আমরা ইতোপূর্বে দু‘আ, সাহায্য প্রার্থনা, ত্রাণ প্রার্থনা ইত্যাদির লৌকিক ও অলৌকিক পর্যায়গুলি আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, দৃশ্যমান বা অদৃশ্য উপস্থিত কোনো মানুষ, জিন্ন বা ফিরিশতার কাছে লৌকিক ও জাগতিক সাহায্য ও ত্রাণ প্রার্থনা করা যায়। কিন্তু অলৌকিক ত্রাণ একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে চাওয়া যায় না। দূরে অবস্থিত বা অনুপস্থিত কারো কাছে লৌকিক বা অলৌকিক সাহায্য চাওয়া এবং উপস্থিত বা অনুপস্থিত কারো কাছে অলৌকিক সাহায্য চাওয়া শিরক।
আমরা আরো দেখেছি যে, ইহূদী, খৃস্টান ও আরবের মুশরিকগণের অন্যতম শিরক ছিল সাধারণ বিপদে আপদে ফিরিশতাগণ, নবীগণ, জিন্নগণ, ওলীগণ বা অন্যান্য কাল্পনিক দেব দেবীদের ডাকা ও তাদের কাছে সাহায্য ও ত্রাণ প্রার্থনা করা। তারা সকলেই বিশ^াস করত যে, একমাত্র আল্লাহই সর্বশক্তিমান প্রতিপালক এবং তাঁর ইচছার বাইরে কারো কিছু করার নেই। তবে তারা বিশ্বাস করত যে, এ সকল বান্দাকে আল্লাহ কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছেন। আল্লাহ এদের সুপারিশ শুনেন এবং এদের ডাকলে তিনি খুশি হন। অবিকল একইরূপ বিভ্রান্তির কারণে মুসলিম সমাজেও এ ধরনের শিরক প্রসার লাভ করেছে। শাহ ওয়ালি উল্লাহর বক্তব্যে আমরা তা দেখেছি।
অগণিত মিথ্যা কল্প-কাহিনী, জনশ্রুতি ও শেষ যুগের কোনো কোনো আলিম নামধারী ব্যক্তির মতামতই এরূপ শিরকে লিপ্ত মানুষদের একমাত্র দলীল। এগুলির বিপরীতে একমাত্র আল্লাহকে ডাকার জন্য কুরআন ও হাদীসের অগণিত নির্দেশনার কোনো মূল্যই তারা দেন না। এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন: ‘‘কবর পূজারিগণ যে সমস্ত কারণে কবর পূজা করিয়া থাকে উহাদের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হইল নিজেদের কুকর্মের সমর্থনে মিথ্যা হাদীস সৃষ্টি করা নিজেদের মনগড়া এই জাতীয় হাদীস প্রচার করিয়া সরল প্রাণ মুসলমানদিগকে ধোকা দিয়া আল্লাহর পথ হইতে দূরে সরাইয়া লইয়া যায়। ..... কবর পূজারী সম্প্রদায় তাহাদের কুকর্মের সমর্থনে যে সমস্ত অলীক ও মনগড়া কাহিনীর অবতারণা করিয়া জনসাধারণকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করিয়া থাকে উহা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। যেমন তাহারা বলিয়া থাকে যে, অমুক ব্যক্তি কঠিন বিপদে পড়িয়া একেবারে দিশাহারা হইয়া পড়ে। মুক্তির কোন পথ দেখিতে না পাইয়া অমুক দরবেশের মাজারে গিয়া বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানায়। কি আশ্চর্য! সেই দরবেশ তাহাকে দুই-একদিনের মধ্যে সমস্ত বিপদাপদ দূর করিয়া দেয়। অমুক ব্যক্তি আসমানী বালায় নিপতিত হইলে অনোন্যপায় হইয়া অমুক কবরের দরবেশকে একাগ্রতার সাথে স্মরণ করিতে থাকে। দেখিতে দেখিতে আসমানী বালা দূর হইয়া যায়। এমনকি কেহ কেহ নিজের কথাও বলিয়া থাকে যে, আমি অমুক বিপদে পতিত হইয়া শেষ চেষ্টা স্বরূপ অমুক পীরের মাজারে নযর-নেওয়াজ লইয়া গিয়া তাহার সকল বিপদ দূর করিয়া দেয় .....
