আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ‘অলৌকিকভাবে’ নির্ভর করা বা তাওয়াক্কুল করা শিরক। এ জাতীয় শিরক এখনো এদেশের অজ্ঞ মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক। যেমন কোনো কর্ম শুরু করার সময়, যাত্রার সময় বা নৌকা চালানোর সময় আল্লাহর নামের সাথে গাজী পীর, চাচী পীর, পাঁচ পীর, খোয়াজ খিযির, বদর পীর বা অনরূপ কোনো সত্য বা কল্পিত পীর বা ওলীর নাম নেওয়া। অনুরূভাবে মা, বাবা, খাজা বাবা, পাক পাঞ্জাতন বা অন্য কারো নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করা, বা যাত্রার শুরুতে বা কোনো কাজের শুরুতে এরূপ কারো নাম স্মরণ করে কপালে হাত দিয়ে সালাম করে বা মাথা নুইয়ে তার প্রতি সালাম জানিয়ে কাজ শুরু করা, কাজের শুরতে যন্ত্র, কাস্তে বা অন্য কিছুকে কপালে ঠেকানো বা সালাম করা, ফাতিমা (রাঃ)-কে বরকতের মালিক মনে করে ওযন করার সময় তাঁর নাম নিয়ে বা ‘মা বরকত’ নাম নিয়ে শুরু করা, প্রথম ফল, ফসল, দুধ ইত্যাদি মানিক পীর বা কারো নামে ফেলে দেওয়া এবং এভাবে তাদের সাহায্যের আশা করা .... ইত্যাদি অগণিত শিরকী কর্ম ও বিশ্বাস সমাজের আনাচে কানাচে এখনো বিদ্যমান। বস্ত্তত কুরআন ও হাদীসের জ্ঞানের অভাব, পূর্ববর্তী ও পার্শবর্তী ধর্মের প্রভাব, মানবীয় দুর্বলতা, আলিমগণের অসতর্কতা, স্বার্থান্বেষীদের লোভ ও অপপ্রচার, শয়তানের প্রতারণা ইত্যাদি কারণে এভাবে সরলপ্রাণ অজ্ঞ মুসলিমগণ শিরকের মধ্যে নিপতিত হচ্ছেন।
আনুগত্য বিষয়ক শিরক প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী ‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পন্ডিতগণকে এবং সংসার-বিরাগীগণকে রবব-প্রতিপালক রূপে গ্রহণ করেছে’’ এ আয়াত উল্লেখ করে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী তাঁর ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গ্রন্থে বলেন: ‘‘উল্লেখিত আয়াতে শিরককে ইহূদী ও খৃস্টানদের সাথে সংশ্লিষ্ট করা সত্ত্বেও অন্য কোনো সম্প্রদায় ঐ সমস্ত কাজ করিলে তাহাদের জন্যও উহা শিরক হইবে এবং তাহারা মুশরিক নামে পরিচিত হইবে। বর্তমান যুগে কান্ডজ্ঞানহীন কিছু সংখ্যক অজ্ঞ লোক বলিয়া বেড়ায়, পীর-ফকীরগণ যাহা আদেশ করে উহা বিনাদ্বিধায় মানিয়া চলা ওয়াজিব। তাহাদের আদেশ নিষেধ যদি শরীয়ত বিরোধীও হয় এবং শরীয়ত যদি উহা প্রত্যাখ্যানও করে তথাপি আমাদের পক্ষে উহা পালন করা কর্তব্য। তাহদের উপরোক্ত দাবীর সমর্থনে হাফেয সিরাজীর একটি রূপক কবিতা প্রমাণ স্বরূপ দাঁড় করায়। হাফেয সিরাজী বলিয়াছেন: ‘পীরে কামেল যদি তোমার জায়নামাযকে শরাব দিয়া রঙিন করার আদেশ দেন তবে তোমার পক্ষে উহা কার্যকরী করা প্রয়োজন। কারণ পথ প্রদর্শক কখনও পথ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন না।’ ফলে ইহারাও ‘আরবাবাম মিন দূনিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে মাবুদ সাব্যস্তকারীদের ন্যায় শিরকে তমসায় তমসাচ্ছাদিত। ....।’’[1]
শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রাহ) আরো বলেন: ‘‘সাধারণ কোনো মানুষ যদি কোনো একজন ফকীহকে একথা ভেবে তাকলীদ বা অনুসরণ করে যে, তাঁর মত মানুষের কোনো ভুল হতে পারে না এবং তিনি যা বলবেন তা অবশ্যই সঠিক এবং তার মনের মধ্যে এরূপ চিন্তা করে যে, উক্ত আলিমের মতের বিরুদ্ধে দলিল প্রকাশ পেলেও তার অনুসরণ ত্যাগ করব না, তবে তা হবে পন্ডিতগণকে ও সংসারবিরাগিগণকে রাবব-প্রতিপালক রূপে গ্রহণ করা। ... কিন্তু যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথাকেই একমাত্র দীন মনে করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা হালাল বা হারাম করেন তা ছাড়া অন্য কিছুকেই হালাল বা হারাম বলে মনে করে না, তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাণী ও শিক্ষা সম্পর্কে তার জ্ঞানের কমতির কারণে কারো তাকলীদ-অনুসরণ করে এবং বাহ্যিকভাবে সুন্নাতে নববীর অনুসরণ করতে থাকে এবং কোনো বিষয়ে তার কর্ম সুন্নাতের খেলাফ হলে কোনো বিতর্ক-আপত্তি না করেই তা বাদ দিয়ে সুন্নাত গ্রহণ করে তবে তা কখনোই আপত্তিকর নয়।’’[2]
মুশরিকদের ভালবাসার শিরক সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘একমাত্র আল্লাহর কথা বলা হলে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে যারা তাদের উল্লেখ করা হয়ে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।’’[3]
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী বলেন: ‘‘মহান আল্লাহ এখানে মুশরিকদের যে বিশেষণ উল্লেখ করেছেন আমরা অনেক মানুষকে সে অবস্থায় দেখতে পাই। এ সকল মানুষ যে সকল মৃতব্যক্তির নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করে ও সাহায্য চায় তাদের কথা উল্লেখ করা হলে তারা উৎফুল্ল উল্লসিত হয়। তাদের নামে মিথ্যা কাহিনীগুলি শুনলে তারা উল্লাসে উদ্বেলিত হয়। এসকল কাহিনী তাদের মর্যি ও পছন্দ মত হয় এবং তাদের আকীদার পক্ষে হয় বলেই তারা এরূপ উল্লসিত হয়। যারা এরূপ কাহিনী বর্ণনা করে তাদেরকে তারা খুবই মর্যাদা দেয় এবং ভক্তি করে। আর যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর কথা উল্লেখ করে, একমাত্র তিনিই সকল কার্য পরিচালন করেন এবং সকল ক্ষমতার মালিক বলে উল্লেখ করে এবং তাঁর মহত্ব ও মর্যাদার পরিচায়ক প্রমাণগুলি উল্লেখ করে তার প্রতি তারা বিতৃষ্ণা বোধ করে। এরূপ কার্য যে করে তার প্রতি তারা অন্যন্ত বিরক্ত হয় এবং তার থেকে দূরে অবস্থান করে। তাকে তারা অপছন্দনীয় দল-মতের অনুসারী বলে অভিযোগ করে। একব্যক্তি একদিন কঠিন বিপদে পড়ে কোনো কোনো মৃতমানুষের নিকট ত্রাণ ও সাহায্য প্রার্থনা করছিল এবং বলছিল, হে বাবা অমুক, আমাকে রক্ষা কর। আমি তাকে বললাম, তুমি আল্লাহকে ডাক, বল: হে আল্লাহ; কারণ মহাপবিত্র আল্লাহ বলেছেন: ‘আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে তথন আমি তার আহবানে সাড়া দিই।’’[4] আমার একথায় ঐ ব্যক্তি ক্রোধন্বিত হয়। পরে আমি শুনেছি যে, সে আমার বিষয়ে বলেছে: অমুক ওলীগণের মর্যাদা অস্বীকার করে। আমি শুনেছি যে, তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহর চেয়েও ওলীরা দ্রুত ডাকে সাড়া দেন। এ কথা যে কত বড় কুফরী তা সহজেই বুঝা যায়। আমরা দু‘আ করি যে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিভ্রান্তি ও অবাধ্যতা থেকে রক্ষা করেন।’’[5]
[2] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/৪৪৬-৪৪৭।
[3] সূরা (৩৯) যুমার: ৪৫ আয়াত।
[4] সূরা (২) বাকারা: ১৮৬ আয়াত।
[5] আলূসী, রুহূল মা‘আনী ১৭/৪৮৬-৪৮৭।