আকীদার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি ও ফিরকাসমূহের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভ্রান্ত ফিরকাসমূহের বিভ্রান্তির কারণ ও স্বরূপ না জানলে এরূপ বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর বিভক্তি ও ফিরকার আলোচনার পূর্বে বিদ‘আতের আলোচনা অত্যাবশ্যক, কারণ বিদ‘আতই বিভক্তির একমাত্র কারণ। এখানে উল্লেখ্য যে, বিদ‘আতের পরিচিতি, প্রকারভেদ, উৎপত্তি, কারণ ও কর্মবিষয়ক বিদ‘আতগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে। এখানে প্রসঙ্গত বিদ‘আতের পরিচয় আলোচনার পরে আকীদা বিষয়ক বিদ‘আত প্রসঙ্গে আলোচনা সীমিত রাখার চেষ্টা করব। মহান আল্লাহর তাওফীক ও কবুল্যিত প্রাথনা করছি।
৬. ১. বিদ‘আতের পরিচয় | ৬. ১. ১. অভিধানে বিদ‘আত
বিদ’আত শব্দটি আরবী ‘বাদা‘আ’ (بَدَعَ) ক্রিয়া থেকে গৃহীত ইসম। বাদ‘আ অর্থ নব-উদ্ভাবন বা অনাস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান (Innovation)। বিদ‘আত অর্থ নব-উদ্ভাবিত বিষয়।[1] ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবনু দুরাইদ (৩২১ হি) বলেন, ‘‘বাদা‘আ অর্থ কোনো কিছু শুরু করা বা উদ্ভাবন করা। আল্লাহর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ‘বাদী’, অর্থাৎ উদ্ভাবক ও অনাস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব-দাতা বা সৃষ্টিকর্তা। যে ব্যক্তি কোনো বিষয় নতুন উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করে সে তার বিদ‘আত-কারী বা উদ্ভাবক। ইসম ‘বিদ‘আত’।’’[2]
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ আল-জাওহারী (৩৯৩ হি) বলেন:
والبِدْعَةُ: الحَدَثُ في الدين بعد الإكْمال.
‘‘আল-বিদ‘আত অর্থ পূর্ণতার পরে দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন।’’[3]
ফাইরোয-আবাদী (৮১৭ হি) বলেন:
والبِدْعَةُ بالكسر: الحَدَثُ في الدين بعدَ الإِكْمَالِ، أو ما اسْتُحْدِثَ بعد النبيِّ (ﷺ) من الأَهْواءِ والأَعْمالِ
‘বিদ‘আত: পূর্ণতার পরে দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন, অথবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে যে মতবাদ বা কর্ম উদ্ভাবিত হয়েছে।’’[4] ইবনু মানযূরও অনুরূপ বলেছেন।[5]
আল্লামা ইবনু নুজাইম (৭৯০ হি) আল-বাহরুর রায়েক গ্রন্থে বলেন:
الْبِدْعَةِ وَهِيَ كَمَا فِي الْمُغْرِبِ اسْمٌ مِنْ ابْتَدَعَ الْأَمْرَ إذَا ابْتَدَأَهُ وَأَحْدَثَهُ ثُمَّ غَلَبَتْ عَلَى مَا هُوَ زِيَادَةٌ فِي الدِّينِ أَوْ نُقْصَانٌ مِنْهُ. وَعَرَّفَهَا الشُّمُنِّيُّ بِأَنَّهَا مَا أُحْدِثَ عَلَى خِلافِ الْحَقِّ الْمُتَلَقَّى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ (ﷺ) مِنْ عِلْمٍ أَوْ عَمَلٍ أَوْ حَالٍ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ وَاسْتِحْسَانٍ وَجُعِلَ دِينًا قَوِيمًا وَصِرَاطًا مُسْتَقِيمًا.
‘‘আল-মুগরিব গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘বিদ‘আত শব্দটি ‘ইবতাদ‘আ’ ফি’ল থেকে গৃহীত ইসম। ফিলটির অর্থ শুরু করা বা উদ্ভাবন করা। অতঃপর দীনের মধ্যে সংযোজন বা বিয়োজন অর্থে বিদ‘আত শব্দটির ব্যবহার প্রাধান্য লাভ করে।’ শুম্মানী বিদ‘আতের সংজ্ঞায় বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে গৃহীত সত্যের ব্যতিক্রম যে জ্ঞান-মত, কর্ম বা অবস্থা কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য ভুল বুঝার কারণে এবং ভাল মনে করে উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং যাকে সঠিক দীন ও সিরাতে মুস্তাকীম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই বিদ‘আত’।’’[6]
আল্লামা ইবরাহীম ইবনু মূসা আশ-শাতিবী (৭৯০ হি) বলেন:
فالبدعة إذا عبارة عن طريقة في الدين مُخْتَرَعَةٍ تُضَاهِي الشَّرْعِيَّةَ، يقصد بالسلوك عليها البمالغة في التعبد لله سبحانه
‘‘বিদ‘আত বলতে বুঝায় দীনের মধ্যে শরীয়তের পদ্ধতির তুল্য কোনো নব-আবিষ্কৃত- উদ্ভাবিত তরীকা বা পদ্ধতি মহান আল্লাহর অতিরিক্ত ইবাদতের আশায় যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়।’’[7]
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আলী আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮ হি) তাঁর আদ-দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে বিদ‘আতের পরিচয়ে বলেন:
وَهِيَ اعْتِقَادُ خِلافِ الْمَعْرُوفِ عَنْ الرَّسُولِ لا بِمُعَانَدَةٍ بَلْ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ
‘‘বিদ‘আত হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সুপরিজ্ঞাত বিষয়ের ব্যতিক্রম কোনো বিশ্বাস, যে ব্যতিক্রমের কারণ ইচ্ছাকৃত বিরোধিতা নয়, বরং কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ বুঝতে অস্পষ্টতা বা ভুল বুঝা।’’[8]
[2] ইবনু দুরাইদ, জামহারাতুল লুগাত ১/১২৭।
[3] জাওহারী, আস-সিহাহ ৩/১১৮৪।
[4] ফাইরোযাবাদী, আল-কামূসুল মুহীত ২/২৫২।
[5] ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ৮/৬।
[6] ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক শারহু কান্যুদ-দাকাইক ১/৬১১।
[7] শাতিবী, আল-ই’তিসাম ১/৫০।
[8] ইবনু আবেদীন, রাদ্দুল মুহতার ১/৫৬০।