১. ৭. ৪. দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে নতুন নিয়ম গঠনে মতভেদ

খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা অনেক সময় ইঞ্জিলগুলোর বিশুদ্ধতার প্রমাণ হিসেবে বলেন যে, ১০৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত রোমের বিশপ ক্লিমেন্ট (Clement) ও ১০৭ বা ১১০ খ্রিষ্টাব্দে নিহত এন্টিয়কের দ্বিতীয় বিশপ ইগনাটিয়াস (Ignatius)-এর চিঠিপত্রের মধ্যে দু-একটা বাক্য রয়েছে, যে বাক্যগুলো এ সকল ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ সকল সুসমাচার তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল! প্রমাণটা সত্যই অদ্ভুত! ক্লিমেন্ট বা ইগনাটিয়াস কোনোভাবে এ সকল সুসমাচারের নাম উল্লেখ করেননি, এগুলো থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলেও জানাননি, তারা কোনো লিখিত সূত্রের উপর নির্ভর করেছেন, না মৌখিক শ্রুতি থেকে লেখেছেন তাও বলেননি। কাজেই তাদের এরূপ উদ্ধৃতি তাদের সময়ে কোনো ইঞ্জিল বা গসপেলের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ নয়।

দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে এশিয়া মাইনরের বিশপ সিনোপের মারসিওন (Marcion of Sinope: 165) সর্বপ্রথম খ্রিষ্টধর্মের জন্য একটা ধর্মগ্রন্থ নির্ধারণ করেন। তিনি লূকের নামে প্রচারিত ইঞ্জিল ও সাধু পলের ১০টা পত্র একত্রে সংকলন করেন। তাঁর কর্মই মূলত খ্রিষ্টান পণ্ডিতদেরকে একটা নতুন নিয়ম তৈরির সংগ্রামে লিপ্ত করে। নতুন নিয়মের উৎস (Origin of the New Testament) গ্রন্থে এডলফ ভন হারনাক (Adolf von Harnack) উল্লেখ করেছেন যে, মারসিওন দেখেন যে, তার সময়ের চার্চ ছিল মূলতই ‘পুরাতন নিয়মের চার্চ’। তখন চার্চের কোনো বিধিবদ্ধ ‘নতুন নিয়ম’ ছিল না। আর মারসিওনের এ কর্মের চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করতেই খ্রিষ্টীয় চার্চ ক্রমান্বয়ে ‘নতুন নিয়ম’ তৈরি করে।[1]

খ্রিষ্টান চার্চ মারসিওনকে ধর্মদ্রোহী বলে বহিষ্কার করে। মারসিওনের কর্ম খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদেরকে একটা নতুন নিয়ম ও তার বিশুদ্ধ গ্রন্থাবলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করে। দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ প্রান্তে সাধু আরিয়ানুস (মৃত্যু ২০২ খ্রি.) সর্বপ্রথম চার ইঞ্জিলের কথা উল্লেখ করেন এবং এগুলোকেই একমাত্র বিশুদ্ধ ইঞ্জিল বলে গণ্য করার দাবি করেন। এছাড়া নতুন নিয়মের অন্যান্য গ্রন্থের বিষয়েও তিনি মত প্রকাশ করেন।

নতুন নিয়ম গঠনের পরবর্তী আরেকটা প্রচেষ্টার সন্ধান পাওয়া যায় মুরাটোরিয়ান ক্যানন (Muratorian Canon) বা মুরাটোয়িান বিশুদ্ধ বাইবেল নামক পাণ্ডুলিপিতে। খ্রিষ্টান গবেষকরা তালিকাটার  প্রণয়নকাল বিষয়ে মতভেদ করেছেন। তারা ধারণা করেন তালিকাটা ২০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত। এতে নতুন নিয়মের ৫টা পুস্তক বাদ দেওয়া হয়েছে: (১) ইব্রী্য় (Hebrews), (২) যাকোবের পত্র (James), (৩) পিতরের ১ম পত্র (1 Peter), (৪) পিতরের ২য় পত্র (2 Peter), (৫) যোহনের  ৩য় পত্র। অপরদিকে এ তালিকায় প্রচলিত নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোর বাইরে পিতরের নিকট প্রকাশিত বাক্য (Apocalypse of Peter) নামক পুস্তক সংযোজিত।[2]

পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত নতুন নিয়মের গ্রন্থাবলি বিষয়ে মতভেদ চলতে থাকে। আমরা দেখেছি যে, বর্তমানে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের নতুন নিয়মের পুস্তক সংখ্যা ২৭ হলেও বর্তমানে প্রচলিত সিরীয় নতুন নিয়মে ২২ পুস্তকের উপর নির্ভর করা হয় এবং বর্তমানে প্রচলিত ইথিওপীয় নতুন নিয়মে ৩৫টা পুস্তক বিদ্যমান।

বর্তমানে বিদ্যমান বিভিন্ন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বাইবেলের পুরাতন নিয়মের পুস্তক সংখ্যা ৩৯ থেকে ৫৩: ১৪টা পুস্তকের পার্থক্য। আর নতুন নিয়মের পুস্তক সংখ্য ২২ থেকে ৩৫: ১৩টা পুস্তকের পার্থক্য। মোট ২৭টা পুস্তকের হেরফের।

আর এ ২৭টা পুস্তক ও অন্যান্য পুস্তক বিষয়ে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের মতভেদ অনেক। পাঠক এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার biblical literature প্রবন্ধের The history of canonization পরিচ্ছেদ, উইকিপিডিয়ায়: Development of the New Testament canon, Development of the Hebrew Bible canon, Development of the Old Testament canon ইত্যাদি আর্টিকেল অধ্যয়ন করলে জানতে পারবেন যে, বিগত প্রায় দু হাজার বছর ধরে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা কয়েক ডজন যাজকীয় সম্মেলন করেছেন বাইবেলের পুস্তকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। কিন্তু বারবারই তারা পূর্ববর্তী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত পরের সম্মেলনে পরিবর্তন করেছেন।

[1] উইকিপিডিয়া: Development of the New Testament canon, Marcion of Sinope
[2] উইকিপিডিয়া: Muratorian Canon