আমরা দেখেছি যে, ইবাদত অর্থ প্রগাড় ভয় ও আশার সাথে কারো সামনে নিজের চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করা। আমরা জানি যে, ইসলামে নবীগণ, আলিমগণ, বয়স্কগণ, নেককার মানুষগণ, পিতামাতা বা শাসক-প্রশাসককে ভালবাসতে, শ্রদ্ধা করতে ও আনুগত্য করতে নির্দেশ দিয়েছে। এদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রকাশ করতে গেলে ভক্তি ও বিনয় আসবেই। পাশাপাশি চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া কারো সামনেই প্রকাশ করা যাবে না। এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সীমারেখা রক্ষা করা না গেলে ইবাদতের শিরকের মধ্যে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এজন্য এ বিষয়ক শিরক আলোচনা আগে এ বিষয়ে কয়েকটি মূলনীতি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
(১) রুবূবিয়্যাতের শিরক থেকেই ইবাদতের শিরকের উৎপত্তি। কারো মধ্যে ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করলেই তার প্রতি ‘অলৌকিক’ ভক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা জন্ম নেয়। এজন্য কুরআন ও হাদীসে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ ছাড়া কোনোরূপ কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা আর কারো নেই এবং আল্লাহ কখনো কোনোভাবে কাউকে তা দেন না। শাফা‘আত, কারামাত, মুজিযা, দু‘আ কবুল সবই মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও তাঁরই ইচ্ছাধীন। সর্বদা কুরআন ও হাদীস অর্থসহ অধ্যয়নের মাধ্যমে তাওহীদের এ বিশ্বস সুদৃঢ় করাই ইবাদতের শিরক থেকে বাঁচার উপায়।
(২) হাদীস থেকে আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ পিতামাতার দু‘আ কবুল করেন এবং আরো জানি যে, তিনি তাঁর নেককার প্রিয় বান্দাদের বা ওলীদের দু‘আ কবুল করেন। দুটি বিষয়ই হাদীসে একইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কখনোই আমরা দেখব না যে, কোনো মানুষ তার পিতামাতার কাছে দু‘আর জন্য চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। পক্ষান্তরে একজন ‘ওলী’-র সামনে বা তার মাজারের সামনে সে ‘চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত’ব প্রকাশ করছে। এর কারণ সে তার পিতামাতার বিষয়ে নিশ্চিতরূপে জানে যে, পিতামাতার দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন, তবে করা না করা আল্লাহ ইচ্ছ। আর ‘ওলী’র ক্ষেত্রে তার ধারণা যে তাঁর দু‘আ কবুল করা আর সেভাবে আল্লাহর ইচ্ছাধীন নেই, বরং তাঁর দু‘আ কবুল হওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত। মহান আল্লাহ তাঁকে এত ভালবাসেন যে, তাঁর দু‘আ তিনি ফেলতে পারবেন না.... ইত্যদি। আর এরূপ ধারণাই শিরকের উৎস।
(৩) কে কার পিতা ও মাতা তা সকলেই সুনিশ্চিতভাবে জানে। পক্ষান্তরে কে ওলী তা কেউই সুনিশ্চিতভাবে জানে না। আমরা ইতোপূর্বে এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা আলোচনা করেছি এবং পরবর্তী অধ্যায়েও এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শীয়াদের মতামত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। তাহলে দেখুন! একজন নিশ্চিত জানেন যে, এ ব্যক্তি তার পিতা বা মাতা এবং নিশ্চিত জানেন যে, পিতা ও মাতার দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন। অথচ তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাছে নিজের চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন না। অথচ তিনিই একজন মানুষকে ‘ওলী’ বলে ধারণা করছেন, যদিও সে ব্যক্তি সত্যই আল্লাহর ওলী কিনা তা কোনোভাবেই তিনি বলতে পারেন না, তারপর তিনি তার বিশেষ অধিকারের ধারণা করছেন এবং এ দুটি ‘ধারণা’র ভিত্তিতে মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে উক্ত ব্যক্তির নিকট নিজের চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন।
