আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদার মূলনীতি বুঝতে হলে আমাদেরকে আহলূল বিদ‘আত ওয়াল ইফতিরাকের আকীদার মুলনীতি জানা দরকার। কারণ বিদ‘আতীদের বিদ‘আতের বিপরীতেরই তাঁরা সুন্নাত-সম্মত আকীদা ব্যাখ্যা করেছেন। উপরের বক্তব্য ও পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, ঈমানের আরকানসমূহের মধ্যে কিছু বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি হয় নি বা বিভক্তি মেনে নেওয়া হয়নি এবং কিছু বিষয়ে বিভক্তি হয়েছে।
(১) আকীদার উৎস: এ বিষয়ে ব্যাপক মতভেদ হয়েছে। বিভ্রান্ত ফিরকাগুলি কুরআন ও সুন্নাহর পাশাপাশি যুক্তি, দর্শন, বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের মতামত, ব্যাখ্যা ইত্যাদিকে আকীদার উৎসর ও ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের নিকট দর্শন, যুক্তি ইত্যাদিই আকীদার মুল ভিত্তিতে পরিণত হয়। শীয়া সম্প্রদায়ের নিকট ইমামগণ বা ইমামগণের প্রতিনিধিদের ব্যাখ্যায় আকীদার মূল উৎসরূপে স্বীকৃত। কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়াও কাশফ, ইলহাম, ইলকা বা ‘সরাসরি বিশেষ জ্ঞানকে তারা আকীদার উৎসরূপে গ্রহণ করে। এ সকল ফিরকার অনুসারীদের নিকট মূলত এ সকল অতিরিক্ত বিষয়ই আকীদার মূল উৎস হিসেবে পরিণত হয়। এগুলির ভিত্তিতে তারা কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য গ্রহণ করে বা ব্যাখ্যা করে বর্জন করে।
(২) তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ: এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মতভেদ নেই। কেউ এ বিষয়ে মতভেদ করলে বা রুবুবিয়্যাতের কোনো বিষয় অস্বীকার বা অবিশ্বাস করলে তাকে কাফির বলে গণ্য করা হয়েছে।
(৩) তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ বা তাওহীদুল ইবাদাত। এ বিষয়ে কোনো মতভেদ হয় নি। কেউ আল্লাহর ইবাদতের তাওহীদ অস্বীকার করলে বা এ বিষয়ে কাউকে শরীক করলে তাকে কাফির বা মুশরিক বলে গণ্য করা হয়েছে। তাকে আর বিভ্রান্ত মুসলিম ফিরকা বলে গণ্য করা হয় নি, বরং অমুসলিম কাফির ফিরকা বলে গণ্য করা হয়েছে।
(৪) তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ব্যাপক মতভেদ হয়েছে। মূলত মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ বিভক্তি ও ফিরকাবাজি এ বিষয়টি নিয়েই। আল্লাহর ইলম, ইচ্ছা, রেযামন্দি, লিখনি, ক্ষমা, ক্ষমতা, শাস্তি ইত্যাদি বিষয় নিয়েই কাদারিয়াহ, জাবারিয়াহ, খারিজী, মু’তাযিলী, জাহমিয়্যাহ ইত্যাদি সকল ফিরকার উদ্ভব। তাকদীর, পাপী মুমিনের বিধান ইত্যাদি সবই এ বিষয় কে&&ন্দ্রক।
(৫) রিসালাতের বিশ্বাস। এ বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তির উন্মেষ ঘটে। কোনো কোনো সীমালঙ্ঘনকারী শীয়া সম্প্রদায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নুবুওয়াতের সর্বজনীনতা, তাঁর আদর্শের অলঙ্ঘনীয়তা, তাঁর খাতমুন নুবুওয়াত ইত্যাদি বিষয় অস্বীকার করার কারণে তাদেরকে কাফির বলে গণ্য করা হয়েছে। সাধারণভাবে শীয়া মতবাদের মধ্যে রিসালাতের সর্বজনীনতা সীমিত করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি ভালবাসার দাবি যে, তাঁর উম্মাতের মধ্যে যাদের বিষয়ে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদেরকে এবং যারা আনুগত্যে-অনুকরণে অগ্রগামী তাদেরকেও