শীয়া সম্প্রদায় অনেক উপদলে বিভক্ত হয়ে যান। বর্তমানে বিদ্যমান শীয়াগণের মধ্যে সবচেয়ে বড় দল দ্বাদশ ইমামপন্থী বা ইমামী শীয়াগণ। ইরান, ভারত, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের অধিকাংশ শীয়া এ দলের। এদের আকীদাগুলি সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
(১) ইমামতের বিশ্বাস। তাদের মতে আলী (রাঃ) ও তাঁর বংশের বার জনের ইমামতে বিশ্বাস ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের মতে ইমামত নস্স বা সুস্পষ্ট নির্দেশের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে হবে, এখানে ইজতিহাদ, শূরা বা পরামর্শের কোনো সুযোগ নেই। পূর্ববর্তী ইমাম যাকে ইমাম হিসেবে নির্ধারণ করবেন তিনিই ইমাম। তাদের বিশ্বাস অনুসারে ১২ ইমাম:
(১) আলী (২৩-৪০ হি),
(২) হাসান ইবনু আলী (৩-৫০ হি),
(৩) হুসাইন ইবনু আলী (৪-৬১ হি),
(৪) যাইনুল আবেদীন আলী ইবনু হুসাইন (৩৮-৯৫হি),
(৫) মুহাম্মাদ আল-বাকির ইবনু যাইনুল আবিদীন (৫৭-১১৪ হি),
(৬) জা’ফর আস-সাদিক ইবনু মুহাম্মাদ বাকির (৮৩-১৪৮ হি)
(৭) মুসা কাযিম ইবনু জাফর সাদিক (১২৮-১৮৩ হি)
(৮) আলী রিযা ইবনু মূসা কাযিম (১৪৮-২০৩হি)
(৯) মুহাম্মাদ জাওয়াদ ইবনু আলী রিযা (১৯৫-২২০ হি)
(১০) আলী হাদী ইবনু মুাহম্মাদ জাওয়াদ (২১২-২৫৪ হি)
(১১) হাসান আসকারী ইবনু আলী হাদী (২৩২-২৬০)
(১২) মুহাম্মাদ মাহদী ইবনু হাসান আসকারী (২৫৬-???)
(২) ইসমাতের বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করেন যে, দ্বাদশ ইমাম সকল পাপ ও ভুল-ভ্রান্তি থেকে নিষ্পাপ ও সংরক্ষিত।
(৩) ইলম-এর বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করেন যে, ইমামগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর থেকে ‘ছিনায় ছিনায়’ ইমাম-পরম্পরায় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম, ইলম লাদুন্নী ও বিশেষ সম্পর্কের মাধ্যমে অলৌকিক ও গাইবী জ্ঞান প্রাপ্ত।
(৪) ইমামগণের মুজিযায় বিশ্বাস। তার বিশ্বাস করেন যে, ইমামগণ অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত। তারা অলৌকিক কর্ম করতে পারেন এবং করেন। এগুলিকে তারা মুজিযা বলে।
(৫) গাইবাহ (الغيبة) বা অদৃশ্য হওয়ায় বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করেন যে, তাদের দ্বাদশ ইমাম অদৃশ্য হয়ে আছেন। তিনি অদৃশ্য থেকেই বিশ্ব পরিচালনা করছেন।
(৬) রাজ‘আত (الرجعة) বা প্রত্যাবর্তনে বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করেন যে, দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মাদ মাহদী শেষ যামানায় ইমাম মাহদীরূপে ফিরে আসবেন।
ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, শীয়াগণের ১১শ ইমাম হাসান আসকারী ২৬০ হিজরীতে নিঃসন্তান ভাবে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইনতেকালের পরে তাঁর এক দাসী দাবী করেন যে, তিনি তাঁর সন্তান ধারণ করেছেন। হাসানের ভাই জা’ফর এ নিয়ে তৎকালীন সরকারের কাছে কেস করেন এবং প্রমাণিত করেন যে, তাঁর ভাইয়ের কোন সন্তান নেই। কেসে জয়লাভ করে তিনি ভাইয়ের সম্পতির অধিকার লাভ করেন।[1]
