আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের একটি দিক যে, তিনি তাঁর প্রতিপালিতদের জন্য হুকুম, আহকাম বা বিধিবিধান প্রদান করেন। একমাত্র তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত এবং তাঁর নির্দেশই প্রকৃত হালাল বা হারাম অর্থাৎ বৈধতা ও অবৈধতা প্রদান করে। তাঁর বিধান অন্যান্য করার বৈধতায় বিশ্বাস, তাঁর কোনো বিধানের গ্রহণযোগ্যতায় অবিশ্বাস অথবা তিনি ছাড়া অন্য কেউ বিধান প্রদানের চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখেন বলে বিশ্বাস করা ইত্যাদি তাঁর প্রতিপালনের তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক কুফর ও শিরক। সমাজে প্রচলিত এ পর্যায়ের শিরকের বিভিন্ন দিক রয়েছে। সেগুলির অন্যতম:
৫. ৫. ১. ৪. ১. পাপকে বৈধ বলে বিশ্বাস করা
কোনো কর্ম যদি কুরআন-হাদীসের সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীত প্রমাণ দ্বারা পাপ হিসেবে প্রমাণিত হয় তবে সে পাপকে হালাল বা বৈধ বলে বিশ্বাস করা কুফর। অনুরূপভাবে শরীয়তের প্রমাণিত কোনো বিষয় নিয়ে উপহাস করা বা হাসি-মস্করা করাও কুফর। মোল্লা আলী কারী (রাহ) বলেন:
استحلال المعصية صغيرة كانت أو كبيرة إذا ثبت كونها معصية بدلالة قطعية، وكذا الاستهانة بها كفر... وكذا الاستهزاء بالشريعة الغراء كفر.
‘‘কোনো পাপ তা সগীরা হোক বা কবীরা হোক, তা যদি সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীতভাবে পাপ বলে প্রমাণিত হয় তবে তা বৈধ বা হালাল মনে করা কুফর। অনুরূপভাবে কোনো পাপকে হালকা বা গা-সওয়া বলে অবহেলা করাও কুফর। অনুরূপভাবে শরীয়তকে নিয়ে উপহাস বা মস্করা করাও কুফর।’’[1]
এখানে কুফর ও শিরক অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কারণ বান্দা আল্লাহর বিধান দানের সার্বভৌম ক্ষমতা ও তাঁর বিধানের অলঙ্ঘনীয়তা অস্বীকার করেছে এবং সাথে সাথেই সে নিজেকে বা অন্য কাউকে বিধান বিচারের বা বিধান প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করেছে।
৫. ৫. ১. ৪. ২. আল্লাহর নির্দেশের সমালোচনা বা উপহাস
মহান আল্লাহর কোনো নাম বা নির্দেশ নিয়ে উপহাস করা বা তাঁর মর্যাদার অবমাননাকর কোনো বিশেষণ বা কর্ম তাঁর উপর আরোপ করা এই পর্যায়ের কুফর ও শিরক।[2] সমাজে প্রচলিত এ সকল কুফরের মধ্যে রয়েছে, পর্দা, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্জ, বিভিন্ন ইসলামী আইন, চুরির শাস্তি, ব্যভিচারের শাস্তি, মদপানের শাস্তি, মৃত্যুদন্ডের বিধান, তালাকের বিধান বা সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত শরীয়তের কোনো বিধানকে নিয়ে উপহাস করা, তামাশা করা, এরূপ কোনো বিধান অচল, অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক বা অনুপযোগী বলে মনে করা, এগুলির প্রতি অন্তরের বিরক্তি বা আপত্তি অনুভব করা, বা এগুলি ইসলামের মধ্যে না থাকলে ইসলাম আরো উন্নত ধর্ম বলে প্রমাণিত হতো বলে মনে করা। এরূপ সকল বিশ্বাস ও ধারণাই উপরের বিশ্বাসের মত কুফর ও শিরক।
৫. ৫. ১. ৪. ৩. আল্লাহর নির্দেশ অমান্যের বৈধতায় বিশ্বাস
আমরা আলোচনা করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশের বা ইসলামের বিধিবিধানের প্রতি বিশ্বাসসহ যদি কেউ তার ব্যতিক্রম করে বা অবাধ্যতায় লিপ্ত হয় তবে তা পাপ বলে গণ্য হয়, কুফর বলে গণ্য হয় না। কিন্তু এরূপ কর্মে লিপ্ত মানুষ যদি এরূপ ব্যতিক্রম করাকে বৈধ বলে মনে করে তবে তা কুফর ও শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ এতে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, বিধানদান ও তাঁর বিধানের অলঙ্ঘণীয়তা অস্বীকার করা হয় এবং অন্য কারো আল্লাহর বিধানের পর্যালোচনা বা বাতিল করার ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
সমাজে এ পর্যায়ের শিরক-কুফরের দুটি প্রকাশ আছে:
প্রথমত: কুসংস্কারাচ্ছন অজ্ঞ মানুষদের মধ্যে ফকিরী মত সংশ্লিষ্ট অতিভক্তি। এরূপ মানুষেরা বিশবাস করে যে, কোনো মানুষ মহান আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করতে করতে এমন পর্যায়ে যেতে পারে যে, তারপর আর তার শরীয়তের বিধিবিধান পালন করা জরুরী থাকে না এবং তার জন্য শরীয়ত লঙ্ঘন করা বৈধ হয়ে যায়। এরূপ বিশ্বাস সন্দেহাতীতভাবে কুফর ও শিরক। এরূপ বিশ্বাস পোষণকারী যদি নিজে শরীয়ত পালন করেন তবুও তিনি কাফির ও মুশরিক বলে গণ্য হবেন।
