পাশাপাশি অন্য একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যীশু অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনি-ইসরাইল বা ইহুদিদের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। উপরন্তু তিনি তাঁর প্রেরিতদেরকে অ-ইহুদিদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন।
যীশু তাঁর ১২ শিষ্যকে ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে বলেন: ‘‘তোমরা অ-ইহুদীদের (Gentiles পরজাতি) পথে যেও না এবং সামেরিয়দের কোন নগরে প্রবেশ করো না, বরং ইসরাইল-কুলের হারানো মেষদের কাছে যাও। আর তোমরা যেতে যেতে এই সুমাচার তবলিগ কর, বেহেশতী-রাজ্য সন্নিকট।’’ (মথি ১০/৫-৮, মো.-১৩)
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন: ‘‘পবিত্র বস্ত্ত কুকুরদেরকে দিও না এবং তোমাদের মুক্তা শূকরের সম্মুখে ফেলো না; পাছে তারা পা দিয়ে তা দলায় এবং ফিরে তোমাদেরকে আক্রমণ করে।’’ (মথি ৭/৬, মো.-১৩)
অর্থাৎ ইস্রায়েলের ১২ গোত্রের মানুষ ছাড়া সকলেই কুকুর ও শূকরতুল্য। কাজেই কোনো পবিত্র বস্ত্ত তাদেরকে দেওয়া যাবে না।
অন্যত্র বলা হয়েছে: ‘‘আর দেখ, ঐ অঞ্চলের এক জন কেনানীয় স্ত্রীলোক এসে এই বলে চেঁচাতে লাগল, হে প্রভু, দাউদ-সন্তান, আমার প্রতি করুণা করুন, আমার কন্যাটিকে বদ-রূহে পেয়েছে এবং অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তিনি তাকে কোনই জবাব দিলেন না। তখন তাঁর সাহাবীরা কাছে এসে তাঁকে নিবেদন করলেন, একে বিদায় করুন, কেননা সে আমাদের পিছনে পিছনে চেঁচাচ্ছে। জবাবে তিনি বললেন, ইসরাইল-কুলের হারানো ভেড়া ছাড়া আর কারো কাছে আমি প্রেরিত হইনি। কিন্তু স্ত্রীলোকটি এসে তাঁকে সেজ্দা করে বললো, প্রভু, আমার উপকার করুন। জবাবে তিনি বললেন, সন্তানদের খাদ্য নিয়ে কুকুরদের কাছে ফেলে দেওয়া ভাল নয়। (মথি ১৫/২২-২৮, মো.-১৩। পুনশ্চ: মার্ক ৭/২৫-২৯)
যেহেতু তিনি শুধু হিব্রু-আরামাইক ইহুদি জাতির জন্য প্রেরিত এবং তাঁর শিষ্যরা শুধু তাঁদের মধ্যেই প্রচারের জন্য প্রেরিত, কাজেই তাঁদের ও তাঁদের জাতির মাতৃভাষা ও ধর্মীয় ভাষা বাদ দিয়ে তাঁদের জাতির নিকট ঘৃণিত ও অব্যবহৃত ‘গ্রিক’ ভাষায় ইঞ্জিল প্রচার করবেন কেন? অ-ইহুদিদের মাঝে ধর্ম প্রচারই যেহেতু নিষিদ্ধ সেহেতু অ-ইহুদি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনার অবকাশ কোথায়?
বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে কবর থেকে পুনরুত্থানের পর তিনি বলেন: ‘‘তোমরা সমুদয় জগতে যাও, সমস্ত সৃষ্টির নিকটে সুসমাচার প্রচার কর।’’ (মার্ক ১৬/১৫)
এ নির্দেশ সত্য হলেও তা তিনি পুনরুত্থানের পরে দিয়েছেন। আর তিনি তাঁর ইঞ্জিল তো এর আগেই প্রচার করেছেন। কাজেই নিশ্চিতভাবেই তিনি তাঁর ইঞ্জিল হিব্রু বা আরামাইক ভাষায় প্রচার করেছেন।
তবে পুনরুত্থানের পরে ‘অ-ইহুদিদের’ কাছে ধর্ম প্রচারের নির্দেশটা বাহ্যত পরবর্তী সংযোজন। কারণ ‘প্রেরিত’ পুস্তকের ১০ অধ্যায় থেকে পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনার আগে অ-ইহুদিদের মধ্যে যীশুর ধর্ম প্রচারের কোনো চিন্তাই শিষ্যরা করেননি। এর পূর্ব পর্যন্ত তাঁরা নিজেদেরকে ইহুদি বলে বিশ্বাস করতেন এবং অ-ইহুদিদেরকে অপবিত্র বলে মনে করতেন। এ ঘটনায় পিতর ঈশ্বরের পক্ষ থেকে নির্দেশ পান যে, অ-ইহুদিদের কাছে যেতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: ‘‘আপনারা তো জানেন, ইহুদী নয় এমন কোন লোকের সঙ্গে যোগ দেওয়া কিংবা তার কাছে আসা ইহুদী লোকের পক্ষে আইনসম্মত নয়; কিন্তু আমাকে আল্লাহ্ দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কোন মানুষকে নাপাক কিংবা অপবিত্র বলা উচিত নয়।’’ (প্রেরিত ১০/২৮, মো.-১৩)।
‘প্রেরিত’ পুস্তকের ১১ ও ১৫ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অ-ইহুদি কিছু মানুষকে যীশুর ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার কারণে প্রেরিতগণ ও অন্যান্য শিষ্য কঠিন আপত্তি করেন। বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক এমন কঠিন পর্যায়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত ৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জেরুজালেমে প্রেরিতগণ ও খ্রিষ্টধর্মীয় প্রাচীনবর্গের ‘মহাসম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে অ-ইহুদিদের খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দেওয়ার পক্ষে পিতর নিজের স্বপ্নের কথা বলেন এবং পুরাতন নিয়ম থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করে অ-ইহুদিদেরও ধর্মশিক্ষা দেওয়া বৈধ বলে প্রমাণের চেষ্টা করেন। সাধু পল বিভিন্ন পত্রে পুরাতন নিয়ম থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে অ-ইহুদিদের ধর্মান্তর করার বৈধতা দাবি করেছেন। কিন্তু পল, পিতর বা অন্য কোনো প্রেরিত বা শিষ্য কখনোই বলেননি যে, যীশু অ-ইহুদিদের নিকট সুসমাচার প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়টা নিশ্চিত করে যে, পুনরুত্থানের পর সকল জাতির কাছে সুসমাচার প্রচার বা বাপ্তাইজ করার কোনো নির্দেশনাই প্রেরিতগণ এবং প্রথম প্রজন্মের শিষ্যরা জানতেন না।
কেউ কি কল্পনা করতে পারেন যে, যীশু মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের পর ১১ জন প্রেরিতকে একত্র করে একটামাত্র নির্দেশ প্রদান করবেন, কিন্তু প্রেরিতগণ সকলেই তা একেবারেই ভুলে যাবেন? তাঁরা অ-ইহুদিদের শিক্ষা দিচ্ছেন না। অন্য কেউ দিলে আপত্তি করছেন এবং যারা দিচ্ছেন তাঁরাও নানাবিধ অপ্রাসঙ্গিক প্রমাণ পেশ করছেন, কিন্তু কেউই যীশুর নির্দেশের কথা বলছেন না? এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, যীশু শিষ্যদেরকে সকল জাতির নিকট গমনের নির্দেশ দেননি। অথবা সকল জাতি বলতে তাঁরা ইহুদিদের সকল সম্প্রদায় বুঝেছেন। সর্বাবস্থায় যীশুর শিষ্যরা নিজেদেরকে ইহুদি জাতির প্রতি প্রেরিত বলে বিশ্বাস করতেন এবং তাঁদের ভাষাতেই ইঞ্জিল প্রচার করতেন। অন্যদের ভাষায় ইঞ্জিল লেখা তো দূরের কথা, অন্য জাতির মানুষদের সাথে সংমিশ্রণই তো ইহুদি ধর্মে নিষিদ্ধ আপত্তিকর বিষয় বলে নিশ্চিত করেছেন পিতর।