশুর উম্মাতের কর্ণধার হন তাঁর ভাই যাকোব বা ইয়াকুব। দ্বাদশ প্রেরিত শিষ্য এবং জেরুজালেমের সকল শিষ্য বা সাহাবী তাঁকেই খ্রিষ্টান-মণ্ডলী বা জামাতের প্রধান পুরোহিত বা ইমাম হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতোপূর্বে হিয়াম ম্যাকবির বক্তব্যে আমরা দেখেছি যে, জেরুজালেমে অবস্থানরত যীশুর মূল শিষ্যরা যাকোবের নেতৃত্বে পলের বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। আর যাকোবের পত্র বলে আখ্যায়িত নতুন নিয়মের ২০তম এ পত্রটা মূলত সাধু পলের ‘বিশ্বাসেই মুক্তি’ মতবাদ খণ্ডনের জন্য লেখা। তৃতীয় অধ্যায়ে বৈপরীত্য প্রসঙ্গে বিশ্বাসেই মুক্তি না কর্মেরও প্রয়োজন অনুচ্ছেদে পাঠক এ বিষয়ে কিছু জানতে পারবেন।

কখন লেখা হয়েছিল যাকোবের পত্রটা? প্রথম শতাব্দীর শেষার্ধে? দ্বিতীয় শতাব্দীতে? নানা মুনির নানা মত। উইকিপিডিয়া ‘Epistle of James’ প্রবন্ধে ‘Dating’ অনুচ্ছেদে লেখেছে: “Many scholars consider the epistle to be written in the late 1st or early 2nd centuries.... The earliest extant manuscripts of James usually date to the mid-to-late third century.” ‘‘অনেক গবেষক মনে করেন যে, এ পত্রটা প্রথম শতকের শেষাংশে বা দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশে লেখা। ... এ পুস্তকটার বিদ্যমান পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটা তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে বা শেষভাগে লেখা।’’

[1] Louay Fatoohi, The Mystery of the Historical Jesus (2009), p 200-203.