এ ইঞ্জিলটা প্রচলিত হওয়ার পর থেকেই অনেক খ্রিষ্টান এর সত্যতা ও বিশুদ্ধতা অস্বীকার করতেন। তারা এটাকে মারফতি কোনো বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের রচনা বলে বিশ্বাস করতেন। কারণ পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, প্রথম প্রজন্মের খ্রিষ্টানরা ঈসা (আ.)-কে একজন মানুষ নবী বলেই বিশ্বাস করতেন। হিব্রু পরিভাষায় নেক মানুষ বা প্রিয় মানুষ হিসেবে তাকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হত। পাশাপাশি তারা তাঁকে আল্লাহর বান্দাও বলতেন। পরবর্তী প্রজন্মের অ-ইহুদি রোমান-গ্রিক খ্রিষ্টানরা ‘আল্লাহর পুত্র’ পরিভাষাটাকে বিশেষ মর্যাদাময় বলে গণ্য করতে শুরু করেন। কিভাবে মানুষ হয়েও তিনি আল্লাহর পুত্র তা ব্যাখ্যা করতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মত জন্ম নিতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকেই বলতে থাকেন যে, তিনি ঈশ্বরের দত্তক পুত্র। অর্থাৎ তিনি মানুষ হিসেবেই জন্মেছেন, তবে ঈশ্বর তাঁকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্রথম তিন ইঞ্জিল, প্রেরিতগণের কার্যবিবরণী ও সাধু পলের বক্তব্যগুলো প্রমাণ করে যে, প্রথম শতাব্দীর খ্রিষ্টানরা এ ধারারই অনুসারী ছিলেন। এরা মূলত একত্ববাদী ছিলেন। তাদের বিশ্বাসে যীশুকে দত্তক নেওয়ার অর্থ তাঁকে বিশেষ সম্মান দেওয়া। কেউ দ্বিত্ববাদী হয়ে যান; তারা দাবি করেন যে, যীশু মূলত মানুষ ছিলেন, তবে তাকে ‘দত্তক’ গ্রহণ করার পর থেকে তিনি ‘দেবতা’য় পরিণত হন। উল্লেখ্য যে, ত্রিত্ববাদ তখনো জন্ম নেয়নি।
দত্তকতত্ত্ব (Adoptionism) প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া লেখেছে:
“Adoptionism ... is a minority Christian belief that Jesus was adopted as God's Son either at his baptism, his resurrection, or his ascension. .... Some scholars see Adoptionist concepts in the Gospel of Mark and in the writings of the Apostle Paul. ...By the time the Gospels of Luke and Matthew were written, Jesus is identified as being the Son of God from the time of birth. Finally, the Gospel of John portrays him as the pre-existent Word.. as existing "in the beginning". ... Paul's writings do not explicitly mention a Virgin birth of Christ. Paul wrote that Jesus was "born of a woman, born under the law" and "as to his human nature was a descendant of David" in the Epistle to the Galatians and the Epistle to the Romans. Hebrews 1:5 states that God said, "You are my son. Today I have begotten you," a phrase that shows adoptionist tendencies....”
‘‘দত্তকতত্ত্ব একটা সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস। এর অর্থ যীশু ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে গৃহীত হন তাঁর বাপ্তাইজের সময়ে বা পুনরুত্থানের সময়ে বা ঊর্ধ্বারোহণের সময়ে। ... কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, মার্কের ইঞ্জিলে ও প্রেরিত পলের লেখনিতে দত্তকবাদী ধারণা পাওয়া যায়। ... যখন লূক ও মথির ইঞ্জিল লেখা হয় তখন যীশুকে ‘জন্ম থেকেই ঈশ্বরের পুত্র’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। সর্বশেষ যোহনের ইঞ্জিলে যীশুকে অনাদিকাল থেকে বিরাজমান বাক্য হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। ..... পলের লেখনিতে খ্রিষ্টের কুমারী মাতা থেকে জন্মের বিষয়টা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। গালাতীয়দের প্রতি পত্রে (৪/৪) এবং রোমানদের প্রতি পত্রে (১/৩) সাধু পল লেখেছেন যে, যীশু একজন নারীর সন্তান, তিনি শরীয়ত-সম্মত সন্তান এবং মানুষ হিসেবে তিনি দাউদের বংশধর। ইব্রীয়দের প্রতি পত্র ১/৫ উল্লেখ করেছে যে, ঈশ্বর বলেন: ‘তুমি আমার পুত্র; আমি অদ্য তোমাকে জন্ম দিয়াছি’। এ বাক্যটা দত্তকবাদী প্রবণতা প্রকাশ করে। এ বাক্যটা প্রায় সরাসরি গীতসংহিতা ২ থেকে উদ্ধৃত।’’[1]
