ইতোপূর্বে আমরা কুরআন-হাদীসের আলোকে তৎকালীন আরব ও ইহূদী খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের শিরক সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এরপর আর সমাজে প্রচলিত শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন থাকে না। কারণ এগুলির আলোকে সমাজে প্রচলিত শিরক সম্পর্কে পরিচয় লাভ করা খুবই সহজ। তা সত্ত্বেও এখানে শীয়াগণ এবং সমমনা মানুষদের প্রচারিত বিভিন্ন শিরকী বিশ্বাস ও কর্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব। মহান আল্লাহর তাওফীক ও কবুলিয়্যাত প্রার্থনা করছি।
৫. ৫. ১. রুবূবিয়্যাতের শিরক
আমরা ইতোপূর্বে রুবূবিয়্যাতের তাওহীদ এবং রুবূবিয়্যাতের শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। রুবূবিয়্যাতের বা প্রতিপালনের তাওহীদের মূল হলো, যে এ বিশ্ব পরিচালনা, সৃষ্টি, বিনাশ, ধ্বংস, রিয্ক, সম্পদ, সুস্থতা, অসুস্থতা, সচ্ছলতা, অসচ্ছলতা, কল্যাণ, অকল্যাণ ইত্যাদি সকল কিছুর ক্ষমতা একমাত্র মহান আল্লাহরই। এ ক্ষমতায় কেউ তার শরীক নয় এবং তিনি নিজেও কাউকে কখনো তাঁর এ ক্ষমতায় শরীক করেন নি। আল্লাহর নবীগণ, ওলীগণ, ফিরিশতাগণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ এ সকল বান্দাকে ভালবাসেন, দয়া করে তাঁদের দু‘আ ইচ্ছা করলে কবুল করেন, তাঁদেরকে ইচ্ছা করলে সুপারিশ করার সুযোগ দিবেন, ইচ্ছ করলে তাদের সুপারিশ কবুল করতে পারেন, তবে কাউকে কোনো ক্ষমতা দেন নি, তাঁর কোনো সাহায্যকারীর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে অনেক দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু তাঁদেরকে কোনো ক্ষমতা দেন নি। আর কোনো মানুষকে তিনি কোনো ক্ষমতা বা দায়িত্ব কিছই দেন নি।
আর এ পর্যায়ের শিরকের মূল হলো মুজিযা, কারামত, শাফা‘আত বিষয়ক আয়াত, আল্লাহর মাহবূবিয়্যাত বিষয়ক কথা ইত্যাদিকে পূজি করে একথা মনে করা যে, আল্লাহর কোনো বান্দা কোনো বিশেষ কর্মের কারণে বা বিশেষ পর্যায়ে মহান আল্লাহ থেকে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা, বিশ্বপরিচালনায় হস্তক্ষেপ বা কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা লাভ করেছেন, করেন বা করবেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন মুশরিক সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও যুক্তি এবং কুরআন-হাদীসের বক্তব্য আমরা দেখেছি। এখন আমরা এ বিষয়ে সমাজে প্রচলিত কিছু বিষয় আলোচনা করব।
৫. ৫. ১. ১. ক্ষমতা বিষয়ক শিরক
আমরা ইতোপূবে দেখেছি যে, মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জাগতিক উপকরণাদি ছাড়া নিজের ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে কারো মঙ্গল-অমঙ্গল করতে পারে, হেদায়াত বা পথভ্রষ্ট করতে পারে, বিপদ দান করতে বা দূর করতে পারে, বৃষ্টি দিতে বা বন্ধ করতে পারে, জান্নাতে বা জাহান্নামে নিতে বা বের করতে পারে, জীবন, মৃত্যু, সচ্ছলতা, অসচ্ছলতা, সুস্থতা, অসুস্থতা, রিয্ক ইত্যাদি বিষয়ে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে বিশ্বাস করা হলো আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের শিরক। আরবের মুশরিকগণ এ সকল বিষয়ে মহান আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতায় বিশ্বাস করত, তবে আল্লাহ তাঁর কোনো কোনো বান্দাকে এরূপ সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দিয়েছে বলে বিশ্বাস করত। শীয়াদের মধ্যে আলী (রাঃ), তাঁর বংশের ইমামগণ, ইমামগণের খলীফাগণ, তাদের মধ্যকার ওলী-আল্লাহগণ ও পীর-মাশাইখের বিষয়ে এমন অগণিত উদ্ভট কল্পকাহিনী বর্ণিত হয়েছে যা থেকে সাধারণ মানুষদের মধ্যে এরূপ বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে, এ সকল মানুষ এরূপ কিছু ক্ষমতা রাখেন। শীয়াদের প্রভাবে সুন্নী সমাজেও এরূপ শিরকী বিশ্বাস প্রসার লাভ করেছে। বিশেষত ইসলামের প্রথম অর্ধ সহস্র বৎসরের পরে, ক্রুসেড ও তাতার আক্রমন চলাকালীন ও পরবর্তী সময়গুলিতে লেখা আওলিয়াগণের জীবনী, তাঁদের নামে প্রচলিত অনেক কথাবার্তা থেকে এরূপ অনেক বিশ্বাস সাধারণ মানুষদের মধ্যে জন্মেছে। মূলত এ সকল গল্প,কাহিনী ও এ সকল যুগের কোনো কোনো আলিমের কথাই এ সকল শিরকের পক্ষের ‘দলীল’।
