ইঞ্জিলগুলো যেহেতু যীশুর নামে প্রচারিত সেহেতু তিনি কী ভাষায় ধর্ম প্রচার করেছেন তা জানা দরকার। পাণ্ডুলিপি বিষয়ক পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, নতুন নিয়মের সকল প্রাচীন ও আধুনিক পাণ্ডুলিপি গ্রিক ভাষায় লিখিত। কিন্তু ঈসা মাসীহ গ্রিকভাষী ছিলেন না। তিনি এবং তাঁর জাতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় কথা বলতেন।
প্রাচীন যুগ থেকে ইহুদি জাতির ধর্মীয় ও জাগতিক ভাষা ছিল হিব্রু। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর দিক থেকে ‘আরামীয়’ বা আরামাইক (Aramaic) ভাষা ইহুদি জাতি ও ফিলিস্তিনের সাধারণ ভাষায় (LINGUA FRANCA) পরিণত হয়। আরামাইক ও হিব্রু উভয়ই সেমিটিক ভাষা এবং উভয় ভাষার মধ্যে মিল ও নৈকট্য খুবই বেশি। অনেকটা আসামীয় ও বাংলা বা উর্দু ও হিন্দির মত। যীশু খ্রিষ্টের সময়ে ফিলিস্তিনের এবং ইহুদি জাতির সাধারণ ভাষা ছিল আরামীয় বা আরামাইক ভাষা। তিনি, তাঁর শিষ্যরা এবং তাঁর সমাজের সকল মানুষ এ ভাষাতেই কথা বলতেন। এ সময়ে ফিলিস্তিন গ্রিকভাষী শাসকদের অধীনে ছিল। তবে ইহুদি বা ফিলিস্তিনের জুডিয়া রাজ্যের অধিবাসীরা সাধারণভাবে গ্রিক জানতেন না। এ বিষয়ে উইকিপিডিয়ার ‘যীশুর ভাষা’ (Language of Jesus) প্রবন্ধের বক্তব্য নিম্নরূপ:
“It is generally agreed that Jesus and his disciples primarily spoke Aramaic, the common language of Judea in the first century AD, ... Aramaic was the common language of the Eastern Mediterranean during and after the Neo-Assyrian, Neo-Babylonian, and Achaemenid Empires (722–330 BC) and remained a common language of the region in the first century AD. In spite of the increasing importance of Greek, the use of Aramaic was also expanding, and it would eventually be dominant among Jews both in the Holy Land and elsewhere in the Middle East around 200 AD and would remain so until the Islamic conquests in the seventh century... According to Hebrew historian Josephus, Greek was not spoken in first century Palestine. Josephus also points out the extreme rarity of a Jew knowing Greek. Josephus wrote: ... our nation does not encourage those that learn the languages of many nations.”
‘‘সাধারণভাবে এ বিষয়ে ঐকমত্য বিদ্যমান যে যীশু ও তাঁর শিষ্যরা মূলত আরামীয়/ আরামাইক ভাষায় কথা বলতেন। এটাই প্রথম খ্রিষ্টীয় শতকে যুডিয়া রাজ্যের সাধারণ ভাষা ছিল। ... নিও আসিরীয়ান, নিও ব্যবিলোনিয়ান ও আকীমেনিড রাজত্বে (খ্রি. পূ. ৭২২-৩৩০) ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় আরামীয় ভাষাই ছিল সাধারণ ভাষা। