উপরের ২৭টা গ্রন্থের মধ্যে প্রথম চারটা গ্রন্থকে ‘ইঞ্জিল চতুষ্টয়’ বলা হয়। ইঞ্জিল শব্দটা মূলত গ্রিক ভাষা থেকে আরবিকৃত শব্দ। এনকার্টা ইংলিশ ডিকশনারি (Encarta English Dictionary) অনুসারে গ্রিক ‘eu’ অর্থ ভাল (good) এবং ‘aggelein’ অর্থ ঘোষণা (announce), একত্রে ‘euaggelos’ অর্থ সুসংবাদ ঘোষণা (bringing good news)।  গ্রিক ‘euaggelion’ শব্দের অর্থ সুসংবাদ (good news)। এ শব্দটা থেকে আরবি ‘ইঞ্জিল’ শব্দ এবং ইংরেজি ‘ইভাঞ্জেল’ (evangel) শব্দের উৎপত্তি।

ইঞ্জিল বা ইভাঞ্জেল বলতে প্রথম চারটা পুস্তককেই শুধু বোঝানো হয়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের বাইবেল সোসাইটি পুরো নতুন নিয়মকেই ‘ইঞ্জিল’ নামে প্রচার করে। তারা চার ইঞ্জিলের পরের পুস্তকগুলোকেও ইঞ্জিলের অমুক বা তমুক খণ্ড বলে উল্লেখ করছেন। বিষয়টা অনুবাদের ক্ষেত্রে বিকৃতি (Distortion) বলেই প্রতীয়মান। ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ অবশ্যই আক্ষরিক ও মূলাশ্রয়ী হতে হবে। কিন্তু বাইবেলের অনুবাদকরা দু’ভাবে মৌলিকতা নষ্ট করেছেন:

(ক) প্রথম চারটা পুস্তকের ক্ষেত্রে মূল গ্রিক ও ইংরেজি নাম ‘সাধু মথির, মার্কের, লূকের বা যোহনের মতানুসারে ঈসা মাসীহের পবিত্র ইঞ্জিল’ কথাটার অনুবাদে তারা লেখছেন: ‘ইঞ্জিল শরিফ, প্রথম খণ্ড: মথি’।

(খ) চারটা ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-এর পরের ২৩টা পুস্তক বা পত্রকেও তারা ইঞ্জিল বা ইঞ্জিলের বিভিন্ন খণ্ড বা ‘সিপারা’ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।

তারা দাবি করছেন যে, গ্রন্থগুলো মূল গ্রিক থেকে অনূদিত। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত যে, মূল গ্রিকে এ দুটো বিষয়ের একটাও নেই। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

প্রথমত: আমরা দেখলাম যে, নতুন নিয়মের প্রথম চারটা পুস্তককে খ্রিষ্টানরা ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেছেন। এছাড়া বাকি ২৩টা পুস্তককে বিগত ২ হাজার বছরে কোনো খ্রিষ্টান ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেননি।

দ্বিতীয়ত: আমরা দেখেছি যে, বাইবেলের বাংলা অনুবাদকে তারা ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ নামকরণ করেছেন। খ্রিষ্টানরা বাইবেলের আরবি অনুবাদকে মূলত এ নামে আখ্যায়িত করেন। তারা বলতে পারেন যে, আমরা বাংলা অনুবাদের জন্য আরবি নাম ব্যবহার করেছি। এক্ষেত্রেও তারা সঙ্গতি নষ্ট করেছেন। বাইবেলের নতুন নিয়মকে কখনোই আরবিতে ‘ইঞ্জিল’ বলা হয় না। আরবিতে প্রথম চারটা পুস্তককেই শুধু ‘ইঞ্জিল’ বলা হয়। আর ২৭ পুস্তকের সমষ্টিকে একত্রে العهد الجديد বলা হয়, যার অর্থ ‘নতুন নিয়ম’ বা ‘নব সন্ধি’।

তৃতীয়ত: যে কোনো জাগতিক ‘ডকুমেন্ট’ অনুবাদের ক্ষেত্রে এরূপ করলে তা ‘ক্রিমিন্যাল’ বা ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। পাঠক একটু চিন্তা করুন:

(১) আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটা প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ড্রীমস ফ্রম মাই ফাদার’ (Dreams from My Father)। যদি কেউ এ শিরোনামে বই ছেপে তার মধ্যে  আমেরিকা সরকারের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা মন্ত্রীর লেখা কিছু বই সংযোজন করে প্রকাশ করেন বা ড্রীমস বইটার প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড ইত্যাদি নামে প্রকাশ বা প্রচার করেন এবং মানুষ এ সকল সংযোজিত পুস্তকের বক্তব্য বারাক ওবামার বক্তব্য হিসেবে গণ্য করে তবে বারাক ওবামা ও আমেরিকার প্রশাসন বিষয়টাকে কিভাবে দেখবেন? পাঠক এরূপ কর্মকে কতটুকু সঠিক ও বিশ্বস্ত বলে গ্রহণ করবেন?

(২) ‘বাংলাদেশের সংবিধান’ শিরোনাম দিয়ে একটা বই ছেপে এর মধ্যে যদি সুপ্রিম কোর্টের কিছু রায়, সরকারি কিছু গেজেট, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর লেখা কিছু পুস্তক সংযোজন করে বাংলাদেশ সংবিধান দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড ইত্যাদি নামে সংবিধানের সাথেই প্রকাশ ও প্রচার করা হয় এবং মানুষ এ সকল সংযোজিত পুস্তকের বক্তব্য ‘বাংলাদেশের সংবিধান’-এর বক্তব্য হিসেবে উদ্ধৃতি দিতে থাকে তখন বাংলাদেশ সরকার বিষয়টাকে কিভাবে নেবেন?

সকল ডকুমেন্টের ক্ষেত্রেই বিষয়টা সুস্পষ্ট। যে সকল পণ্ডিত বাইবেল অনুবাদ করেছেন তাদের লেখা কোনো গ্রন্থ বা তাদের সম্পত্তির কোনো দলিলের মধ্যে এরূপ কিছু করা হলে তারা তাকে প্রতারণা বলে গণ্য করবেন এবং আদালতের আশ্রয়  নেবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধর্মগ্রন্থের অনুবাদের ক্ষেত্রে তারা মূলকে সংরক্ষণ করছেন না।

পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে যে, মিথ্যা ঈশ্বরের নিকট ঘৃণিত ও বিশ্বস্ততা মুক্তির পথ (লেবীয় ১৯/১১; হিতোপদেশ ১২/২২), অনন্ত নরকই মিথ্যাবাদীদের ঠিকানা (প্রকাশিত বাক্য ২১/৮)। বাইবেলেই ধর্মগ্রন্থের মধ্যে সামান্যতম সংযোজন বা বিয়োজন করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং কেউ এরূপ করলে সে পরকালের মুক্তি থেকে বঞ্চিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে (প্রকাশিত বাক্য ২২/১৮-১৯)। নতুন নিয়মকে ইঞ্জিল বলা কি মিথ্যা ও অবিশ্বস্ততা নয়? প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড ইত্যাদি সংযোজন করা কি ধর্মগ্রন্থের মধ্যে সংযোজন  নয়? তাহলে ধার্মিক মানুষ কিভাবে এরূপ করেন?