আমরা জানি যে, ইবাদতের শিরক বা কর্মের শিরকের উৎস হলো রুবূবিয়্যাতের শিরক বা আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো কল্যাণ বা অকল্যানের অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা। এরূপ বিশ্বাসই মানুষকে এরূপ ক্ষমতাধরকে ইবাদত করতে বা তাঁকে ‘চূড়ান্ত ও অলৌকিকভাবে ভক্তি করতে ও তাঁর কাছে নিজের চূড়ান্ত বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ’ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এজন্য কুরআন কারীমে এ বিষয়ক বিভ্রান্তি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দূর করা হয়েছে। বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ফিরিশতা, নবী, ওলী কাউকে কোনোরূপ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিষয়েও বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে যে, তাঁর দায়িত্ব প্রচার ও দীন প্রতিষ্ঠা। কারো হেদায়াত, ভাল, মন্দ, কল্যাণ, অকল্যাণ ইত্যাদির কোনোরূপ দায়িত্ব, অধিকার বা ক্ষমতার ঝামেলা মহান আল্লাহ তাঁকে প্রদান করেন নি। কুরআন কারীমের এ বিষয়ক বিভিন্ন নির্দেশনা আমরা ইতোপূর্বে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছি।
কুরআন কারীম ও তদসঙ্গে প্রসিদ্ধ সহীহ হাদীস গ্রন্থগুলির পাঠ ও অধ্যয়নের অভাবই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এরূপ শিরকের প্রসারের মূল কারণ। এজন্য এ সকল শিরকী বিশ্বাসের পক্ষে যারা প্রচার করেন তারা কখনোই কুরআন কারীম বা হাদীস শরীফ থেকে একটি সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যও পেশ করতে পারেন না যে, মহান আল্লাহ অমুক আয়াতে বলেছেন বা অমুক হাদীসে বলা হয়েছে যে, তিনি তাঁর কোনো বান্দাকে বিশ্ব পরিচালনা বা কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা প্রদান করেন বা করেছেন, অথবা অমুক পর্যায়ে যে ব্যক্তিই পৌঁছাবে সে ব্যক্তিই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অমুক পর্যায়ের ক্ষমতা লাভ করবে....। এ বিষয়ে যা কিছু ‘দলীল’ পেশ করা হয় সবই ইসলামের বরকতময় যুগগুলির পরে শীয়াদের প্রভাবে উদ্ভাবিত বিভিন্ন জনশ্রুতি, গল্প-কাহিনী, বিভিন্ন বুজুর্গের নামে প্রচারিত কথাবার্তা ও পরবর্তী যুগগুলির কোনো কোনো আলিমের মতামত মাত্র, যা সবই কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসের সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক।
কুরআন কারীমের অগণিত আয়াতের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীতে, অসংখ্য সহীহ মুতাওয়াতির ও আহাদ হাদীসের সুস্পষ্প ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের বিপরীতে কথিত এ সকল ভিত্তিহীন বানোয়াট কথার উদ্ধৃতি দেওয়া, আলোচনা করা বা খন্ডন করাও পাগলামি বলে মনে হয়। যেমন তারা বলেন: ‘‘আল্লাহ বলেছেন: হে মুহাম্মাদ (ﷺ), সবাই আমার সন্তুষ্টি তালাশ করে, আর আমি আপনার সন্তুষ্টি তালাশ করি, আমি আরশ থেকে ফারাশ পর্যন্ত আমার সকল রাজত্ব আপনার জন্য উৎসর্গ করেছি। আপনার হুকম চন্দ্র ও সূর্যের উপর কার্যকর; আপনার পুত্র আব্দুল কাদির জীলানীকে সালাম না দিয়ে সূর্য উদিত হতে পারে না। ...।’’