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চলের ভাষা এটাই ছিল। গ্রিক ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও আরামাইক ভাষার ব্যবহার ব্যাপক হতে থাকে। ২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ইহুদিদের মধ্যে এবং মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র ইহুদিদের মধ্যে এ ভাষার প্রাধান্য বিরাজ করে। ৭ম খ্রিষ্টীয় শতকে আরব বিজয় পর্যন্ত এ ভাষার কর্তৃত্ব বজায় ছিল। ... যোসেফাসের বর্ণনা অনুসারে প্রথম শতাব্দীতে ফিলিস্তিনে গ্রিক ভাষা বলা হত না। যোসেফাস আরো উল্লেখ করেছেন যে, গ্রিক ভাষা জানা ইহুদির সংখ্যা খুবই কম ছিল। যোসেফাস লেখেছেন: ... আমার জাতি ভিন্ন জাতির ভাষা শিক্ষায় উৎসাহ দেয় না।’’
আমরা বলেছি যে, প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো গ্রিক ভাষায় রচিত। তবে গ্রিক ইঞ্জিলের মধ্যে উদ্ধৃত যীশুর বিভিন্ন বক্তব্য প্রমাণ করে যে, তিনি আরামাইক এবং হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন। এখানে কয়েকটা নমুনা উল্লেখ করছি: (কেরি/ মো.-১৩)
(১) ‘‘পরে তিনি বালিকার হাত ধরে তাকে বললেন, টালিথা কুমী (Talitha cumi); অনুবাদ করলে এর অর্থ এই, বালিকা তোমাকে বলছি উঠ। (মার্ক ৫/৪১)।
এখানে গ্রিক ইঞ্জিল লেখক ‘তালিথা, কুমী’ বাক্য দুটো হুবহু আরামাইক ভাষায় লেখে তার অনুবাদ বা ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন। তালিথা অর্থ বালিকা এবং আরবি ভাষার মতই ‘কুম’ বা ‘কুমী’ অর্থ দাঁড়াও।
(২) মার্ক ৭/৩৪ নিম্নরূপ: ‘‘আর তিনি আসমারেন দিকে দৃষ্টি করে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তাকে বললেন, ইপ্ফাথা (Ephphatha), অর্থাৎ খুলে যাক।’’
এখানেও গ্রিক ইঞ্জিল লেখক ‘ইপফাথা’ শব্দটা আরামীয় ভাষায় হুবহু লেখে এরপর তার অনুবাদ লেখেছেন। হিব্রু ও আরবি ভাষার মত আরামীয় ভাষাতেও ‘ফাতাহা’ অর্থ খোলা এবং ‘ইফতাহ’ বা ‘ইফফাতা’ অর্থ খোল বা খুলে যাক।
(৩) মার্ক ১৪/৩৬: ‘‘তিনি বললেন, আববা (Abba), পিতা, তোমার পক্ষে সকলই সম্ভব; আমার কাছ থেকে এই পানপাত্র দূর কর...।
এখানেও গ্রিক লেখক ‘আববা’ শব্দটা হুবহু আরামীয় ভাষায় লেখে পাশে তার অর্থ ‘পিতা’ লেখেছেন। হিব্রু ও আরবির মতই আরামীয় ভাষায় ‘আবূ’ অর্থ পিতা।
(৪) মথি ৫/২২ ইংরেজি নিম্নরূপ: ‘‘... and whosoever shall say to his brother, Raca, shall be in danger of the council”: .. ‘‘আর যে কেউ আপন ভাইকে বলে, ‘রাকা’ (Raca: রে নির্বোধ) সে মহাসভার বিচারের দায়ে পড়বে।
এখানে গ্রিক ইঞ্জিল লেখক আরামীয় ‘রাকা’ শব্দটাকে হুবহু রেখে দিয়েছেন। ইংরেজিতেও তা হুবহু রয়েছে। তবে বাংলা বাইবেলে শব্দটা অনুবাদ করা হয়েছে।