(৪) ভালবাসা ও ভক্তির ক্ষেত্রে ইসলামী অনুভূতি ও শিরকী অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করুন। শিরকী বিশ্বাসে মানুষ মনে করে যে, এ ব্যক্তি ‘ওলী’, সাধু, ‘সাই বাবা’, ‘অবতার’ বা অনুরূপ কিছু। এ ব্যক্তি হাতে আমাদের কোনো অলৌকিক কল্যাণ বা অকল্যাণের সকল বা কিছু ক্ষমতা আছে। একে আল্লাহ ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন অথবা তার একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে, যাতে তার সুপারিশ তিনি ফেলতে পারবেন না। তাঁকে সম্মান ও ভক্তি করে তাঁর একটু সুনজর লাভ করতে পারলেই তাঁর অলৌকিক প্রভাবে আমার বিপদ কেটে যাবে বা রোগ সেরে যাবে। আমি নেককর্ম করি বা না-করি তাঁকে ভক্তি করলে তিনি আমাকে পরকালে আমার কান্ডারী হবেন। কাজেই যেভাবে পারি, হাতে ধরে, পায়ে ধরে কোনোভাবে একে খুশি করতে পারলেই আমার উদ্দেশ্য হাসিল হবে।
পক্ষান্তরে ‘‘ওলী’’-র তা’যীমের ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের চিন্তা হলো, এই ব্যক্তি আল্লাহর ভালো বান্দা। তিনি আমার মালিকের অনুগত গোলাম। আমার মালিকের গোলামিতে তিনি অগ্রসর বলেই আমি তাঁকে ভক্তি করি ও ভালবাসি, যেন আমার মালিক আল্লাহ খুশি হন। আমি আল্লাহর গোলামিকে ভালবাসি। আর তাঁর গোলামিতে যে ভালো তাকেও ভালবাসি। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবাসি। তাঁর অনুসারীকেও আমি নিঃশর্তে ও নিস্বার্থে ভালবাসি। আমার এই ভক্তি ও ভালবাসা একান্তই আল্লাহর জন্য ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে। এই ব্যক্তির কাছে আমার কোনো চাওয়া- পাওয়া নেই। কোনো ক্ষমতাও তাঁর নেই। তবে আমি জানি যে, আল্লাহর গোলামি ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণে লিপ্ত মানুষকে ভালবাসলে আল্লাহ খুশি হন, তাই ভালবাসি। এজন্য যে পদ্ধতিতে এ সকল মানুষকে ভালবাসতে ও সম্মান করতে আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূল (ﷺ)-কে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেই পদ্ধতিতে তাঁদের ভালবেসে ও সম্মান করে আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি অর্জন করে ধন্য হতে চাই।
(৫) ইতোপূর্বে কুরআন-হাদীসের আলোকে শিরকী কর্মগুলির বর্ণনায় আমরা ইবাদতের শিরকে প্রকারগুলি দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, সাজদা, কুরবাণী, উৎসর্গ, জবাই, মানত, দু‘আ, ডাকা, ত্রাণ প্রার্থনা করা, তাওয়াক্কুল, ভয়, আশা, ভালবাসা, আনুগত্য, যিয়ারত, তাবাররুক ইত্যাদি বিষয় শিরকের মূল। আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সাজদা করা, উৎসর্গ, জবাই বা মানত করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে অলৌকিক ভাবে ডাকা বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকা ও অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করা শিরক। অনুরূপভাবে আল্লাহ ছাড়া কারো উপর হৃদয়ের প্রগাড় ভয় ও ভালবাসাসহ চূড়ান্ত ভক্তিময় তাওয়াক্কুল করা, আল্লাহ ছাড়া কারো নাম নিয়ে পথে বের হওয়া, নদীতে ঝাপ দেওয়া, যাত্রা শুরু করা, বাণিজ্য শুরু করা বা যে কোনোভাবে অলৌকিক নির্ভরতা ও তাওয়াক্কুল প্রকাশ করা শিরক। একইভাবে আল্লাহ ছাড়া কাউকে অলৌকিক ভয়, আশা ও ভালবাস শিরক। এছাড়া আল্লাহ ছাড়া