কিন্তু শীয়াগণের মধ্য থেকে কিছু মানুষ দাবী করেন যে, হাসান আসকারীর একটি ছেলে ছিল যাকে তিনি গোপন রেখেছিলেন। তার নাম ছিল মুহাম্মাদ। তিনি ২৫৬ হিজরীতে, পিতার মৃত্যুর ৪ বৎসর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বয়সে তিনি তার বাড়ীর নীচের ছোট কুঠুরীতে (cellar/ basement) প্রবেশ করেন। তাঁর আম্মা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তিনি আর বের হন নি।
কত বৎসর বয়সে এই ঘটনা ঘটে তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বলেন ৯ বৎসর বয়সে ২৬৫ হিজরীতে। কেউ বলেন: ১৭ বৎসর বয়সে। কেউ বলেন ২৭৫ হিজরীতে ১৯ বৎসর বয়সে।
সর্বাবস্থায় শীয়াগণ গত প্রায় ১২০০ বৎসর যাবৎ বিশ্বাস করে আসছেন যে, এই মুহাম্মাদই হলেন যামানার ইমাম। তিনিই মাহদী। তিনি গোপনে আছেন। গোপনে থেকেই জগত পরিচালনা করছেন। তিনি অচিরেই মাহদী রূপে আত্মপ্রকাশ করে সারা বিশ্বে শান্তি ও ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। গত অনেক শতাব্দী পর্যন্ত তাদের অভ্যাস ছিল যে, তারা প্রতিদিন দলধরে বাগদাদের একটি কাল্পনিক ঘরের কাছে যেয়ে তাকে ডাকতেন এবং বেরিয়ে এসে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করতেন।[2]
(৭) তাকিয়্যাহ (التقية)-র বিশ্বাস। অর্থাৎ আত্মরক্ষার জন্য মিথ্যা বলার আবশ্যকতায় বিশ্বাস। তাকিয়্যাহকে তারা দীনের দশভাগের নয়ভাগ বলে মনে করেন। তাকিয়্যাহ পরিত্যাগ করা সালাত পরিত্যাগ করার মতই কঠিনতম পাপ। যে তাকিয়্যাহর নামে মিথ্যা না বলে সত্য বলে সে তাকিয়্যাহ ত্যাগ করার কারণে কঠিন পাপে পাপী বলে বিবেচিত।
(৮) কুরআনের বিকৃতিতে বিশ্বাস। অধিকাংশ ইমামী শীয়া বিশ্বাস করেন যে, প্রচলিত কুরআন বিকৃত। অবিকৃত মূল কুরআন আলীর নিকট ছিল, যা তিনি গোপন করে রাখেন। তার বংশের ইমামদের নিকট তা গোপন রয়েছে।
(৯) সাহাবীগণের বিচ্যুতির বিশ্বাস। বার-ইমামপন্থী ইমামী শীয়াগণ অন্যান্য অধিকাংশ শীয়া ফিরকার ন্যায় বিশ্বাস করেন যে, তিন খলীফা সহ সকল সাহাবী মুনাফিক, মুরতাদ ও জালিম ছিলেন।
(১০) বারা‘আতের (البراءة) বা সম্পর্কছিন্নতা ঘোষণার বিশ্বাস। তারা সাহাবীদেরকে ঘৃণা করা, নিন্দা করা ও তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার ঘোষণা দেওয়াকে ঈমানের অংশ বলে বিশ্বাস করে।
(১১) সুন্নাত ও হাদীস অস্বীকার। ইমামী শীয়াগণ সাহাবীগণের মাধ্যমে বর্ণিত হাদীস অস্বীকার করেন। বরং তারা সাহাবীগণকে জালিয়াত বলে গণ্য করেন (নাঊযু বিল্লাহ!)।
(১২) ইসলামী রাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্বাস। ইমামী শিয়াগণ অন্য শীয়াদের মতই একমাত্র আলী (রাঃ)-এর খিলাফত ও পরবর্তী যুগে শীয়াগণের রাজত্ব ছাড়া খিলাফতে রাশিদা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল ইসলমী সরকারকে অনৈসলামিক ও তাগূতি রাষ্ট্র বলে বিশ্বাস করেন।
[2] ইবনুল কাইয়েম, আল-মানারুল মুনীফ, পৃ: ১৫২।