(৫) যোহন ২০/১৬ ইংরেজি কিং জেমস ভার্শনে নিম্নরূপ: “Jesus saith unto her, Mary. She turned herself, and saith unto him, Rabboni; which is to say, Master.” অর্থাৎ ‘‘যীশু তাঁকে বললেন, মরিয়ম। তিনি নিজেকে ফেরালেন এবং তাঁকে বললেন: ‘রাববূনি’, এর অর্থ: প্রভু।’’ রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শনের ভাষ্য নিম্নরূপ: “Jesus said to her, Mary. She turned and said to him in Hebrew, ‘Rabboni’ (which means Teacher).” অর্থাৎ ‘‘যীশু তাঁকে বললেন, মরিয়ম। তিনি ফিরলেন এবং তাকে হিব্রু ভাষায় বললেন: ‘রাববূনি’ (এর অর্থ শিক্ষক)।’’
বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: ‘‘ঈসা তাঁকে বললেন, মরিয়ম। তিনি ফিরে ইবরানী ভাষায় তাঁকে বললেন, রববূণি! এর অর্থ ‘হে গুরু’।
এখানে আমরা দেখছি যে, রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শনে শব্দটাকে হিব্রু বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত ‘রাবব’, ‘রাববী, ‘রাববূনি’ শব্দগুলো আরবি, হিব্রু ও আরামাইক ভাষার শব্দ। ব্যবহার পদ্ধতির কিছু পার্থক্য আছে। গ্রিক বাইবেলে মূল হিব্রু শব্দটা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। দেখুন: মথি ২৬/২৫, ৪৯; মার্ক ৯/৫, ১১/২১, ১৪/৪৫; যোহন: ১/৪৯, ৪/৩১, ৬/২৫, ৯/২, ১১/৮।
(৬) মথি ২৭/৪৬: ‘‘আর নবম ঘটিকার সময়ে ঈসা জোরে চিৎকার করে ডেকে বললেন, ‘এলী এলী লামা শবক্তানী’, অর্থাৎ ‘‘আল্লাহ্ আমার, আল্লাহ্ আমার, তুমি কেন আমায় পরিত্যাগ করেছ?’’ এখানেও গ্রিক বাইবেলে যীশুর বক্তব্য মূল আরামাইক ভাষায় উদ্ধৃত করা হয়েছে। মার্কের ১৫ অধ্যায়ের ৩৪ শ্লোকেও বক্তব্যটা মূল আরামাইক ভাষায় এভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
স্বভাবতই একজন শিক্ষিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে যীশু ইহুদি জাতির ধর্মীয় ভাষা ‘হিব্রু’ জানতেন, বলতেন এবং ধর্মীয় আলোচনায় হিব্রু ভাষা ব্যবহার করতেন বলেই প্রতীয়মান। বাইবেলের বর্ণনায় সাধু পলের সাথে কথা বলতে তিনি হিব্রু ভাষায় কথা বলেন: ‘‘তখন আমরা সকলে ভূমিতে পড়ে গেলে আমি একটি বাণী শুনলাম সেটি ইবরানী ভাষায় আমাকে বললো, ‘শৌল, শৌল, কেন আমাকে নির্যাতন করছো? কাঁটার মুখে পদাঘাত করা তোমার পক্ষে কষ্টকর!’’। (প্রেরিত ২৬/১৪, মো.-১৩)
আমরা পরবর্তীতে দেখব যে, সাধু পল মূলত গ্রিক ভাষায় সুপণ্ডিত গ্রিক ইহুদি ছিলেন। এরপরও আমরা দেখছি যে, সাধু পলের বর্ণনা অনুসারে, ঊর্ধ্বগমনের পরেও তিনি এরূপ একজন গ্রিক পণ্ডিতের সাথে হিব্রু ভাষায় কথা বলছেন। এ সকল বিষয় নিশ্চিত করে যে, যীশু হিব্রু অথবা আরামীয় ভাষায় কথা বলতেন। কখনোই তাঁর ওয়ায ও প্রচার গ্রিক ভাষায় ছিল না। তিনি গ্রিক ভাষা জানতেন কিনা, অথবা কখনো গ্রিক ভাষায় কারো সাথে কথা বলেছেন কিনা সে বিষয়ে গবেষকদের মতবিরোধ রয়েছে। তবে তিনি যে জাতির মানুষদের কাছে তাঁর ধর্ম প্রচার করতেন তাদের মধ্যে গ্রীক ভাষায় কথা বলার প্রচলন ছিল না। উপরন্তু তারা বিজাতীয় ভাষাকে ঘৃণা করতেন।[1]