ভালবাসতে হবে। শীয়াগণ এক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়। সাধারণভাবে ওলীগণের বিষয়ে এবং বিশেষত আলী-বংশের ইমামগণের বিষয়ে ভক্তিতে বাড়াবাড়ি করে তারা তাদেরকে রিসালাতের কিছু মর্যাদা দিয়েছে এবং এভাবে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের সর্বজনীনতা সীমিত করেছে। শীয়া মতবাদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে ‘ইমাম’ হিসেবে অথবা ইমামগণের ‘খলীফা’ হিসেবে অনেক মানুষের ইসমাত বা নিষ্পাপত্ব ও অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করা হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এরূপ ব্যক্তিদের বিশেষ অধিকার কল্পনা করা হয়েছে। ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রদত্ত কুরআন ও সুন্নাতের গুরুত্ব মূলত বিনষ্ট হয়েছে। এ বিশ্বাস অনুসারে কুরআন ও সুন্নাহর অবস্থা মূলত তাওরাত, ইঞ্জিল ও অন্যান্য গ্রন্থের মত হয়ে যায়। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীসে যা কিছুই থাক না কেন তা ইমামগণ বা বা ওলীগণ কর্তৃক কাশফ, ইলহাম বা ‘ইলমু লাদুন্নী’-র ভিত্তিতে দেওয়া ব্যাখ্যার আলোকে গ্রহণ করতে হবে। এর বাইরে সব কিছু বাতিল বলে গণ্য হবে। মু’তাযিলা ও অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায় মিরাজ বা অনুরূপ কিছু মুজিযা অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করেছে। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ ও নবীবংশের মানুষদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে উম্মাতের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ ও বিভক্তি জন্ম নিয়েছে। আমরা দেখছি যে, শীয়াগণের এ বিভ্রান্তি মূলত আকীদার উৎস কেন্দ্রিক।
(৫) মালাইকা ও গ্রন্থসমূহের প্রতি ঈমানের বিষয়ে বিভক্তি দেখা দেয় নি। তবে গ্রন্থসমূহের প্রতি বিশ্বাসের একটি দিক আল্লাহর কালাম বা কথা বিশেষণের সাথে জড়িত। আর আল্লাহর কালাম বা কথা বিশেষণটির প্রকৃতি নিয়ে উম্মাতের মধ্যে ব্যাপক বিভক্তি হয়েছে বলে আমরা দেখেছি ও দেখব।
(৬) আখিরাতের প্রতি ঈমানের বিষয়ে যে মতভেদ ও বিভক্তি হয়েছে তার অন্যতম আখিরাতের বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট কবরের আযাব, শাফা‘আত ও জান্নাতে আল্লাহর দর্শনের বিষয়। এগুলির মধ্যে শাফা‘আত ও আল্লাহর দর্শন বিষয়ক মতভেদ মূলত তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বিষয়ক মতভেদ।
(৭) তাকদীরের বিষয়ে উম্মাতের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ ও বিভক্তি জন্ম নিয়েছে। এ বিষয়টিও মূলত তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত কেন্দ্রিক। মহান আল্লাহর ইলম, ন্যায়বিচার, ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত বিষয়ক বিশেষণগুলিকে কেন্দ্র করেই এ বিষয়ক মতভেদ।
(৮) পাপী মুমিনের বিধান বিষয়ে ব্যাপক মতভেদ হয়েছে। এ বিষয়টিও মূলত তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। মহান আল্লাহর ক্ষমা, ক্ষমতা, দয়া, প্রতিশ্রুতি ও ন্যায়পরায়ণতার বিশেষণগুলিকে কেন্দ্র করে এ বিষয়ক মতভেদ ও বিভক্তি জন্ম নেয়।
(৯) রাষ্ট্র ও মুসলিম নাগরিকের সম্পর্ক বিষয়ে বিভক্তি ঘটেছে। পাপী মুমিনের বিধান বিষয়কে কেন্দ্র করে মূলত এ বিষয়ক বিভক্তি জন্ম নেয়।