ক্রমান্বয়ে যীশুর প্রতি অতিভক্তি ও তাঁর প্রতি দেবত্বারোপ প্রবণতা বাড়তে থাকে। গ্রিক পৌত্তলিক দর্শনের প্রভাবে তাঁকে ঈশ্বরের বাক্য ও ঈশ্বরের মতই অনাদি বলে দাবি করা হতে থাকে। একে বাক্যতত্ত্ব (Logos theology) বলা হয়। যোহনের ইঞ্জিলে এ ধারাটাই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য দত্তকবাদী খ্রিষ্টানরা যোহনের ইঞ্জিল বাতিল ও মারফতি বিভ্রান্তদের রচিত বলে দাবি করতেন। কিন্তু সময়ের আবর্তনে ক্রমান্বয়ে অতিভক্তির মতই জোরালো হতে থাকে। দ্বিতীয় শতকের শেষ দিকে এসে বাক্যবাদী খ্রিষ্টানরা দত্তকবাদী খ্রিষ্টনাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেন। দত্তকবাদীদেরকে ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করা হয় ও ক্রমান্বয়ে নির্মূল করা হয়।[2]
বাক্যবাদীরা দত্তকবাদীদেরকে ‘এলোগি’ (Alogi) বলতেন। উইকিপিডিয়া Development of the New Testament canon/Alogi প্রবন্ধে লেখছে:
“There were those who rejected the Gospel of John (and possibly also Revelation and the Epistles of John) as either not apostolic or as written by the Gnostic Cerinthus or as not compatible with the Synoptic Gospels. Epiphanius of Salamis called these people the Alogi, because they rejected the Logos doctrine of John and because he claimed they were illogical. ... Gaius or Caius, presbyter of Rome (early 200s), was apparently associated with this movement.”
‘‘অনেকেই যোহনের ইঞ্জিল প্রত্যাখ্যান করেন। (এবং সম্ভবত তারা প্রকাশিত বাক্য ও যোহনের পত্রাবালিও প্রত্যাখ্যান করেন)। তাদের মতে এগুলো প্রেরিত শিষ্যদের রচিত নয়। অথবা এগুলো মারফতি সেরিন্থাসের (মৃত্যু ১০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে) লেখা। অথবা এগুলো প্রথম তিন সমমতীয় ইঞ্জিলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সালামিসের এপিফানাস (মৃত্যু ৪০৩ খ্রি.) এ সকল খ্রিষ্টানকে ‘এলোগি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তারা যোহনের উপস্থাপিত বাক্যতত্ত্ব অস্বীকার করত। এছাড়া তিনি দাবি করেন যে, তারা অযৌক্তিক মতের অনুসারী। ... রোমের প্রেসবিটার গ্যইআস বা কাইআস (২০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে) বাহ্যত এ আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত ছিলেন।’’
উইকিপিডিয়া যোহনের সুসমাচার প্রবন্ধে লেখেছে:
“... In the 2nd century, the two main, conflicting expressions of Christology were John's Logos theology, according to which Jesus was the incarnation of God's eternal Word, and adoptionism, according to which Jesus was "adopted" as God's Son. Christians who rejected Logos Christology were called "Alogi," and Logos Christology won out over adoptionism.”
‘‘দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্ট বিষয়ক দুটো পরস্পর বিরোধী মতবাদ প্রচলিত ছিল: একটা যোহনের ‘বাক্য’ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুসারে যীশু ছিলেন ঈশ্বরের অনাদি বাক্যের অবতার। অন্য মতটা হল ‘দত্তক’ তত্ত্ব। এ মত অনুসারে যীশু ঈশ্বরের ‘দত্তক’ পুত্র। যে সকল খ্রিষ্টান বাক্যতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করতেন তাদেরকে ‘এলোগি’ বলা হত। বাক্যতত্ত্বের খ্রিষ্টধর্ম দত্তকতত্ত্বের খ্রিষ্টধর্মের উপর বিজয় লাভ করে।’’[3]
[2] উইকিপিডিয়া: Adoptionism.
[3] উইকিপিডিয়া: Gospel of John.