আমরা দেখেছি যে, সমাজে শিরক প্রসারের অন্যতম কারণ কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের জীবনধারা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং পরবর্তী যুগের আওলিয়ায়ে কেরামের নামে প্রচলিত অগণিত সত্য-মিথ্যা বানোয়াট ও আজগুবি কাহিনীর প্রাদুর্ভাব। এ সকল গল্প কাহিনীকে ‘দলীল’ করে এজাতীয় শিরক বিশ্বাসকে সমর্থনের চেষ্টা করা হয়।
দ্বিতীয়ত: আধুনিক শিক্ষিত অথচ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষদের ইসলামী আইন বিষয়ক অনুভূতি। অনেক শিক্ষিত মানুষ নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এবং ইসলামের কিছু বিধান পালন করা সত্ত্বেও ইসলামী বিধিবিধান, এগুলির বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট ও সামাজিক ফলাফল সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ক্রুসেডারদের গত হাজার বছরের মিথ্যা প্রচারণার কারণে অনেক সময় ইসলামের কোনো কোনো বিধানকে সময়ের জন্য অনুপোযোগী অথবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনে করেন, অথবা অন্য ধর্মের বা সমাজের প্রচলিত বিধানকে উত্তম মনে করেন। এরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে আল্লাহর বিধানের ব্যতিক্রম বিচার ফয়সালা প্রদানকে বৈধ এবং কোনো অপরাধ নয় বলে মনে করেন। এরূপ ধারণা কুফর ও শিরক। কেউ যদি ব্যক্তিগত দুর্বলতা, লোভ, অসহায়ত্ব, অজ্ঞতা বা অনুরূপ কোনো কারণে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করেন বা আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে বিধান বা ফয়সালা প্রদান করেন তবে তা পাপ বলে গণ্য, কুফর বা শিরক নয়। কিন্তু যদি কেউ এরূপ করাকে বৈধ বলে মনে করেন বা আল্লাহর বিধান ও নির্দেশ অমান্য করার মধ্যে কোনো অপরাধ আছে বলে মনে না করেন তবে তা কুফর ও শিরক বলে গণ্য।
মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।’’[3]
এ আয়াত প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য বলেন: ‘‘এখানে একটি বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে হবে। তা হলো, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা বিধান বা ফয়সালা প্রদান কুফর বলে গণ্য হতে পারে, যে কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধর্মচ্যুত বা মুরতাদ বলে গণ্য হবে, আবার তা কবীরা বা সগীরা গোনাহ বা পাপ বলে গণ্য হতে পারে, এক্ষেত্রে তা কুফর আসগার অর্থাৎ ক্ষুত্রতর কুফর বা রূপক কুফর বলে গণ্য হবে। বিষয়টি নির্ভর করবে বিচারক বা ফয়সালাকারীর অবস্থার উপরে। বিধানটি যে আল্লাহ প্রদান করেছেন সে বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও যদি সে মনে করে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুসারে বিধান বা ফয়সালা প্রদান তার জন্য জরুরী নয়, অথবা সে আল্লাহর নির্দেশিত বিধানটিকে অবজ্ঞা করে বা অবহেলা করে তবে তা কুফর আকবার বা পারিভাষিক কুফর ও ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হবে।
আর যদি সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফয়সালা প্রদান জরুরী এবং বিচার্য বিষয়ে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানও সে জানে, কিন্তু সে উক্ত বিধান পরিত্যাগ করে অন্য ভাবে ফয়সালা দান করে এবং স্বীকার করে যে এরূপ করার কারণে সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তবে সে পাপী। এরূপ পাপী ব্যক্তিকে রূপক অর্থে বা কুফর আসগরের অর্থে কাফির বলা হয়।
আর যদি সে উক্ত বিষয়ে আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, তার সাধ্যমত বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য চেষ্টা করা সত্ত্বেও অজ্ঞতার কারণে সে ভুল করে তবে সেক্ষেত্রে সে ভুলকারী বলে বিবেচিত। সে তার সাধ্যমত চেষ্টা করার করণে সাওয়াব ও পুরস্কার লাভ করবে এবং তার ভুলের অপরাধ ক্ষমা করা হবে।’’[4]
[2] মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৫।
[3] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ আয়াত। তাওরাত বিষয়ে আরো দেখুন: সূরা বাকারা : ৫৩, ৮৭; আল ইমরান: ৩, ৪৮, ৬৫, ৯৩; নিসা: ১৫৩; মায়িদা: ৪৩, ৬৮, ১১০; আন’আম: ৯১, ১৫৪; আ’রাফ: ১৫৪, ১৫৭; তাওবা ১১১; হুদ: ১৭, ১১০; সূরা বনী ইসরাঈল: ২; আম্বিয়া: ৪৮; মুমিনুন: ৪৯; কাসাস: ৪৩; সাজদা: ২৩; গাফির/মুমিন: ৫৩; ফুস্সিলাত: ৪৫; আহকাফ: ১২; ফা্তহ: ২৯; সাফ্ফ: ৬; জুম’আ: ৫ আয়াত।
[4] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩২৩-৩২৪।