মু’তাযিলা (المعتزلة) শব্দটি ‘ই’তাযালা’ (اعتزل) ফি’ল থেকে গৃহীত। ই’তিযাল (الاعتزال) অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, নিঃসঙ্গ হওয়া, একাকী হওয়া ইত্যাদি। প্রথম হিজরীর শেষভাগে এবং দ্বিতীয় হিজরীর প্রথমভাগে বিশ্বাসের বিষয়ে দার্শনিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে মু’তাযিলা মতবাদের সৃষ্টি হয়।
এদেরকে মু’তাযিলা বলা হলো কেন সে বিষয়ে একাধিক মত রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ মত এই যে, প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হাসান বাসরীর (১১০ হি) একজন ছাত্র ছিলেন ওয়াসিল ইবনু আতা (৮০-১৩১ হি)। তৎকালীন একটি বিশেষ বিতর্কিত বিষয় ছিল পাপী মুসলিমের বিষয়। আমরা দেখেছি খারিজীগণ পাপী মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করত এবং আখিরাতে সে অনন্ত জাহান্নামী বলে বিশ্বাস করত। মুরজিয়্যাহ সম্প্রদায় তাকে পরিপূর্ণ মুমিন এবং অনন্ত জান্নাতী বলে বিশ্বাস করত। সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী মূল ধারার তাবিয়ীগণ এরূপ মুসলিমকে পাপী মুমিন ও আখিরাতে শাস্তিভোগের পর নাজাত লাভ করবে বলে বিশ্বাস করতেন। ওয়াসিল ইবনু আতা দাবি করেন যে, এরূপ ব্যক্তিকে মুমিনও বলা যাবে না এবং কাফিরও বলা যাবে না। বরং সে ঈমান ও কুফরীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান রত। এ অবস্থায় মৃুত্যবরণ করলে সে অনন্ত জাহান্নামী হবে, কারণ সে ঈমানহীনভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। হাসান বসরী (রাহ) তার এ মত প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাকে তার মাজলিসে আসতে নিষেধ করেন। ওয়াসিল হাসান বসরীর মাজলিস ত্যাগ করে বসরার মসজিদের অন্য কোণে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসতে শুরু করে। এজন্য তাকে এবং তার অনুসারীদেরকে ‘মু’তাযিলা’ বলা হয়।
সর্বাবস্থায় দ্বিতীয় হিজরী শতকে এ মতটি বিশেষ প্রসিদ্ধি ও প্রসার লাভ করে। এ মতের অনুসারীগণ গ্রীক, মিসরীয়, পারসীয় ও ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে লেখাপড়া করার ফলে ধর্মীয় অনেক বিষয়ে দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষদের আকর্ষিত করেন। কয়েকজন আববাসী খলীফা, বিশেষত খলীফ মামুন (খিলাফাত: ১৯৮-২১৮ হি/৮১৪-৮৩৩খৃ) ও খলীফা মু’তাসিম (২১৮-২২৭ হি/৮৩৩-৮৪২খৃ) তাদের যুক্তি, তর্ক, দর্শনশাস্ত্রে পান্ডিত্য ইত্যাদিতে মুগ্ধ হয়ে তাদের মত গ্রহণ করেন এবং এ মতটিকেই রাষ্ট্রীয় ধর্মমত হিসেবে গ্রহণ করে সকল আলিমকে এমত গ্রহণে বাধ্য করতে শুর করেন। তবে মূলধারার আলিমগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ক্রমান্বয়ে এ মতের অনুসারী কমতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তা বিলুপ্ত হয়ে যা।
আহলূস সুন্নাতের সাথে মুতাযিলী সম্প্রদায়ের মৌলিক নীতিগত পার্থক্য ছিল বিশ্বাসের বিষয়ে মানবীয় আকল বা বুদ্ধি-বিবেক (sense, reason, rationality, intellect, intelligence) ও ওহী (Scripture)-এর পারস্পরিক সম্পর্ক ও অবস্থান। মু’তাযিলী আকীদার মূল বিষয় ছিল মানবীয় আকল বা বুদ্ধি-বিবেককে ওহীর বিচারক হিসেবে গ্রহণ করা। তাদের মতে আকল ওহীর চেয়ে অগ্রগণ্য। আকল বা মানবীয় বুদ্ধির বিচারে ওহীর মধ্যে অসঙ্গতি দেখা গেলে বুদ্ধি ও দর্শনের মাধ্যমে ওহীর ব্যাখ্যা ও বিচার করতে হবে। কুরআনের বক্তব্যকে তারা ‘রূপক’, অস্পষ্ট ইত্যাদি যুক্তিতে বাতিল করত এবং হাদীসের বক্তব্যকে তারা ‘খাবারে ওয়াহিদ’ বা মুতাওয়াতির নয়, কাজেই অর্থগত বর্ণনার সম্ভাবনা আছে যুক্তিতে বাতিল করত। এ বিষয়ে সাহাবীগণের অনুসরণে মূলধারার তাবিয়ী ও পরবর্তী আলিমগণ বা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণের আকীদার মূলনীতি আমরা ইতোপূর্বে একাধিক স্থানে ব্যাখ্যা করেছি।