কারো চূড়ান্ত ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য করা শিরক। যদি কেউ মনে করেন যে, পোপ, পাদরি, পীর, গুরু, সাঁই বাবা, খাজা বাবা, পিতামাতা বা অন্য কেউ যদি কোনো পাপের নির্দেশ দেয় তবে কাজটি শরীয়তে পাপ হলেও আমার জন্য তা জায়েয হয়ে যাবে, অথবা এরূপ কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নির্দেশ দেন তবে শরীয়ত বিচার না করে তা পালন করাকে জরুরী হবে, তিনি কোনো কিছুকে বৈধ বললে তা বৈধ হয়ে যাবে, তিনি যদি বলেন এখন থেকে তোমার আর অমুক ফরয ইবাদত করা লাগবে না তাহলে আমার জন্য উক্ত ইবাদতটি অনাবশ্যক হয়ে যাবে ... তাহলে নিঃসন্দেহে তা আনুগত্যের শিরক বলে গণ্য হবে।
(৬) আরবের কাফিরদের জন্য এবং ইহদূী-খৃস্টানদের জন্য যেমন তা শিরক, তেমনি মুসলিম নামধারী কেউ যদি কোনো নবী, ওলী, মাজার, কবর, স্মৃতিময় দ্রব্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে এরূপ কর্ম করে তবে তাও একইরূপ শিরক বলে গণ্য হবে। অজ্ঞতার কারণে কেউ হয়ত মনে করতে পারেন যে, আরবের মুশরিকগণ এ সকল ইবাদত মূতি বা প্রতিমার জন্য করত বলেই কুরআনে তাদের নিন্দা করা হয়েছে। নবীগণ ও ওলীগণ তো আর অক্ষম প্রতিমা নন, বরং তাঁর সক্ষম আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তারা সব শোনেন, দেখেন এবং সুপারিশ করেন, কাজেই তাদেরকে ডাকলে, তাদের উপর তাওয়াক্কুল করলে বা তাদের জন্য মানত করলে অসুবিধা কোথায়। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা সম্পর্কে পরিপূর্ণ অজ্ঞতার কারণেই এরূপ কথা বলা হয়। প্রথমত, যারা মূতিপূজা করেন তারা কখনোই মনে করেন না যে, মাটি বা পাথরের মুর্তিটি তাদের ডাক শোনে বা প্রয়োজন মেটায়। বরং তারা মনে করেন যে, এ মূর্তিটি যার, সে ব্যক্তির আত্মাই তাদের ডাক শোনে এবং প্রয়োজন মেটায়। শুধু তার স্মৃতি হিসেবে মূতিকে তারা সামনে রাখে। আমাদের দেশের যে কোনো হিন্দু পন্ডিতকে জিজ্ঞাসা করলেও তা জানতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মুর্তি ইত্যাদি জড় পদার্থের পূজা ছাড়াও আরবের মুশরিকগণ ফিরিশতাগণ, নবীগণ ও জিন্নগণেরও ইবাদত করত, খৃস্টানগণ ঈসা (আঃ) ও মরিয়ম (আঃ)-এর ইবাদত করত, ইহূদীগণ উযাইর (আঃ)-এর ইবাদত করত। কুরআন ও হাদীসে এদেরকে ডাকা, ত্রাণ চাওয়া, এদের জন্য মানত, জবাই, উৎসর্গ, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি কর্মকে একইভবে শিরক বলে গণ্য করা হয়েছে। উপরে ওসীলা বিষয়ক কুরআনের আয়াতে আমারা দেখেছি যে, মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘বল, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে (ইলাহ) ধারণা কর তাদেরকে আহবান কর, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট (ওসীলা) সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।’’[1]
সাহাবীগণ উল্লেখ করেছেন যে, কাফিররা যে সকল ফিরিশতা ও জিন্নদের ইবাদত করত তাদের বিষয়ে এ কথা বলা হয়েছে। এ সকল ফিরিশতা বা জিন্ন জীবিত ছিলেন, তাঁরা আল্লাহর নেক বান্দা ছিলেন, কিন্তু কুরআনে তাদের ডাকাকে শিরক বলে গণ্য করা হয়েছে এবং স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, বিপদ কাটানোর বা ত্রাণ করার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই।
উপরের আলোচনা থেকে সমাজে প্রচলিত ইবাদত বিষয়ক শিরকী কর্মগুলি আমরা সহজেই বুঝতে পারি। তারপরও সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত কিছু শিরকের বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোকপাত করা প্রয়োজন। নিম্নে এ জাতীয় কিছু কর্মের আলোচনা করছি।