নাউযুবিল্লাহ! আল্লাহ আমদের সকলকে এই শিরক ও বিদআত হইতে নিরাপদ রাখুন।... ঘর হইতে পা বাড়াইলেই যে আল্লাহর খালেছ ইবাদতখানা মসজিদ সেখানে যাওয়ার কষ্টটুকু ইহারা স্বীকার করিতে চায় না। অথচ মাইলের পর মাইল, দিনের পর দিন হাঁটিয়া গিয়া কবরের নিকট ধর্ণা দিয়া পড়িয়া থাকাকেই শ্রেয় মনে করে।... ইহারা যদি কবরে না গিয়া রাস্তাঘাট, হাট-বাজর অথবা গোসলখানায় বসিয়াও এমন কাকুতি-মিনতি ও একাগ্রতার সাথে কান্নাকাটি করিয়া মুক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করিত তবুও আল্লাহ তাদের দোআ কবুল করিতেন, তাহাদের দু‘আ ব্যর্থ হইত না। সুতরাং এই অবস্থায় কবরের বুযর্গী ও প্রভাব মনে করা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ব্যতীত কিছই নহে। আল্লাহ বিপদাপন্নের দোআ যে সকল সময়ই কবুল করিয়া থাকেন ইহা এই অজ্ঞেরা বুঝিতে চায় না। এমন কি কাফেরও যদি আল্লাহর নিকট একাগ্রতার সাথে দোআ করে আল্লাহ তাহাও কবুল করিয়া থাকেন।... ।’’[1]
কেউ কেউ এরূপ শিরককে ‘ওসীলা ধরা’ বলে চালাতে চান। তারা বলেন যে, যারা বিপদে আপদে ওলীগণের নাম ধরে ডাকেন ও সাহায্য চান, তাঁরা মনে করেন না যে, ওলীগণের নিজস্ব ক্ষমতা আছে, বরং সকলেই জানে যে, একমাত্র আল্লাহই সর্বশক্তিমান। তবে তারা আল্লাহর কাছে ওসীলা হিসেবে এদের ডাকেন। আমরা দেখেছি যে আরবের মুশরিকগণও ঠিক একইরূপ যুক্তি পেশ করত। কারো ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া আর অনুপস্থিত কারো কাছে গাইবী বা অলৌকিক সাহায্য চাওয়ার মধ্যে আসমান ও যমীনের পার্থক্য। প্রথম কর্ম শিরক নয়, কিন্তু দ্বিতীয়টি সুস্পষ্ট শিরক।
প্রসিদ্ধ তাফসীর-গ্রন্থ ‘রূহুল মা‘আনী’র প্রণেতা আল্লামা শিহাব উদ্দীন মাহমূদ আল আলূসী আল-হানাফী (১২৭০ হি) তাঁর তাফসীরের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের শিরকের বিষয়টি আলোচনা করেছেন। আল্লাহ বলেন:
هُوَ الَّذِي يُسَيِّرُكُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ حَتَّى إِذَا كُنْتُمْ فِي الْفُلْكِ وَجَرَيْنَ بِهِمْ بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ وَفَرِحُوا بِهَا جَاءَتْهَا رِيحٌ عَاصِفٌ وَجَاءَهُمُ الْمَوْجُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ لَئِنْ أَنْجَيْتَنَا مِنْ هَذِهِ لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ
‘‘তিনিই তোমাদের জলে-স্থলে ভ্রমন করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও এবং এগুলি আরোহী লয়ে অনুকূল বাতাসে বয়ে যায় এবং তারা তাতে আনন্দিত হয়, অতঃপর এগুলি বাত্যাহত এবং সর্বদিক হতে তরংগাহত হয় এবং তারা তা দ্বারা পরিবেশিষ্টত হয়ে পড়েছে বলে মনে করে, তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে আল্লাহকে ডেকে বলে: তুমি আমাদেরকে ত্রাণ করলে আমরা অবশ্য কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’’[2]
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী (রাহ) বলেন: ‘‘এ আয়াত প্রমাণ করে যে, এরূপ অবস্থায় মুশরিকগণ মহান আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকত না। আর আপনি ভালই অবগত আছেন যে, আজকাল মানুষেরা কি করে! জলে বা স্থলে যখন কোনো কঠিন বিপদ বা বড় কোনো সমস্যার মধ্যে তারা নিপতিত হয় তখন তারা এমন ব্যক্তিদেরকে ডাকে যারা কোনো ক্ষতি করেন না এবং উপকারও করেন না, যারা দেখেনও না এবং শুনেনও না। তাদের কেউ খিযির এবং ইলিয়াসকে ডাকে। আর কেউ আবুল খামীস এবং আববাস (আঃ)-কে ডাকে। কেউ বা কোনো একজন ইমামকে ডাকে। কেউ বা উম্মাতের বুজুর্গ-মাশাইখের মধ্য থেকে কারো কাছে আকুতি আবেদন পেশ করে। তাদের মধ্যে একজনকে দেখবেন না যে শুধু তার মালিক-মাওলাকে ডাকছে এবং শুধু তাঁর কাছেই আকুতি আবেদন পেশ করছে। সম্ভবত তার মনের কোনে একবারও এ চিন্তা উকি দেয় না যে, যদি সে একমাত্র আল্লাহকে ডাকত তবে এ সকল বিপদ থেকে রক্ষা পেত। হে পাঠক, আল্লাহর কসম দিয়ে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, বলুন তো, এ দিক থেকে মক্কার মুশরিকগণ এবং বর্তমানের মানুষদের মধ্যে কোন দল অধিকতর হেদায়াত প্রাপ্ত? উভয় প্রার্থনাকারী ও আহবানকারীর মধ্যে কার প্রার্থনা অধিকতর সত্য? আল্লাহর নিকটেই মনোবেদনা জ্ঞাপন করছি এমন এক যুগে, যে যুগে অজ্ঞতার প্রবল ঘুর্ণিঝড় সকলকে আচ্ছন্ন করেছে, বিভ্রান্তির প্রবল ঢেউ বিশাল আকৃতি নিয়ে আছড়ে পড়ছে, শরীয়তের নৌকার রশি ছিন্ন হয়েছে গাইরুল্লাহর নিকট সাহায্য ও ত্রাণ প্রার্থনাকেই মুক্তির ওসীলা রূপে গণ্য করা হয়েছে, জ্ঞানীদের জন্য সৎকাজে আদেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করার ক্ষেত্রে নানপ্রকারের বিপদ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’[3]
[2] সূরা (১০) ইউনুস: ২২ আয়াত।
[3] আলূসী, রুহূল মাআনী ৭/৪৭৪।