মু’তাযিলাগণ তাদের মূলনীতির ভিত্তিতে অনেক আকীদার উদ্ভাবন করেন। ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, কাদারিয়্যাহ ও জাহমিয়্যাহ ফিরকাদ্বয়ের মূলনীতি সমূহ সবই মু’তাযিলাগণ গ্রহণ করে। তারা নিজদেরকে আহলুল আদলি ওয়াত তাওহীদ (أهل العدل والتوحيد) অর্থাৎ ন্যায়বিচার ও একত্বের অনুসারী বলতেন। তাদের দাবি মত তাদের মূলনীতি পাঁচটি (১) আদল (العدل) বা ন্যায়বিচার, (২) তাওহীদ (التوحيد) বা একত্ব, (৩) ইনফাযুল ওঈদ (إنفاذ الوعيد) বা শাস্তির অঙ্গিকার বাস্তবায়ন, (৪) আল-মানযিলাতু বাইনাল মানযিলাতাইনি (المنزلة بين المنزلتين) বা দুই অবস্থানের মধ্যবর্তী অবস্থান এবং (৫) আল-আমরু বিল মারুফ ওয়ান নাহউ আনিল মুনকার (الأَمْرَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيَ عَنِ الْمُنْكَرِ) বা সৎকর্মে আদেশ ও অসৎকর্ম থেকে নিষেধ।[2]
এগুলির ভিত্তিতে তাদের উদ্ভাবিত আকীদার মধ্যে রয়েছে:
(১) আল্লাহর বিশেষণসমূহ অস্বীকার করা। তাদের মতে, মহান আল্লাহর জ্ঞান, জীবন, ক্ষমতা, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি অনাদি বিশেষণ আছে বলে বিশ্বাস করলে অনাদি সত্তার সংখ্যা অনেক হয়ে যায়। এতে আল্লাহর একত্ব নষ্ট হয়। একারণে তারা নিজেদেরকে একত্ববাদী বলে দাবি করত। এ ছাড়া সৃষ্টির সাথে তুলনা হবে এ যুক্তিতে তারা কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত মহান আল্লাহর বিশেষণ ও কর্মগুলি অস্বীকার করত এবং সেগুলির বিভিন্ন ব্যাখ্যা করত।
(২) মহান আল্লাহকে আখিরাতে দেখা যাবে না।
(৩) আল্লাহর কথা তাঁর অনাদি বিশেষণ নয় বরং তা তাঁর সৃষ্ট বস্ত্ত মাত্র।
(৪) তাকদীর বলে কোনো কিছু নেই। মহান আল্লাহ মানুষের কর্মের স্রষ্টা নন, মানুষই মানুষের কর্মের স্রষ্টা। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে বা আল্লাহর অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ অন্যায় কর্ম করে। তাকদীরের অস্বীকারকেই তারা ‘ন্যায়বিচারের বিশ্বাস’ বলে আখ্যায়িত করত।
(৫) পাপী মুসলিম কাফিরও নয় মুমিনও নয়। আখিরাতে সে অনন্ত জাহান্নামী। এ বিশ্বাসকে তারা ‘শাস্তির অঙ্গিকার বাস্তবায়ন’ বলে আখ্যায়িত করত। কারণ আল্লাহ পাপীদের শাস্তির অঙ্গিকার করেছেন। এরপর যদি তিনি ক্ষমা করেন তবে তা ন্যায়বিচার ও অঙ্গিকার বাস্তবায়নের পরিপন্থী হয়। আল্লাহর ন্যায়বিচারের যুক্তিতে তারা ‘শাফা‘আত’ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের সকল নির্দেশনা অস্বীকার করত।
(৬) অন্যদেরকে সৎকাজে আদেশ করা ও অন্যায় থেকে নিষেধ করা জরুরী ও ফারয আইন। রাষ্ট্রও অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। এমতের ভিত্তিতে তারা নিজেদের এ সকল আকীদা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালান।
মু’তাযিলাগণের মধ্যে অনেক উপদলের উদ্ভব ঘটে। প্রত্যেক দলেরই নিজস্ব আকীদা ও মতামত রয়েছে।
[2] ইবনু আলি ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫২০-৫২৮।