‘ওসীলা’ শব্দটির অর্থের মধ্যে এরূপ বিবর্তন ঘটার কারণে এ বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে। ফলে সুন্নাত ও ইসলাম সম্মত ব্যবহার থেকে ওসীলা শব্দটি কখনো কখনো শিরকের পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত প্রাচীন আরবী ভাষায় ওসীলা শব্দের অর্থ নৈকট্য। পরবর্তীকালে আরবী ভাষাতেই ওসীলা শব্দটির অর্থ হয় ‘যদ্বারা নৈকট্য চাওয়া হয়’ বা ‘নৈকট্যের উপকরণ’। আধুনিক যুগে আরবীতে এবং বিশেষ করে বাংলায় ওসীলা শব্দটি ‘উপকরণ’, মধ্যস্থতা, যন্ত্র, হাতিয়ার, দূত ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থের পরিবর্তনের কারণে শব্দটির বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে।
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন: ‘‘ওয়াও, সীন ও লাম: দুটি পরস্পর বিরোধী অর্থ প্রকাশ করে: প্রথম অর্থ: আগ্রহ ও তালাশ। ... দ্বিতীয় অর্থ চুরি করা।’’[1]
প্রসিদ্ধ মুফাস্সির ও ভাষাবিদ রাগিব ইসপাহানী (৫০৭) বলেন: ‘‘ওসীলা: অর্থ আগ্রহের সাথে কোনো কিছুর নিকটবর্তী হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘তোমরা তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর’। আল্লাহর দিকে ওসীলার হাকীকাত হলো ইলম ও ইবাদতের মাধ্যমে এবং শরীয়তের মর্যাদাময় বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় প্রতিষ্ঠিত থাকা। এ হলো নেক আমল বা নৈকট্য।’’[2]
আমরা ইতোপূর্বে তৃতীয় অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা বিষয়ক আলোচনায় দেখেছি যে, মহান আল্লাহ তাঁকে ‘ওসীলা’ প্রদান করবেন। স্বভাবতই এখানে ওসীলা অর্থ উপকরণ বা মধ্যস্থতাকারী নয়, বরং ওসীলা অর্থ নৈকট্য। মহান আল্লাহ তাঁকে সর্বোচ্চ নৈকট্য ও নিকটতম মর্তবা প্রদান করবেন।
‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআনে দু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। এক স্থানে আল্লাহ বলেন:
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنْكُمْ وَلا تَحْوِيلا أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
‘‘বল, ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে (ইলাহ) ধারণা কর তাদেরকে আহবান কর, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট (ওসীলা) সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।’’[3]
এখানে আরবী জ্ঞাত পাঠক দেখতে পাচ্ছেন যে, ‘তারা ওসীলা সন্ধান করে কে কত নিকটতর’, এ কথটির মধ্যে প্রথমে ‘ওসীলা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং পরে ‘কুরবাহ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে কুরআনের ব্যবহার থেকেই সুস্পষ্ট যে, ওসীলা ও ‘কুরবাহ’ শব্দদ্বয় সমার্থক এবং ওসীলা সন্ধানের অর্থ নৈকট্য লাভের চেষ্টা।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য সন্ধান কর এবং তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’’[4]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু জারীর আত-তাবারী (৩১০ হি) বলেন:
وابتغوا إليه الوسيلة يقول واطلبوا القربة إليه ومعناه بما يرضيه والوسيلة هي الفعلية من قول القائل توسلت إلى فلان بكذا بمعنى تقربت إليه
‘‘তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর। এর অর্থ: তাঁর দিকে নৈকট্য সন্ধান কর,অর্থাৎ যে কর্ম করলে তিনি সন্তুষ্ট হন তা করে। ওসীলা শব্দটি ‘তাওয়াস্সালতু’ কথা থেকে ‘ফায়ীলাহ’ ওযনে গৃহীত ইসম। বলা হয় ‘তাওয়াস্সালতু ইলা ফুলান বি-কাযা, অর্থাৎ আমি অমুক কাজ করে অমুকে নিকটবর্তী হয়েছি।’’[5]
এরপর ইমাম তাবারী বিভিন্ন জাহিলী কবির কবিতা উদ্ধৃৃত করে প্রমাণ করেন যে, ওসীলা শব্দটির অর্থ নৈকট্য। অতঃপর তিনি সাহাবী ও তাবিয়ীগণ থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাদের মতামত সনদ সহ উদ্ধৃত করেন। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), তাবিয়ী আবূ ওয়ায়িল, আতা ইবনু আবি রাবাহ, কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ, মুজাহিদ ইবনু জাবর, হাসান বাসরী, আব্দুল্লাহ ইবনু কাসীর, সুদ্দী আল-কাবীর, ইবনু যাইদ, প্রমুখ মুফাস্সির থেকে তিনি উদ্ধৃৃত করেছেন যে, সকলেই বলেছেন ‘তাঁর ওসীলা সন্ধান কর’ অর্থ তাঁর নৈকট্য সন্ধান কর, অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য ও রেযামন্দিমূলক নেককর্ম করে তাঁর নৈকট্য ও মহববত লাভে সচেষ্ট হও।[6]
এ আয়াতটি মূলত মুমিনের সফলতার মূল কর্মগুলি বর্ণনা করেছে: (১) ঈমান, (২) তাকওয়া, (৩) অতিরিক্ত নেককর্ম ও (৪) জিহাদ। নিজের প্রতি মুমিনের দায়িত্ব ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে মূল বেলায়াত অর্জন করা। তাকওয়া মূলত ফরয পালন ও হারাম বর্জনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এরপর অতিরিক্ত নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে প্রতিযোগিতা করতে হবে। সর্বোপরি সমাজ, জাতি ও মানবতার জন্য দীন প্রচার, প্রসার, সংরক্ষন ও জিহাদ করতে হবে। ইতোপূর্বে আমরা বেলায়াত সংক্রান্ত হাদীসে বিষয়টি দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে মূল বেলায়াত লাভ হয়। আর অনবরত নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর বেলায়াত, নৈকট্য বা ওসীলা লাভের বা মাহবূবিয়্যাত অর্জনের ক্ষেত্রে মুমিনগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়।
উপরের বিষয়গুলি খুবই স্পষ্ট এবং এ অর্থে বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য বা অসীলা সন্ধান করা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু পরবর্তীকালে, ওসীলা শব্দটি আরো কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন মতভেদ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সেগুলির অন্যতম: (১) দু‘আর মধ্যে ‘ওসীলা’, (২) পীর-মাশাইখের ‘ওসীলা’ ও (৩) উপকরণ বা মধ্যস্থতাকারী অর্থে ওসীলা।
[2] রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত পৃ. ৫২৩-৫২৪।
[3] সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৫৬-৫৭ আয়াত।
[4] সূরা (৫) মায়িদা: ৩৫ আয়াত।
[5] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ৬/২২৬।
[6] তাবারী, তাফসীর ৬/২২৬-২২৭ ও ১৫/১০৪-১০৬।