আমরা সকলেই জানি যে, প্রত্যেক ধর্মের অনেক দল-উপদল আছে। কিন্তু একই ধর্মের দল-উপদলের জন্য ভিন্নভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থাকে বলে হয়ত আমাদের কোনো পাঠকই জানেন না। হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে অনেক দল-উপদল বিদ্যমান। কিন্তু কুরআন, বেদ, ত্রিপিটক ইত্যাদির ভিন্নভিন্ন সংস্করণ বা ভিন্নভিন্ন বই আছে বলে আমরা জানি না। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মের বিষয়টা ভিন্ন। খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন চার্চ বা ধর্মীয় জামাতের জন্য ভিন্নভিন্ন ‘বাইবেল’ বিদ্যমান। এ সকল বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান পুস্তকের সংখ্যার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যে সকল পুস্তক সকল বাইবেলে বিদ্যমান সেগুলোর বিষয়বস্ত্ত, অধ্যায়, অনুচ্ছেদ, শ্লোক ইত্যাদির মধ্যেও অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। বাইবেলের পার্থক্য জানার জন্য খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বের খ্রিষ্টানরা মূলত তিনটা বৃহৎ দলে বিভক্ত: ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট ও অর্থোডক্স। এ তিনটা বৃহৎ সম্প্রদায়ের বিভক্তির মূল কারণ পোপের আধিপত্য।
(১) ক্যাথলিক বা সর্বজনীন: খ্রিষ্টধর্মের মূল ধারা ক্যাথলিক (Catholic) অর্থাৎ সর্বজনীন বা রোমান ক্যাথলিক (Roman Catholic) হিসেবে পরিচিত। রোমের বা ভ্যাটিকানের চার্চ ও পোপের নিয়ন্ত্রনাধীন খ্রিষ্টধর্ম এ নামে পরিচিত।
শুরু থেকেই খ্রিষ্টান প্রচারকরা বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধান পুরোহিত ও ধর্মযাজককে ‘বিশপ’ (Bishop/greek: episkopos) অর্থাৎ সর্দার বা তত্ত্বাবধায়ক (overseer) অথবা প্রেসবিটার (presbyter) অর্থাৎ মুরবিব (elder) বলে আখ্যায়িত করতেন। বিশপকে সাধারণত ‘বাবা’ বা পিতা বলে ডাকা হত। এই শব্দটার গ্রিক পাপ্পাস (pappas), ল্যাটিন পাপা (papa) এবং ইংরেজি পোপ (Pope)। ক্রমান্বয়ে রোমের বিশপ, অর্থাৎ ভ্যাটিকানে অবস্থিত সেন্ট পিটার চার্চের প্রধান পুরোহিত নিজেকে পুরো খ্রিষ্টধর্মের প্রধান বা প্রধান বিশপ বলে দাবি করতে থাকেন। একমাত্র তিনিই বাবা বা পোপ হিসেবে আখ্যায়িত হতে থাকেন। মূলত একাদশ খ্রিষ্টীয় শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিষ্টধর্ম পুরোপুরিই ভ্যাটিকানের পোপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্থাৎ খ্রিষ্টধর্মের প্রথম হাজার বছর খ্রিষ্টধর্ম বলতে ক্যাথলিক ধর্মকেই বুঝানো হত।[1]
(২) অর্থোডক্স বা গোঁড়া: ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইন (Constantine the Great) খ্রিষ্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। রোমান সাম্রাজ্য পশ্চিমে ইউরোপ থেকে পূর্বে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া ও ফিলিস্তিন পর্যন্ত বিসত্মৃত ছিল। ক্রমান্বয়ে রোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে যায়। গ্রিকভাষী পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বিশপরা রোমের বিশপের একছত্র আধিপত্য মানতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাদের বিশ্বাসে প্রত্যেক বিশপই স্বাধীন ‘পাপা’, বাবা বা পোপ এবং সকল বিশপ সম মর্যাদার অধিকারী। ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয়েও মতানৈক্য দেখা দেয়। বিশেষ করে যীশু খ্রিষ্টের প্রকৃতি নিয়ে। খ্রিষ্টধর্মের মূল কালিমা ‘নাইসীন ক্রীড’ বা নিসিয়ার আকীদার মধ্যে পশ্চিমের খ্রিষ্টানরা সংযোজন করেন যে, ‘পবিত্র আত্মা পিতা ও পুত্র উভয় থেকে আগত’। পূর্বের খ্রিষ্টানরা এ সংযোজন বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেন। বিবাদের এক পর্যায়ে ১০৫৪ সালে পূর্বের খ্রিষ্টানরা পশ্চিমের বা ভ্যাটিকানের পোপের প্রভাবাধীন খ্রিষ্টানদের থেকে বিভক্ত হয়ে যান। তারা অর্থোডক্স (Orthodox) অর্থাৎ গোঁড়া, মৌলবাদী বা মূলধারার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে এ বিভক্তি বড় বিভক্তি (Great Schism) নামে পরিচিত।[2]
(৩) প্রটেস্ট্যান্ট বা প্রতিবাদী: খ্রিষ্টধর্মের মূল ধারা পোপের নিয়ন্ত্রণেই চলতে থাকে। ১৬শ খ্রিষ্টীয় শতকে পোপের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কোনো কোনো ধর্মগুরু বিদ্রোহ করেন। এদের অন্যতম ছিলেন প্রসিদ্ধ জার্মান ধর্মগুরু মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬ খ্রি.)। তিনি এবং সমসাময়িক কিছু ধর্মগুরু ধর্মের মধ্যে পোপের নেতৃত্ব ও অধিকার সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে যে নতুন ধর্মীয় ফিরকা বা ধারার সৃষ্টি হয় সেটা প্রটেস্ট্যান্ট (Protestant) বা প্রতিবাদী বলে পরিচিত।[3]
(৪) মূল এ তিন সম্প্রদায়ের তিন প্রকার বাইবেল ছাড়াও আরো অনেক সম্প্রদায়ের পৃথক বাইবেল বিদ্যমান। বিশেষত খ্রিষ্টধর্মের সুতিকাগার ও খ্রিষ্টীয় প্রথম দুই শতাব্দীতে যে সকল অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্ম প্রসার লাভ করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিন ও বৃহত্তর সিরিয়া, আরমেনিয়া, মিসর ও ইথিওপিয়া। এ সকল এলাকার খ্রিষ্টানরা প্রাচীন যুগ থেকে নিজস্ব ‘বাইবেল’ অনুসরণ করেন। তাদের বাইবেলের সাথে প্রচলিত ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের অনেক পার্থক্য বিদ্যমান।
[2] Microsoft Encarta: Orthodox church, bishop, pope, papacy, schism.
[3] Microsoft Encarta, articles: protestant, protestantism, Martin Luther