সম্মানিত পাঠক, এ কথাগুলির বিষয়ে আপনি কী বলবেন? মহান আল্লাহ এ কথাগুলি বলেছেন তা আমরা কিভাবে জানলাম? আমরা জানি যে, কাশফ, ইলহাম, স্বপ্ন ইত্যাদি ইসলামের কোনো দলীল নয় এবং আকীদার ভিত্তি নয়। নবী-রাসূলের নিকট প্রেরিত ওহীর মাধ্যমে ছাড়া আল্লাহর কোনো কথা আমরা জানতে পরি না। মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপরে যে ওহী নাযিল করেছেন- কুরআন ও হাদীস- তার মধ্যে এ কথা কোথাও নেই। তাহলে কি তাঁরা মনে করেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরে কোনো নবীর নিকট এ কথাগুলি আল্লাহ ওহী করে জানিয়েছিলেন? না হলে আমরা কিভাবে জানলাম? বিশেষত কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ যা কিছু বলেছেন সব কিছুর সাথে সাংঘর্ষিক এ কথাগুলি। কুরআন ও হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে একমাত্র আল্লাহর হুকুমে চাঁদ-সূর্য ও সকল কিছু চলে, মহাবিশ্বের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে ভালমন্দ বা বিশ্ব পরিচালনার কোনো ঝামেলা প্রদান করেন নি। এমনকি বদদোয়া করতে পর্যন্ত নিষেধ করেছেন। এ সকল কথার বিপরীতে এ কথাগুলি মহান আল্লাহর নামে যারা বলতে পারেন তাঁদের সাথে আপনি কি কথা বলবেন? এ বিষয়ে ও অন্যান্য সকল বিষয়েই তাঁদের সকল বক্তব্য ও সকল দলীলেরই অবস্থা এই।
এমনকি কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকেও এ সকল কথার কোনোরূপ সামান্যতম সমর্থন পাওয়া যায় না। মুসলিম উম্মাহর ফিতনার যুগে কোনো ভাল বা খারাপ মানুষ এগুলি বলেছেন। এর বিপরীত, এর সাথে সাংঘর্ষিক, এগুলি খন্ডন করে, এগুলি সমর্থন করে অথবা এর চেয়েও অনেক বাড়াবাড়ি কথা তাদের মত আরো অনেক ভাল ও মন্দ মানুষে বলেছেন। যারা বলেছেন তাদের জন্য আমরা সুধারণা পোষণ করতে পারি, ওজর সন্ধান করতে পারি, কিন্তু কখনোই কুরআন ও হাদীসের অগণিত সুস্পষ্ট নির্দেশনার সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক এ সকল কথাকে আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি বানাতে পরি না।
৫. ৫. ১. ২. ইলম বিষয়ক শিরক
ইলমুল গাইবের দাবি কখন ও কিভাবে শিরক বা কুফর বলে গণ্য তা আমরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে শিরকের আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। ইহূদী আব্দুল্লাহ্ বিনু সাবা এবং তাঁর অনুসারীদের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে শীয়াগণ আলী (রাঃ), তাঁর বংশের ইমামগণ, ওলীগণ ও পীর-মাশাইখের বিষয়ে ইলমুল গাইবের বিশ্বাস পোষণ করে। এ বিষয়ে শীয়া ইমাম ড. মুসাবীর বক্তব্য আমরা উপরে দেখেছি।
তৃতীয় অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইলম বিষয়ক আলোচনায় এবং এ অধ্যায়ে রুবূবিয়্যাতের শিরক আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা এ বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা উল্লেখ করেছি। এ সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনার বিপরীতে শীয়াগণ এবং তাদের সমমনা ও তাদের মতামত দ্বারা প্রভাবিত সুন্নী সমাজের এ শ্রেণীর মানুষেরা যা কিছু বলেন তা সবই উপরের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বক্তব্যের মত আজগুবি ও বানোয়াট কথাবার্তা, গল্প কাহিনী, কাশফ বা স্বপ্নের কথা এবং কোনো কোনো আলিমের মতামত ও ব্যাখ্যা মাত্র। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার বিপরীতে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট অন্য কোনো নির্দেশনা আলোচনা করা ও সমন্বয় করা যায়। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার বিপরীতে এরূপ গল্প-কাহিনী, স্বপ্ন, কাশফ বা আলিমগণের মতামত আলোচনা করা মূলত কুরআন-হাদীসের সাথে বেয়াদবী এবং সময় নষ্ট করা ছাড়া কিছুই নয়।
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইলমুল গাইব আছে বলে বিশ্বাস করার ভয়াবহতা বর্ণনা করে আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রাহ) বলেন:
تصديق الكاهن بما يخبره من الغيب كفر، لقوله تعالى (قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ)...
