উপরের বিষয়গুলি পর্যালোচনা করলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, আকীদার উৎস নির্ধারণে মতভেদই সকল মতভেদের উৎস। বিদ‘আতী ফিরকাগুলি কুরআন ও হাদীসকে সরাসরি অস্বীকার করে নি। তারা কুরআন-সুন্নাহ আকীদার উৎস বলে স্বীকার করে। তবে আমরা দেখেছি যে, অতিরিক্ত উৎসগুলিই তাদের মুল ভিত্তি। কেউ আকল, যুক্তি বা দর্শনের নামে এবং কেউ নবী-বংশের ইমামগণ, ওলীগণ বা তাদের প্রতিনিধিগনের কাশফ, ইলকা, ইলহাম, ইলম লাদুন্নী, মতামত বা ব্যাখ্যার নামে কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন নির্দেশনা নিজেদের মর্জিমত গ্রহণ করেছে বা ব্যাখ্যা করে পরিত্যাগ করেছে।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বোচ্চ ও প্রধান মূলনীতি কুরআন ও সুন্নাতের নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন এবং কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসকে আকীদার একমাত্র মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা। যে কোনো বিষয়ে কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসের সকল নির্দেশনা সমানভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস করা। সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ীগণকে এ বিষয়ে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা। কুর্আন-সুন্নাহ অনুধাবনের বিষয়ে তাদের মতামতের উপর নির্ভর করা। কুরআন বা হাদীসে যে বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, গুঢ়অর্থ নির্ণয় ইত্যাদির অপচেষ্টা না করে প্রকাশ্য, স্পষ্ট ও সরল অর্থে তা বিশ্বাস করা। কুরআন বা হাদীসে যে বিষয় উল্লেখ করা হয় নি সে বিষয় আকীদার অন্তর্ভুক্ত না করা এবং সে বিষয়ে বিতর্কে না জড়ানো। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্যান্য ইমামের কিছু বক্তব্য প্রথম অধ্যায়ে আকীদার উৎস আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। মোল্লা আলী কারী লিখেছেন:
كان أبو حنيفة يكره الجدل على سبيل الحق، حتى روي عن أبي يوسف أنه قال: كنا جلوسا عند أبي حنيفة إذ دخل عليه جماعة في أيديهم رجلان، فقالوا: إن أحد هذين يقول: القرآن مخلوق، وهذا ينازعه ويقول: هو غير مخلوق. قال: لا تصلوا خلفهما. فقلت: أما الأول فنعم، فإنه لا يقول بقدم القرآن. وأما الآخر فما باله لا يصلى خلفه؟ فقال: إنهما يتنازعان في الدين، والمنازعة في الدين بدعة
‘‘আবূ হানীফা (রাহ) সত্যের পথেও বিবাদ-বিতর্ক অপছন্দ করতেন। ইমান আবূ ইউসুফ (রাহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমরা আবূ হানীফার নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এমতাবস্থায় কিছু মানুষ দুব্যক্তিকে নিয়ে তথায় আগমন করে বলেন: এ দুজনের একজন বলছে, কুরআন সৃষ্ট এবং অন্য ব্যক্তি তার সাথে বিতর্ক করছে ও বলছে, কুরআন সৃষ্ট নয়। তিনি বলেন: এদের উভয়ের কারো পিছনে সালাত আদায় করবেন না। আমি বললাম, প্রথম ব্যক্তির পিছনে সালাত আদায় করব না একথা ঠিক, কারণ সে কুরআনের অনাদিত্বে বিশ্বাস করে না। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির পিছনে সালাত আদায় করা হবে না কেন? তিনি বলেন, কারণ তারা দীনের বিষয়ে বিবাদ-বিতর্ক করছে আর দীনের বিষয়ে বিবাদ-বিতর্ক বিদ‘আত।’’[1]
ইমাম তাহাবী বলেন:
ولا نخوض في الله. ولا نماري في دين الله. ولا نجادل في القرآن
‘‘আমরা আল্লাহর বিষয়ে অহেতুক চিন্তা গবে্ষণায় প্রবৃত্ত হইনা। আমরা আল্লাহর দীন নিয়ে বিতর্ক করি না এবং আমরা পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে কোনো বাদানুবাদে জড়িত হইনা।’’[2]
ইমাম তাহাবী বলেন,
وَجَمِيعُ مَا صَحَّ عَنْ رَسُولِ الله (ﷺ) مِنَ الشَّرْعِ وَالْبَيَانِ كله حَقٌّ.
‘‘শরীয়ত ও ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই সত্য।’’[3]
এ কথার ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য হানাফী বলেন: ‘‘প্রত্যেক বিদ‘আতী ফিরকার মূলনীতি এই যে, কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যকে তারা তাদের বিদ‘আতের মানদন্ডে অথবা যাকে তারা ‘আকলী বা বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল’ ও ‘যুক্তি’ বলে কল্পনা করে তার মানদন্ডে বিচার করে। যদি কুরআন-হাদীসের বক্তব্য তাদের বিদ‘আত বা ‘যুক্তি’র সাথে মিলে যায় তবে তারা সে বক্তব্যটিকে ‘মুহকাম’ বা দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট বলে দাবি করে, তা গ্রহণ করে এবং তাকে দলীল হিসেবে পেশ করে। আর কুরআন-হাদীসের যে বক্তব্য তাদের বিদ‘আত বা ‘যুক্তি’-র সাথে না মিলে সে বক্তব্যকে তারা ‘মুতাশাবিহ’ বা দ্ব্যর্থবোধক ও অস্পষ্ট বলে উল্লেখ করে এবং তা প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রত্যাখ্যানকে তারা ‘তাফবীয’ বা অর্থ-বিচার আল্লাহর কাছে ছেড়ে দেওয়া বলে আখ্যায়িত করে। অথবা তারা এরূপ বক্তব্যের অর্থ বিকৃত করে এবং এরূপ বিকৃতিকে তারা ‘ব্যাখ্যা’ বলে আখ্যায়িত করে। এজন্যই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কঠিনভাবে তাদের এসকল কর্মের প্রতিবাদ করেছেন। আহলুস সুন্নাতের রীতি এই যে, কোনোভাবেই তারা সহীহ ‘নাস্স’ অর্থাৎ কুরআন বা সহীহ হাদীসের কোনো বক্তব্য পরিত্যাগ করেন না বা তার বাইরে যান না। কুরআন বা সহীহ হাদীসের মুকাবিলায় কোনো ‘আকলী দলীল’ বা কোনো ব্যক্তির বক্তব্য তারা পেশ করেন না। ইমাম তাহাবী এ বিষয়টির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।’’[4]
আকীদার উৎস বিষয়ক মূলনীতিই আহলুস সুন্নাতের সকল আকীদার মুলনীতি ব্যাখ্যা করে।
[2] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৩।
[3] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৪।
[4] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয্যাহ, পৃ. ৩৫৪-৩৫৫।ু