২. ১. ধর্মগ্রন্থের প্রামাণ্যতার প্রয়োজনীয়তা

সুপ্রিয় পাঠক, কেউ যদি আপনার কাছে আপনার মৃত পিতামহ বা পূর্বপুরুষের কোনো লিখিত দলিল উপস্থিত করে বলেন যে, আপনার বাড়ি বা জমি তিনি বিক্রয় বা দান করে গিয়েছেন তবে আপনি কি দলিলের বিশুদ্ধতা যাচাই ও নিশ্চয়তা ছাড়া বাড়ি বা জমি তাকে ছেড়ে দেবেন? যদি তিনি আপনার বাড়ি বা জমি দখলের জন্য আদালতে তার দলিল জমা দিয়ে মামলা করেন তবে আপনি কি বিচারককে দলিলটার বিশুদ্ধতা বিষয়ে নিশ্চিত হতে অনুরোধ করবেন না? যদি বিচারক আপনার পিতামহের নামের দলিল দেখেই তা মেনে নিয়ে রায় দেন তবে আপনি কি আপিল করবেন না?

আপনার প্রতিপক্ষ প্রচার মাধ্যম বা জাগতিক প্রভাব খাটিয়ে যদি এরূপ জাল দলিল আদালতে বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং আপনাকেই পরের জমি দখলকারী বলে চিত্রিত করেন তবে আপনি কি নিজেকে অপরাধী বলে বিশ্বাস করে নেবেন? প্রচারণা, প্রতারণা বা জাগতিক প্রভাব খাটিয়ে হাজার হাজার মানুষকে প্রভাবিত করতে পারা কি কোনো দলিলের বিশুদ্ধতার প্রমাণ? জাগতিক কোনো দলিল যদি এরূপ অনুসন্ধান, তদন্ত ও নিশ্চয়তা ছাড়া কেউ গ্রহণ করেন বা তার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড, সম্পত্তি হস্তান্তর ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেন তবে আপনি তাকে কী বলবেন?

ধর্মগ্রন্থের বিষয়ে আরো অনেক বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ জাগতিক দলিলের জালিয়াতি বা ভুলের কারণে টাকা, সম্পত্তি বা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন নষ্ট হয়। আর ধর্মীয় দলিলের জালিয়াতি বা ভুলের কারণে অনন্ত জীবন নষ্ট হয়।

একটা গ্রন্থ কোনো নবী বা ধর্মপ্রবর্তকের নামে প্রচারিত হলেই তাকে মেনে নেওয়া যায় না। গ্রন্থটা তাঁর লেখা কিনা এবং তাঁর থেকে বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত সূত্রে বর্ণিত কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া তিনি এটাকে ঐশী প্রেরণায় লেখা বই বা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে দাবি ও প্রচার করেছেন কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য বাইবেলীয় পুস্তকগুলোর বিষয়ে আমাদের দুটো বিষয় নিশ্চিত হতে হবে: (ক) পুস্তকগুলো যাদের নামে প্রচারিত আদৌ সেগুলো তাঁদের লেখা কিনা এবং (খ) তাঁরা এগুলোকে ওহী-নির্ভর পুস্তক হিসেবে দাবি করেছেন কিনা। আমরা দেখব যে, বাইবেলের পুস্তকগুলোর ক্ষেত্রে এ দুটো বিষয় প্রমাণ করা অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান।

শুধু ধারণা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে কোনো গ্রন্থকে কোনো নবীর লেখা বা কোনো ওহী বা প্রেরণা (Inspiration)-প্রাপ্ত ব্যক্তির বলে দাবি করলে বা প্রচার করলেই তা সে ব্যক্তির লেখা গ্রন্থ বলে প্রমাণিত বা স্বীকৃত হতে পারে না।

ইতোপূর্বে নতুন ও পুরাতন নিয়মের অতিরিক্ত পুস্তকগুলোর আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, এরূপ অনেক গ্রন্থই অনেক নবী বা শিষ্যের নামে প্রচারিত, যেগুলো ইহুদি খ্রিষ্টানরাও সে সকল নবীর গ্রন্থ বলে স্বীকার করেন না। মোশি, ইয্রা, যিশাইয়, যিরমিয়, শলোমন,  মথি,  লূক, মার্ক, যোহন, পিতর, যাকোব প্রমুখের নামে অনেক পুস্তক বাইবেলের অংশ হিসেবে লিখিত ও প্রচলিত হয়েছে এবং অসংখ্য ইহুদি ও খ্রিষ্টান যেগুলোকে ঐশী পুস্তক হিসেবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সেগুলোকে এ সকল নবীর লেখা পুস্তক বলে স্বীকার করেন না। ইহুদি- খ্রিষ্টানরা এগুলোকে জাল (Pseudepigrapha) বলে গণ্য করেন।

আমরা দেখেছি যে, বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন অর্থোডক্স বাইবেলে কমবেশি সাতাশিটা পুস্তক বিদ্যমান, যেগুলোর একুশটাকে প্রটেস্ট্যানটরা জাল গণ্য করেন এবং চৌদ্দটাকে ক্যাথলিকরা জাল মনে করেন। অথচ এগুলোর অনেক পুস্তক বাইবেলের ‘প্রাচীনতম’ পাণ্ডুলিপির মধ্যে বিদ্যমান। এ ছাড়াও শুধু নতুন নিয়মের দেড় শতাধিক পুস্তকের নাম আমরা দেখেছি যেগুলো যীশু, মেরি, প্রেরিতগণ, শিষ্য বা প্রসিদ্ধ ধর্মগুরুদের লেখা বলে প্রচারিত ছিল এবং  প্রথম শতাব্দীগুলোর খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে সকল খ্রিষ্টান সম্প্রদায় একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট, সন্দেহজনক বা জাল (Pseudepigrapha/ Apocrypha)।

সুপ্রিয় পাঠক সহজেই বুঝতে পারছেন, এমতাবস্থায় কোনো একটা গ্রন্থকে কোনো একজন নবী বা শিষ্যের নামে প্রচার করলেই গ্রন্থটাকে সে নবী বা শিষ্যের লেখা বা সংকলিত গ্রন্থ বলে মেনে নেওয়া যৌক্তিক নয়।