ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, সাহাবীগণের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে ইফতিরাকের উন্মেষ ঘটে। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যা কিছু শুনেছেন কোনোরূপ দ্বিধা, প্রশ্ন, স্বরূপ নির্ণয় বা প্রকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে তা সবই সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেছেন।
ইসলামের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে ইরান, ইরাক, মিসর, সিরিয়া ইত্যাদি দেশের অগণিত মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এদের অনেকেই সাহাবীদের সাহচার্য লাভ করতে পারেন নি। ফলে ইসলামের মূল প্রেরণা ও বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে দুর্বলতা বিদ্যমান থাকে। এছাড়া তাদের পূর্ববর্তী ধর্মের বিভিন্ন মতামত, বিতর্ক ও তাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন যুক্তি, দার্শনিক মতামত ইত্যাদি তাদের মন-মগজকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এগুলির ভিত্তিতেই তারা ইসলামী বিশ্বাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিতর্ক ও পর্যালোচনা শুরু করেন এবং নতুন নতুন মতামত প্রকাশ করতে থাকেন।
এগুলির পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক মতভেদও ইফতিরাকের একটি পেক্ষাপট রচনা করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পূর্বে আরব দেশে কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না। আরবের মানুষের বংশতান্ত্রিক কবীলা প্রথার অধীনে বসবাস কর। তিনিই প্রথম তথায় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রচলন করেন। এ বিষয়ে তিনি অনেক নির্দেশনা প্রদান করেন। তবে বিষয়ের নতুনত্বের ও জটিলতার কারণে এ বিষয়ে সাহাবীগণের মধ্যে ইখতিলাফ বা মতভেদ সৃষ্টি হলেও তা ঐকমত্যের মাধ্যমে সমাধান হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পরে আবূ বাকর (রাঃ)-এর খলীফা নির্বাচন, উমরের (রাঃ) নির্বাচন, উসমানের (রাঃ) নির্বাচন, আলী (রাঃ)-এর নির্বাচন ইত্যাদি সবই মতভেদের পর ঐক্যমতের মাধ্যমে সমাধান হয়। আমরা পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখব যে, আলী (রাঃ)-এর সময়ে রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু মতভেদ যুদ্ধের পর্যায়ে গেলেও তা ‘ইফতিরাক’ বা বিভক্তির পর্যায়ে যায় নি।
কিন্তু সাহাবীগণের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের জন্য এ সকল মতভেদ বিভক্তির অন্যতম কারণ ছিল। অজ্ঞতা, অপপ্রচার, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে এ সকল রাজনৈতিক মতভেদ ইফতিরাক বা বিভক্তি সৃষ্টিকারীদের হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এভাবে আমরা দেখছি যে, নতুন প্রজন্মের মুসিলমদের মধ্যে অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, প্রচলিত দর্শন বা আচার-আচরণের প্রভাব, রাজনৈতিক মতভেদ, অপপ্রচার ইত্যাদি ইফতিরাক বা ফিরকা ও দলাদলির প্রেক্ষাপট তৈরি করে। এ প্রেক্ষাপটে প্রথম হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকেই ফিরকাসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। আলী (রাঃ)-এর সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে দুটি দল এরূপ বিভক্তির ও বিভ্রান্তির শুরু করে (১) খারিজীগণ এবং (২) শীয়াগণ। সময়ের আবর্তনে ক্রমান্বয়ে এদের বিভ্রান্তি ও বিভক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এদের নিজেদের মধ্যেও বিভক্তি বাড়তে থাকে।
প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষভাগ থেকে নতুন বিভ্রান্তি ও বিভক্তি প্রকাশ পেতে থাকে। কাদারীয়া, জাহমিয়্যাহ, মুরজিয়া, জাবারিয়া, মুতাযিলা ইত্যাদি মতবাদ আত্মপ্রকাশ করে।