‘‘ভবিষ্যদ্বক্তা বা গণক-জ্যোতিষী গাইবী বিষয়ে যা বলে তা বিশ্বাস করা বা তা সত্য বলে মনে করা কুফ্রী; কারণ মহান আল্লাহ বলেছেন[1]: ‘‘বল: আল্লাহ ব্যতীয় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য (গাইব) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।’’[2]
তিনি আরো বলেন:
اعلم أن الأنبياء عليهم الصلاة والسلام لم يعلموا المغيبات من الأشياء إلا ما علمهم الله أحياناً. وذكر الحنفية تصريحاً بالتكفير باعتقاد أن النبي (ﷺ) يعلم الغيب؛ لمعارضة قوله تعالى: (قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ)...".
‘‘জেনে রাখ, নবীগণ (আঃ) অদৃশ্য বা গাইবী বিষয়াদির বিষয়ে আল্লাহ কখনো কখনো যা জানিয়েছেন তা ছাড়া কিছুই জানতেন না। হানাফী মাযহাবের আলিমগণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাইব জানতেন বলে আকীদা পোষণ করা কুফরী, কারণ তা আল্লাহর এ কথার সাথে সাংঘষিক[3]: ‘‘বল: আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য (গাইব) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।’’[4]
৫. ৫. ১. ৩. ওসীলা বিষয়ক শিরক
ওসীলা বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা সমাজে বিদ্যমান। ওসীলা কখনো ইসলাম নির্দেশিত বা সুন্নাত-সম্মত কর্ম, কখনো সুন্নাত বহির্ভুত বা সুন্নাতের ব্যতিক্রম কর্ম এবং কখনো তা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে বা উলূহিয়্যাতে শিরকের পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। মহান আল্লাহর কাছে তাঁর মহান গুণাবলি, তাঁর পবিত্র নামসমূহ এবং তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমানের ওসীলা দিয়ে সকাতরে আর্জি করি যে, তিনি যেন সঠিকভাবে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করার এবং ব্যাখ্যা করার তাওফীক আমাকে প্রদান করেন।
‘ওসীলা’ শব্দটির বিষয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা এর অর্থের পরিবর্তন ও বিবর্তন। ভাষাতত্ত্বের সাথে পরিচিত সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের অর্থের পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটে। সময়ের আবর্তনের কারণে একই ভাষার মধ্যে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটতে পারে। আবার এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় গমনের কারণেও অর্থের পরিবর্তন ঘটে। যেমন বাংলা ভাষায় এক শতাব্দী আগে ‘সন্দেশ’ শব্দটির অর্থ ছিল সংবাদ। কিন্তু বর্তমানে শব্দটির অর্থ বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন। কুরআন-হাদীসে ব্যবহৃত আরবী ভাষায় ‘লাবান’ অর্থ দুধ। কিন্তু বর্তমানে আরব দেশে ‘লাবান’ অর্থ ঘোল।
ভাষান্তরের কারণে অর্থের পরিবর্তন খুবই বেশি। আরবীতে ‘জিন্স’ অর্থ শ্রেণী বা লিঙ্গ, কিন্তু বাংলায় ‘জিনিস’ অর্থ এগুলির কিছুই নয়, বরং বাংলায় এর অর্থ দ্রব্য বা বস্ত্ত। আরবীতে ও ফার্সীতে নেশা বা নাশওয়া অর্থ ‘মাতলামী’ বা মাদকতা। কিন্তু বাংলায় শব্দটির অর্থ মাদকতা হয় আবার অভ্যস্ততাও হয়। একারণে অনেক সময় আমরা অস্পষ্টতার মধ্যে পড়ে যায়। কেউ বলেন, নেশা হারাম। উত্তরে অন্যে বলেন, ভাত, চা ইত্যাদিও তো নেশা? বস্ত্তত বাংলা ‘নেশা’ বা অভ্যস্ততা হারাম নয়, বরং ফার্সী নেশা বা মাতলামী ও মাদকতা হারাম। অভ্যস্ততা হারাম বা হালাল হবে অভ্যাসের বিষয়ের বিধান অনুসারে, আর মাদকতা সর্বাবস্থায় হারাম।
[2] মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৪৯।
[3] সূরা (২৭) নামল: ৬৫ আয়াত।
[4] মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৩।