ইফতিরাক বা মুসলিম উম্মাহর আকীদাগত বিভাজন ইসলামী আকীদার অন্যতম বিষয়। সুন্নাত থেকে বিচ্যুতি ও বিদ‘আতের উদ্ভাবনই ইফতিরাকের মূল কারণ। ইফতিরাক বা বিভক্তি ও ফিরকাসমূহের প্রকৃতি না বুঝলে ইসলামের বিশুদ্ধ বিশ্বাস এবং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হৃদয়ঙ্গম করা কষ্টকর।
৬. ২. ১. ইফতিরাক
ইফতিরাক (الافتراق) শব্দটি আরবী ‘ফারক’, ‘ফারাকা’ (فرق) শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ পার্থক্য করা, বিভক্ত করা, বিচ্ছিন করা ইত্যাদি। ইফতিরাক (الافتراق) অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, দলাদলি করা, বিভক্ত হওয়া ইত্যাদি। ফির্কা (الفرقة) অর্থ দল, সংগঠন।
ইফ্তিরাক (الافتراق) শব্দটি ‘ইজতিমা’ (الاجتماع) শব্দটির বিপরীত। মহান আল্লাহ বলেন:
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا
‘‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ কর সমবেতভাবে, এবং পরস্বপর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’’[1]
এখানে আল্লাহ জামা‘আত (الجماعة) বা ইজতিমা (الاجتماع)-এর বিপরীতে ‘ইফতিরাক’ ও ‘তাফার্রুক’ উল্লেখ করেছেন। ইজতিমা অর্থ ঐক্যবদ্ধ হওয়া, অবিভক্ত হওয়া, দলবিহীন হওয়া ইত্যাদি।
৬. ২. ২. ইফতিরাক বনাম ইখতিলাফ
ইফতিরাকের নিকটবর্তী আরেকটি শব্দ ‘ইখতিলাফ’। ইফতিরাক অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া বা দলে দলে বিভক্ত হওয়া। আর ইখতিলাফ অর্থ মতভেদ করা। ইফতিরাক ও ইখতিলাফ-এর মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। মতভেদ বা মতবিরোধিতা সাধারণভাবে বিচ্ছিন্নতা বা দলাদলি নয়। মতভেদকারী ব্যক্তিগণ যখন নিজের মতকেই একমাত্র ‘হক্ক’ ও অন্যমতকে বাতিল মনে করেন এবং অন্যমতের অনুসারীদের ‘অন্যদল’ মনে করেন তখনই তা ইফতিরাক বা ‘বিচ্ছিন্নতা’-য় পরিণত হয়।
‘ইখতিলাফ’ ও ‘ইফতিরাক’-এর পাথ্যর্কের মধ্যে রয়েছে:
(১) ইফতিরাক বা ফিরকাবাজি ইখতিলাফ বা মতভেদের চূড়ান্ত ও নিন্দনীয় পর্যায়।
(২) সকল ইফতিরাকই (দলাদলি) ইখতিলাফ (মতভেদ), তবে সকল ইখতিলাফ (মতভেদ) ইফতিরাক (দলাদলি) নয়। ইখতিলাফ ছাড়া ইফতিরাকের অস্তিত্ব নেই তবে ইফতিরাক ছাড়াও ইখতিলাফ থাকতে পারে। এজন্য ইফতিরাককে ইখতিলাফ বলা যায়, তবে ইখতিলাফকে ইফতিরাক বলা যায় না।
(২) ইখতিলাফ সর্বদা ইফতিরাক বা দলাদলি সৃষ্টি করে না। সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মার ইমাম ও আলিমদের মধ্যে ‘মতভেদ’ বা ইখতিলাফ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা বা ইফতিরাক ছিল না।
(৩) শরীয়তের দৃষ্টিতে ইখতিলাফ বা মতভেদ নিষিদ্ধ, নিন্দনীয় বা আপত্তিকর নয়, বরং অনেক সময় তা প্রশস্ততা সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ইফতিরাক বা দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতা সকল ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়।
(৪) ইখতিলাফকারী আলিম নিন্দিত নয়, বরং তিনি ইখলাস ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে প্রশংসিত ও পুরস্কার-প্রাপ্ত। মুজতাহিদ ভুল করলে একটি পুরস্কার ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছালে দুটি পুরস্কার লাভ করেন।
(৫) ইখতিলাফের ভিত্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইলম বা জ্ঞান ও দলিল। আর ইফতিরাকের ভিত্তি সর্বদাই ব্যক্তিগত পছন্দ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ, জিদ ও ইখলাসের অনুপস্থিতি। ইখতিলাফের ক্ষেত্রে আলিমগণ প্রত্যেকে নিজের মতকে সঠিক, অধিকতর শুদ্ধ বলে মনে করলেও অন্য মতটিকে বিভ্রান্তি ও অন্যমতের আলিমকে ‘বিভ্রান্ত’ বলে মনে করেন না, বরং তার দলিলকে দুর্বল বলে গণ্য করেন। পক্ষান্তরে ইফতিরাকের ক্ষেত্রে প্রত্যেক আলিম নিজের মতকে একমাত্র সত্য এবং অন্য মতকে বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেন।
(৬) ইলম, ইখলাস, ইসলামী ভ্রাতৃতবোধ ও ভালবাসার সাথে ইখতিলাফ থাকতে পারে। কিন্তু এগুলির সাথে ‘ইফতিরাক’ থাকতে পারে না। কেবলমাত্র এগুলির অনুপস্থিতিতেই ইফতিরাক জন্ম নেয়।
(৭) ইখতিলাফ অনেক ক্ষেত্রেই রহমত, পক্ষান্তরে ইফতিরাক সকল ক্ষেত্রেই আযাব ও ধ্বংস।