উপরের হাদীসগুলি থেকে আমরা বিদ‘আতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারছি। আমরা দেখছি যে, সাহাবীগণ দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমদেরকে বারংবার সুন্নাতের অনুসরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং বিদ‘আত, উদ্ভাবন বা সুন্নাতের ব্যতিক্রম করতে নিষেধ করছেন। সুন্নাত পদ্ধতিতে অল্প ইবাদত বিদ‘আত পদ্ধতিতে বেশি ইবাদতের চেয়ে উত্তম বলে জানাচ্ছেন।
এথেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমদের মধ্যে দীনের বিষয়ে উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বিদ‘আতের উৎপত্তি হয়। সাহাবীদের সাহচার্য বঞ্চিত আবেগী ধার্মিক মানুষেরা দীন পালনের বা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সুন্নাতের ব্যতিক্রম মত, বিশ্বাস বা কর্মের মধ্যে নিপতিত হতে থাকে। সাহাবীগণ এ সকল ব্যতিক্রম প্রতিরোধে সচেষ্ট ছিলেন। এরপরও ক্রমান্বয়ে বিদ‘আত প্রসার লাভ করতে থাকে।
এ সকল বিদ‘আত দু ভাগে বিভক্ত: (১) আকীদা বা বিশ্বাসের বিদ‘আত (البدعة العقدية) এবং কর্মের বিদ‘আত (البدعة العملية)। আমাদের আলোচনা আকীদার বিদ‘আতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছি, কারণ ইফতিরাক মূলত আকীদার বিদ‘আতকে কেন্দ্র করে। কর্ম বিষয়ক বিদ‘আত সম্পর্কে আমি ‘এহইয়উস সুনান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ৩০-৩৫ হিজরীর দিকে আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা ও তার অনুসারীগণ নবী-বংশের ভালবাসা ও ভক্তির নামে বিভিন্ন বিদ‘আতী আকীদা প্রচলন করে, যা কুরআনে, হাদীসে বা সাহাবীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল না। তাদের এ সকল বিদ‘আতী বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে:
(১) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আলীর (রাঃ) রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং ইসলামী আকীদার মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
(২) আলী (রাঃ) ও তাঁর বংশের ইমামগণ মা’সূম বা নিষ্পাপ।
(৩) আলী (রাঃ) তাঁর মৃত্যুর পরে আবার ফিরে আসবেন।
(৪) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে বিশেষ কিছু গোপন ইলম দান করেছেন এবং আলীর (রাঃ) নিকট গুপ্ত ইলমের ভান্ডার রয়েছে।
(৫) আলী (রাঃ)-এর মধ্যে আল্লাহর বিশেষ ক্ষমতা, সম্পর্ক বা বিশেষত্ব রয়েছে বা তিনি অবতার।
(৭) সাহাবীগণের প্রতি কুধারণা পোষণ করা, তাঁদেরকে ধর্মচ্যুত বা মুরতাদ মনে করা ও তাঁদের সকলকে বা অধিকাংশকে গালি দেওয়া।
প্রথম হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে এ সকল বিদ‘আতের উৎপত্তি ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে তা কিছু মানুষের মধ্যে প্রসার লাভ করতে থাকে। আলী (রাঃ) নিজে এদের বিভ্রান্তি দূর করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। যারা তাঁর উলূহিয়্যাত বা ‘আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক’ দাবি করত বা তাকে সাজদা করত তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন। সর্বশেষ যারা তার কথা মানতে অস্বীকার করে তাদের কয়েকজনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।
আলী (রাঃ)-এর সময় থেকে (৩৫-৪০হি) খারিজীগণের বিদ‘আতী আকীদার উন্মেষ ঘটে। তাদের বিদ‘আতী আকীদার মধ্যে রয়েছে:
(১) কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুসলিম কাফির বলে গণ্য।
(২) পাপী রাষ্ট্রপ্রধানের ইমামত অবৈধ এবং তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয।
প্রথম হিজরীর শেষভাগ থেকে কাদারীয়াদের বিদ‘আতের উন্মেষ ঘটে। এসময়ে ক্রমান্বয়ে মুরজিয়া, জাবারিয়া, মুতাযিলা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আকীদাগত বিদ‘আতসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। আমরা এদের বিদ‘আতী আকীদাগুলি ফিরকাসমূহের আলোচনার সময় উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।